Friday, December 4, 2020

 https://www.techtouchtalk.in/ms26112020/?fbclid=IwAR10tW-r_YAsUlQO64gxkI9CVuGsO5l8z3LLWh-scW0z_BOdirIvFKTVW10

Thursday, October 1, 2020

ভুবনডাঙা: কচু-বরবটির ক্লাস

ভুবনডাঙা: কচু-বরবটির ক্লাস:   কচু-বরবটির ক্লাস  মুরারি সিংহ হে মৈথিলি, হে ঢুকুঢুকু, কচু-বরবটির ক্লাসে গিয়ে দেখো একটি মুণ্ডুহীন আমি-র ভিতর মমি হয়ে থাকা শূককীট আজ  পাতকুয়...

Saturday, February 17, 2018

পোস্টমডার্ন থেকে পোস্ট-ট্রুথ এবং মানুষ+ ০ মুরারি সিংহ


পোস্টমডার্ন থেকে পোস্ট-ট্রুথ এবং মানুষ+    মুরারি সিংহ
কাআ তরুবর পঞ বি ডাল /চঞ্চল চিএ পইঠে কাল – একথা লিখেছিলেন কাহ্ন-পা। চর্যাপদের কবি। সেই কতকাল আগে। বাংলা-কবিতার সূচনা-লগ্ন। এই পদে সেই সিদ্ধাই যোগী কায়া তথা শরীরকে তরুবর বা গাছের সঙ্গে তুলনা করে লিখলেন তার পাঁচটি ডাল মানে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়। সেই পঞ্চ-ইন্দ্রিয় আমদের শরীরে অ্যান্টেনার কাজ করে চলেছে এবং সেই অ্যান্টেনা বেয়ে মানব-চিত্তে প্রবেশ কড়ছে কাল অর্থাৎ সময়। ফলে মানুষের মন চঞ্চল হচ্ছে। আর এই চঞ্চলতার ফলেই মানব চেতনায় এত পরিবর্তনের বহর।  
আমরা জানি কাল নামক এই অদৃশ্য স্রোতের ছোঁয়ায় চারপাশে সবকিছু ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে। এই বদল জগৎ ও জীবনের এক অনিবার্য প্রক্রিয়া। চর্যাপদ থেকে পথ চলা শুরু করে বাংলা কবিতা ও বাঙালি মননও পরবর্তী প্রায় হাজার বছরে এই রকম অজস্র বদলের মুখোমুখী হয়েছে। তৈরি হয়েছে নানান মনোভঙ্গী  নানান বাঁক ও বাঁকবদল নানান মেজাজ ও মর্জি। সেই পরিবর্তনে কখনো কোন পূর্ণছেদ পড়েনি। কালস্রোতের ধারায় অজস্র ভাঙাগড়া দিয়ে সাজানো বদলের মাধ্যমে সেই রূপান্তরের খেলা এখনো বয়ে চলেছে সমান তালে ।
ইদানীং সময়ের হিসেব ধরলে গত শতকের শেষ দশক থেকে চলতি সময় পর্যন্ত যে বদল তার জন্যে এই গদ্যে দুটো শব্দের উপর ফোকাস করতে হচ্ছে। পোস্টমডার্ন এবং পোস্ট-ট্রুথযদিও শব্দ-দুটি ইংরেজি তবু তার প্রয়োগে লজ্জার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ শব্দ-প্রয়োগে ছুঁৎমার্গী হয়ে লাভ নেই। সাগর পেরিয়ে এসে সাহেবরা এদেশে পা রাখার পর চেয়ার-টেবিল-কাপ-প্লেট-গ্লাস এই রকম তাদের ভাষার অজস্র শব্দ বাংলা শব্দ-ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের ভাবের প্রকাশও প্রসারিত হয়েছে। প্রতি বছর এখনো অনেক বিদেশি শব্দ আসছে। বলতে গেলে এখন ইংরেজি তো আমাদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা।
প্রথমেই ধরা যাক পোস্টমডার্ন। যার দ্বিতীয়ভাগের ‘মডার্ন’ শব্দটার সঙ্গে আমাদের আগেই পরিচিতি ছিল, প্রথম ভাগের ‘পোস্ট’ শব্দটির সঙ্গেও। যদি তা আলাদা আলাদা ভাবে। এখন মডার্ন-এর আগে পোস্ট বসিয়ে তাদের জোড়া লাগিয়ে একটি নতুন শব্দ পেলাম ‘পোস্টমডার্ন’যার অর্থ দাঁড়াল এমন একটা সময়কাল যা মডার্ন পরবর্তী   
আমরা জানি মডার্ন শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘আধুনিক’
আবার পোস্ট শব্দটির অনেকগুলি অর্থের মধ্যে এক্ষেত্রে বাঙলার ‘উত্তর’ শব্দটিই যথোপযুক্ত। কারণ পোস্ট এখানে বিশেষণ। তাহলে পোস্টমডার্ন শব্দের অর্থ দাঁড়ালো ‘উত্তর-আধুনিক’অনেকে অবশ্য পোস্টমডার্ন-এর অর্থে ‘অধুনান্তিক’ শব্দটির প্রয়োগ পছন্দ করেন। তাতে কিছু অসুবিধে নেই। শুধু তত্ত্বের কচকচানি বাড়ে। আমার মনে হয় এটা সেরকম কোনো তত্ত্ব নয়। ‘উত্তর-আধুনিক’ হোক অথবা ‘অধুনান্তিক’ পোস্টমডার্ন মানে এমন একটা সময় যা আধুনিক-এর পরবর্তী
সাধারণ বুদ্ধিতে এখানেই একটু খটকা লাগে। আমরা জানি আধুনিক মানে এই সময়ে যা ঘটে চলেছে। অর্থাৎ সমসাময়িক। হাল-আমলের। তাহলে তার পরবর্তী বা উত্তর-আধুনিক সময় আবার আসছে কোথা থেকেআলোচনা শুরুর প্রথমেই তাই এই সংশয়টা নিয়ে কিছু আলোচনা দরকার।
ভারতীয় বিশ্বাসে বরাবরই সময় মানে কালকেই গণ্য করা হয়েছে। সেখানে শাস্ত্রকারদের মতে সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর পেরিয়ে এখন চলছে কলিকাল। সেই কালের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ হয়। এর বেশি কিছু নয়। ইতিহাসের আলোচনায় সেই অতীতকেই আবার নানা পর্বে ভাগ করা যায়। যেগুলিকে যুগ বলে জানি। যেমন - প্রাক-বৈদিক যুগ, বৈদিক-যু্‌ মহাক্যব্যের-যুগ, পৌরাণিক-যুগ ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে তাদের মতো করে ইতিহাস লিখতে গিয়ে আবার মৌর্যযুগ গুপ্তযুগ, সুলতানি আম্‌ মোগল-যুগ এমন ভাগও করা হল। সেই নিরিখে আমাদের বর্তমানকে চিনলাম ব্রিটিশ যুগ হিসেবে। তারপর তো দুশো বছর ধরে যা করার সেই ইংরেজ-শাসকরাই করল। তাদের ধাঁচেই আমাদের কাল-গণনা শুরু হল। তাদের হাত ধরেই একদিন আমরা পৌঁছে গেলাম আধুনিক যুগে। যেটা সাগরপারে তাদের দেশে মডার্ন নামে পরিচিত।
সাহেবদের শব্দকোষে আধুনিকবা modern শব্দটি আবির্ভূত হয় ১৬ শতকের শেষ ভাগে যার মূলে ছিল এনলাইটেনমেন্ট এনলাইটেনমেন্ট মানে অন্যের উপদেশ পরামর্শ বা নির্দেশকে না মেনে যে-কোনোকিছুকে জানা ও বোঝার ব্যাপারে নিজের বিচার বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধকে প্রয়োগ করা অর্থাৎ অপরিপক্বতা বা নাবালকত্ব থেকে বার করে এনে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিকে সাবালক ও পরিপক্ব করে তোলা যার জন্যে দরকার ইচ্ছে ও সাহস যেটা মধ্যযুগের ইউরোপ করে উঠতে পারেনি তাই এই আধুমিক-সময়েই রাজাদের সঙ্গে যোগ-সাজসে ক্যাথলিক চার্চ ও পাদ্রিদের আরোপিত অন্ধবিশ্বাস-নির্ভর ধর্মীয় অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে এসে শুরু হল যুক্তি-শৃঙ্খলা ও বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ইতালি তথা ইউরোপে গড়ে ওঠা বিখ্যাত নবজাগরণের পালা যার প্রধান প্রধান লক্ষণগুলি হল একদিকে ভৌগোলিক অভিযানের মাধ্যমে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার, অন্যদিকে নিত্য-নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি, আবার নানান ধর্মীয় সংস্কার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র জাতি রাজনীতি আইন-আদালত এই সব নতুন ধারণার সূত্রপাত। এরই ক্রমপরিণতিতে পরবর্তী সময়ে ঘটে গেল শিল্প-বিপ্লব ফরাসি-বিপ্লব আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ক্রীতদাস-প্রথার বিলোপ এই রকম সব বড়ো বড়ো ঐতিহাসিক ঘটনা।
আবির্ভাবের সময়ে সাহেবদের দেশে অবশ্য modern বলতে বোঝাতো বর্তমান-সময় বা এখন-কে যা ব্যাবহার করা হত এর আগের সময় অর্থাৎ মধ্যযুগে যা ঘটে গেছে  তার থেকে এই সময়ের ঘটনাবলিকে আলাদা করে বোঝানোর জন্যে তার সাহেবদের ঘর-গৃহস্থালিতে আধুনিক শব্দটি এক নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির হল তাদের মনে তৈরি করল এক নতুন উদ্দীপনা এই ভাবে আধুনিক শব্দটির সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে গেল দেশ কাল এবং ইতিহাস
মডার্ন-এর পরে আসা যাক মডার্নিজিম-এর প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো মডার্ন ও মডার্নিজম শব্দদুটি অনেকটা এক রকম মনে হলেও দুইয়ের মধ্যে কিন্তু বিস্তর পার্থক্য আছে আসলে ইউরোপীয় চিন্তকরা ism-এর খুব ভক্ত। অনেক শব্দের পরে এই রকম একটা – ism বসিয়ে নিয়ে তারা একটা নতুন মতবাদ তৈরি করতে ভালোবাসে। সেই সূত্রে মডার্ন থেকে মডার্নিজিম। মডার্ন-এর ক্ষেত্র যদি হয় ভূগোল বিজ্ঞান অর্থনীতি প্রযুক্তি ধর্ম রাষ্ট্র রাজনীতি এই সব ব্যাপারে নতুন চিন্তার উন্মেষ তাহলে মডার্নিজিমের ক্ষেত্র হল সেই নতুন চিন্তার উপর ভিত্তি করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানান পালাবদল সাহেবদের বিচারে তাদের মডার্ন এর সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল মোটামুটি পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয় পর্বে কন্সটান্টিনোপলের পতনের পর থেকে। তারপর শিল্প-বিপ্লব ইত্যাদি। ইতালিতে জন্ম নেওয়া রেনেসাঁ তথা নবজাগরণের ঢেউ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপের নানা প্রান্তে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইউরোপীয় মর্ডানিজিম উনিশ শতকের শেষ অর্ধে শুরু হয়ে বিষ শতকের প্রথম অর্ধ পর্যন্ত।
এনলাইটেনমেন্ট-এর ফলে মানুষের মন চিন্তার অবদমন থেকে মুক্তি পেল। যার একদিকে রইল চিন্তা-ভাবনা ও কাজের ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিস ও রোমের অবলুপ্ত ধারাটিকে পুনর্জ্জীবিত করা অন্যদিকে শিল্প-সংস্কৃতির জগতেও নতুন কিছু করে দেখানোর তাগিদনতুন কিছু করা মানে যা প্রচলিত বা গতানুগতিক তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ধর্ম-নির্ভরতা ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের চিন্তার অভিমুখ বদলে গেল অন্তর্গত ব্যাক্তি-চেতনার উন্মেষের দিকে। তখন জীবন ও জগৎকে দেখার চোখটা বদলে গেল। সেখানে প্রাধান্য পেল ব্যক্তি-মানুষ। ফলে মডার্নিজিম হয়ে দাঁড়াল দৃষ্টিভঙ্গী তথা মনোভঙ্গীর বদল বা একটি মর্জি পশ্চিমি সমাজে এটা ছিল পুরোপুরি একটা নতুন জীবন-দর্শন যার শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতকের শেষ-পর্বে যদিও সপ্তদশ শতকেই বিশ্বের ঘটনাবলিকে নতুন চোখে দেখতে গিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (René Descartes) ঘোষণা করেছিলেন "I think, therefore I am" এনলাইটেনমেন্ট প্রসূত আধুনিকতার সম্ভাব্য আদর্শগুলি হল – মানবিকতাবাদ, যুক্তিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগতি ও বিশ্বজনীনতা। সবই ইতিবাচক। কিন্তু আধুনিকতাবাদের কাছে যা আশা করা হয়েছিল তা পাওয়া গেল না। দেখা গেল চাকা গড়াতে শুরু করেছে অন্য রাস্তায়। 
নতুনের খোঁজে মগ্ন হতে গিয়ে ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ ঐতিহ্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করল। তারা জোর দিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাবাদে। কী দেখছি বা কী ভাবছি তার চেয়ে তাদের কাছে বড়ো হল কীভাবে সেই দেখা বা কী ভাবে সেই ভাবা। অর্থাৎ দেখাটা হবে অবজেকটিভ নয় সাবজেকটিভ। ব্যক্তি-নির্ভর। সেই ব্যক্তি-মানসটি আবার গঠিত হবে আলোকপ্রাপ্তি থেকে জাত যুক্তি-শৃঙ্খলার উপর ভিত্তি করে। এই চিন্তা থেকেই তাদের মনে এল শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। প্রাচীন কুসংস্কারগুলো ত্যাগ করলেও ইউরোপবাসীর মনে জন্ম নিল এক নতুন কুসংস্কার। তার নাম আধিপত্যবাদ। তারা মনে করল যেহেতু শিক্ষা-দীক্ষা-অর্থ-সংস্কৃতি-সামরিকশক্তি সবকিছুতে তারাই শ্রেষ্ঠ অতএব তাদের অধিকার আছে বাকিদের উপর আধিপত্য করার। বাকিদের শিক্ষিত ও সভ্য করে গড়ে তোলার নামে শাসন শোষণ ও লুণ্ঠণ করার। ফলে উদ্ভব হল ধনতন্ত্রেরশিল্পবিপ্লব ও ধনতন্ত্রের ফলে সাহেবদের নিজেদের দেশে যেমন প্রচুর কলকারখানা গড়ে উঠল তেমনি উদ্ভব হল শ্রমিক শ্রেণির। দেখা দিল শিশু-শ্রম, দেহ-ব্যবসা। আবার একদিকে অরণ্য-ধ্বংস অন্যদিকে অজস্র চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা কালো-ধোঁইয়ায় ব্যাপক পরিবেশ-দূষণ। পরবর্তী সময়ে যার পরিণতি ঘটল সাম্রাজ্যবাদে। সুতরাং তারা মেতে উঠল অন্যের দেশে উপনিবেশ বানানোর প্রতিযোগিতায়। তারই রেশ টেনে সমগ্র ভারতবর্ষ একদিন ইংরেজদের পদানত হল। এদেশে অবাধে শাসন শোষণ হত্যাকণ্ড চালিয়ে এদেশের ধনসম্পদ লুঠপাট করে নিয়ে গিয়ে তারা নিজেদের দেশে শিল্প-বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল।
আবার সেই দেশ-দখলের খেলায় অর্থাৎ অন্যের দেশে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ইউরোপীয়রা এক সময়ে নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ শুরু করে দিল। বাইশ বছরের ব্যবধানে তারা পৃথিবীকে উপহার দিল দুটো মারাত্মক বিশ্বযুদ্ধ। পৃথিবী অবাক হয়ে দেখল শিক্ষিত সভ্য বলে দাবি করা মানুষেরা সমস্ত ন্যায়বোধ নীতিবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থে কতখানি নির্মম ও নৃশংস হতে পারে, নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে কত লক্ষ লক্ষ নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষের প্রাণ নিতে পারে দেশে দেশে নামিয়ে আনতে পারে মর্মান্তিক ধ্বংস-যজ্ঞ। এইভাবে মানুষের চিরন্তন বিশ্বাসের জায়গাগুলো ভেঙে খানখান হয়ে গেল। ইউরাওপের যে দীপায়ন দেখে মনে হয়েছিল সভ্যতা আরো মানবিক হবে অন্তিমে তাই হয়ে দাঁড়াল প্রাণঘাতী পারমানবিক এবং দানবিক সুতরাং সেখান থেকেই আধুনিকতার পতনপর্বও শুরু হয়ে গেল।
আমরা আধুনিক হয়েছিলাম ঔপনিবেশিক যুগে সাগর পেরিয়ে এদেশে আসা শ্বেতাঙ্গ শাসকদের হাত ধরে। তাই আমাদের সেই মডার্নিজিম ততটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। আধুনিকতার নাম করে সাহেবরা খুব কৌশলে তাদের ঠাট-বাট থেকে শুরু করে তাদের চিন্তা-পদ্ধতি ও সাংস্কৃতিক চেতনা আমাদের রক্তে-মজ্জায়-মস্তিষ্কে গুঁজে দিয়ে গিয়েছিল। তাদের কাছেই শিক্ষা পেয়ে আমরা নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে অস্বীকার করেছিলাম। আমরা মেনে নিয়েছিলাম আমাদের যা কিছু পুরানো সবকিছুই অমার্জিত নোংরা কুৎসিত এবং অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। ইংরেজদের প্ররোচনায় আমরা চেষ্টা করেছিলাম তাদের অতীতকে আপন করে নিতে। ফলে আমাদের আধুনিকতা হয়তে উঠেছিল নিজেদের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিনদেশি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি ও চিন্তা-পদ্ধতির অনুসরণ ও অনুকরণ। সুতরাং স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল সেই ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে মুক্তির আন্দোলন। এটা গেল আমাদের মডার্ন হবার একটা দিক।
অন্যদিকে অবশ্য পশ্চিমি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আমরা আমাদের মতো আধুনিক হতে শুরু করেছিলাম। আমাদের সেই আধুনিকতার শুরু রাজা রামমোহনের হাত ধরে। আমাদের সেই আধুনিকতার অর্থও মধ্যযুগীয় নানান কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস থেকে নিজেদের চিন্তাভাবনাকে মুক্ত করা এবং ভাষা সাহিত্য ধর্ম সমাজ ও সংস্কৃতির নানা পরিসরকে যথাযথ সংস্কার করে তাদের যুগোপযোগী করে তোলা।
এ ব্যাপারে রামমোহন বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথ মাইকেল দীনবন্ধু বঙ্কিমচন্দ্র রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ এদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা আমরা জানি। আবার অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা মনোযোগের অভাবে অনেকের অগোচরে থেকে গেছে। এখানে সেই রকম দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। 
পশ্চিমি মতে একটা দেশে সভ্যতার ইতিহাস লেখা শুরু হয় সে দেশে নগর-সভ্যতা জন্ম নেবার পর থেকে। সেই হিসেবে ইংরেজদের দাবি ছিল ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস শুরু আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের পর অর্থাৎ ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে এসে। কারণ তখনি প্রথম পাটলিপুত্র নগরের পত্তন হয়। যেহেতু ইংরেজরা ছিল বিজয়ী ও মালিকপক্ষ তাই তাদের কথা মতো লিখিত হতে থাকে পরাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস। কিন্তু ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় মহেঞ্জোদড়ো আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো ভারতবর্ষের নগর সভ্যতাও বহু পুরোন। প্রাক-বৈদিক আমলের। প্রথম প্রথম পাত্তা দিতে না চাইলেও পাথুরে প্রমাণ দেখে ইউরোপীয়রা বাধ্য হলেন সেই দাবি মেনে নিতে। যদিও সেই আবিষ্কারের কৃতিত্ত্ব রাখালদাসকে না দিয়ে ব্রিটিশরাই ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল।
উনবিংশ শতকের প্রথম অর্ধেই নতুন শিল্পোদ্যোগ তৈরির ব্যাপারে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিটিশ কোম্পানিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রায় একটা মিনি-শিল্পবিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। তখনো এদেশে জামশেদজি টাটার জন্মই হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য নুন নীল পশম কয়লা জাহাজ ব্যাঙ্কিং বিনিয়োগ সংবাদপর এই রকপম সব ক্ষেত্রে দ্বারকানাথের উদ্যোগ প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে।
অন্যদিকে পরাধীন দেশে নিজেদের শেকড়ের সন্ধানে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় দিকগুলিকে আবিষ্কারের ব্যাপারে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দীনেশচন্দ্র সেন বসন্তরঞ্জন রায় এদের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের কথা হাজারবার বললেও কম বলা হবে। 
আবার বিদেশিদের সমস্ত কুৎসা ও অপপ্রচারকে নস্যাৎ করে স্বামী বিবেকানন্দ যেমন প্রথম বিশ্বের দরবারে ভারতীয় ধর্মের উদার ও মহান ঐতিহ্যের কথা হাজির করলেন তেমনি রবীন্দ্রনাথ নোবেল-পুরস্কার জয় করে বুঝিয়ে দিলেন আমাদের সাহিত্যও কতখানি সমৃদ্ধ।
এদিকে ইংরেজদের অধীনস্থ হয়ে থাকতে থাকতে তাদেরই বিদ্যা ও কৌশল আয়ত্ব করে ভারতবর্ষের মানুষও নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ক্রমশ জোরালো করে তুলল। এক দিকে দেশের ভেতরে গান্ধিজির নেতৃত্বে সংগঠিত অহিংস আন্দোলন এবং বাংলা মহারাষ্ট্র পঞ্জাবের বিপ্লবীদের সশস্ত্র লড়াই অন্যদিকে দেশের বাইরে থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদহিন্দ ফৌজের রণহুংকার সবকিছু মিলেমিশে একসময় ব্রিটিশ শাসকদের বাধ্য করল এদেশের মাটি থেকে নিজেদের রাজ্যপাট গুটিয়ে সাগর পারে ফিরে যেতে। শেষ হল আমাদের কলোনিয়াল পর্ব। ইতিমধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিও একে একে বিদেশি শাসকদের হাত থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। সুতরাং কালের নিয়মে সারা পৃথিবীজুড়েই শেষ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী হিংসার মারণ-অভিযান। আধুনিকতার লক্ষণগুলিও ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে পথ করে দিয়েছে অনেক নতুন লক্ষণকে। যাদের আর আধুনিকতার আধারে আবদ্ধ রাখা যায় না। দরকার হয় নতুন কোনো অভিধা।
এখানেই চলে আসবে পোস্টমডার্নিজিমের প্রসঙ্গ। কিন্তু পোস্টমডার্নিজিম কেন। মাননীয় পাঠক, সে ব্যাপারে কিছু কথা এখন আমার মতো করেই বলি। যদিও বদ্রিলার্দ লিওতার লাকাঁ দেরিদা ফুকো জিল দেলুঁজ রোলাঁ বার্ত এই রকম মান্যগণ্য সাহেব পণ্ডিত ও তাত্ত্বিকদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে এ ব্যাপারে অনেক আলোচনা করা হয়। কিন্তু আমি ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে ধরতে চাইছি। আমার মতে ইউরো-আমারিকান পোস্টমডার্নিজিম এবং আমাদের পোস্টমডার্নিজিম দুটো এক নয়। কখনোই এক হতে পারে না। কারণ একটা এককালের শাসক তথা রাজাদের পোস্টমডার্নিজিম অন্যটা এককালের প্রজা তথা শোষিতদের পোস্টমড়ার্নিজিম। দুটোর চরিত্র কী করে এক হবে। যদিও বিশ্ব-ব্যাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু লক্ষণ মিলে যাতে পারে আবার অনেক কিছুতে বিস্তর গরমিলও থেকে যায়। আর আগেই বলেছি ওদেশের মডার্নিজেম আর আমাদের মডার্নিজম এক ছিল না। আমরা মডার্ন হয়েছিলাম ঔপনিবেশিক শাসনে। কিছুটা নিজেদের গরজে এবং কিছুটা শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া মানসিকতাকে শিরোধার্য করে। কিন্তু পোস্টমডার্ন সময়ে আমরা সেই অধীনতা থেকে মুক্ত। তাই তার গতিও ভিন্ন পথে।
মডার্নিজিমের মতো পোস্টমডার্ন শব্দটিও অবশ্য সাহেবদেরই বানানো। আমরা তাকে গ্রহন করেছি। সাহেবদের দেশে সাম্রাজ্যবাদভিত্তিক-মডার্নিজিমের পরবর্তী সময়টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে পোস্টমডার্ন নামে। তার সঙ্গে আবার পোস্টস্ট্রাকচারিলিজিম বা উত্তর-কাঠামোবাদের ব্যাপারটাও জড়িয়ে আছে। স্ট্রাকচারিলিজিমের জন্ম আধুনিকতাবাদের গর্ভে যার মানে ছিল যে কোনো চিন্তা ভাব কর্ম বচনের ব্যাপারে একটা কাঠামো বা ধাঁচা ধরে এগোনো। অর্থাৎ সেটা পূর্ব-নির্ধারিত। কিন্তু দুই-বিশ্বযুদ্ধ অতিক্রম আসা ইউরোপে সেই ধাঁচাগুলি ভেঙে যেতে লাগল। ভাঙা বিশ্বে পড়ে রইল ভেঙে পড়া বিপুল বিশ্বাস নৈতিকতা আদর্শ। তার থেকেই ভূমিষ্ঠ হল উত্তর-কাঠামোবাদ এবং পোস্ট-মডার্নিজিম, যার অন্যতম চরিত্র হল দেরিদার ভাষায় ডি-কনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণ।
আমার “পোস্টমডার্ন ও জয়-মা-কালী” বইটিতে পোস্টমডার্নিজিম নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলাম – “কার্যত বিশ্বযুদ্ধোত্তর-পর্বেই মানুষ বুঝতে শুরু করল জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনার ব্যাপারে আধুনিকতাবাদীদের একগুঁয়ে একপেশে মনোভাব ও প্রত্যয়ের মধ্যে একটা হাঁসফাঁসানির ভাব ছিল। কারণ সবকিছুকে একই ছাঁচে ঢালতে চেষ্টা করা বা সব ব্যাপারে একটা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি তৈরি করা, এবং নিজেদের সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত মানুষ বলে দাবি করে সারা পৃথিবীর মানুষজনকে শাসন ও শোষণ করার সপক্ষে কুযুক্তি খাড়া করা, তাদের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করা – সে-সবকিছুর ভেতরেই একটা চাপিয়ে দেওয়া দমবন্ধ ব্যাপার ছিল, একটা আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব ছিল, যা মানুষকে খর্ব করে, অপমানিত করে এবং যা সর্বাত্মকভাবে মানুষের মুক্ত-চিন্তার বিরোধী। আবার মজার কথা হল, পশ্চিমের স্বনামধন্য শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা শ্বেতাঙ্গদের সেই আগ্রাসন ও শোষণ প্রক্রিয়ার কোনো রকম বিরোধিতা করেননি বরং জেনে-বুঝে হোক অথাবা না-জেনে, তাকে সমর্থনই করেছিলেন, তার মধ্যে অংশগ্রহন করেছিলেন। ফলে পশ্চিমের আলোকপ্রাপ্তির সুবাদে অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত শাসন শোষণ নিপীড়ন লুণ্ঠন এবং আধিপত্যবাদের দাসত্ব করল। ঔপনিবেশিক শক্তির বিস্তার এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার পদসেবার কাজেই আলোকিত জ্ঞানী-গুণীরা মগ্ন হলেন। এমনকি শাসকের ঔপনিবেশিক চরিত্রকে চিহ্নিত করেও সর্বহারার মতবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্কসও ভারতবর্ষে ব্রিটিশ-শাসনের প্রয়োজনীয়তাকে সমর্থন করেছিলেন। অর্থাৎ এমন কোনো জ্ঞানের সন্ধান আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা আবিষ্কার করতে পারেননি যা সমস্ত রকম কর্তৃত্ববাদ থেকে মুক্ত। এই বোধ থেকেই মানুষ অন্য দিশার সন্ধান শুরু করল এই অন্য দিশার নামই হল পোস্টমডার্নিজিম।
আবার পোস্টমডার্নিজিম নতুন একটা দিশা হলেও তা কোনো নির্দিষ্ট দিশার ভিতর নিজেকে আবদ্ধ করতে চাইল না; তা হয়ে উঠল বহুদিশাময়, বা বহুরৈখিক। আধুনিকতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলিকে সে চ্যালেঞ্জ করল। অথবা কোনো চ্যালেঞ্জ নয়, প্রতি ব্যাপারে সে স্রেফ নতুন ধারণার সন্ধান দিল, নতুন মতামত দিল। যেমন একটা ধরাবাঁধা কাঠামোর পৌনঃপুনিকতার বাইরে বেরিয়ে এসে, নিজেকে কাঠামোহীন করে মুক্ত রাখা, বা কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের উপর নির্ভরতা তৈরি না করে সবকিছুকেই খেলাচ্ছলে দেখা ও সব ব্যাপারে খেলতে খেলতে এগিয়ে যাওয়া, সেখানে লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেয়ে যাত্রার দিকেই তার নজর বেশি। আবার যুক্তির বাইরে বেরোনো, অর্থের বাইরে বেরোনো, নির্মাণ থেকে মুক্তি, ব্যাখ্যার দাবি না মানা, সিদ্ধান্ত বা মীমাংসাতে না না-পৌঁছানো বহমানতা ইত্যাদি।”
আমাদের দেশেও স্বাধীনতালাভের পরবর্তী কাল থেকেই বিশেষ কিছু চরিত্রলক্ষণ ক্রমশ স্পষ্ট রূপ ধারণ করেছে। এই সব নতুন চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন অভ্যাস বশে আমরাও এই সময়ের নামকরণ করেছি পোস্টমডার্ন কালখণ্ড যদিও সেটা সাহেবদেরই অনুকরণেস্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে এই চিহ্নগুলি একটু একটু করে দানা বেঁধে উঠছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে তারা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
এখন দেখা যাক পোস্টমডার্নিজিমের সেই সব বিশেষ চরিত্রলক্ষণগুলি কী।
একরোখা ও জেদি আধুনিকতার শেষ স্তম্ভ সামাজ্রবাদ তার রূপ পালটাচ্ছে। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে এখন আর সে সরাসরি অন্যদেশের ভূখণ্ডে আধিপত্য করতে আসছে না। রক্তারক্তি হানাহানি যুদ্ধ মৃত্যু এই চেনা চিহ্নগুলি থেকে সরে এসে তার নতুন অস্ত্র হয়ে উঠেছে পুঁজি। বিশ্বায়নের হাত ধরে সেই পুঁজি ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে একেবারে বন্ধুর ছদ্মবেশে। তার একমাত্র লক্ষ মুনাফা। সামাজ্রবাদের এই নতুন মুখোস মানুষের ভোগের বাসনাকে উসকে দিয়ে সে তাদের হাতের সামনে থরে থরে লোভনীয় ভোগ্যপণ্য সাজিয়ে রাখছ। সে জানে মানুষ তার ভোগ-পিপাসা মেটাতে এসবের দিকে আকৃষ্ট হবেই। হচ্ছেও তাই। বহুজাতিক সংস্থাগুলির মুনাফার ভাণ্ডার দিনে দিনে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। এভাবেই মানুষের মানুষ পরিচয় ঝাপসা হয়ে সে হয়ে উঠেছে একজন ক্রেতা-সাধারণ। একজন উপভোক্তা।
অন্যদিকে উচ্চ-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিপ্লব ঘটে চলেছে। প্রতিদিন উচ্চ থেকে উচ্চতর হচ্ছে প্রযুক্তির কলাকৌশল এবং ব্যাপক ও বিস্তৃত হচ্ছে তার ব্যবহারচারদিকে সবকিছুই এখন প্রযুক্তি-নির্ভর। সেসবের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছে মানুষ। মানুষের মানুষ পরিচয়টাই যেন মুছে যাবে মনে হচ্ছে। মানুষের এতদিনের চেনা সুখ ও শান্তিও আজ ভয়ংকর প্রশ্নের মুখোমুখি।
মানুষের স্বাভাবিক শান্তি বিঘ্নিত করতে আরেক দিকে মাথা চাড়া দিয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদ। এবং সেই মৌলবাদ-নির্ভর উগ্রপন্থা। অজস্র উগ্রপন্থী সংগঠন আজ তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারাও লুফে নিচ্ছে সেই উচ্চ-প্রযুক্তির ব্যবহার। বিজ্ঞান প্রযুক্ত ও ধর্মের এই অপব্যবহারে সাধারণ মানুষকে আজ গ্রাস করেছে এক চরম আতঙ্ক। মানুষ আজ ভীত সন্ত্রস্ত দিশাহীন। তারা বুঝতে পাচ্ছে না এর শেষ কোথায় ও কীভাবে।
উচ্চ-প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে এই পোস্টমডার্ন কালখণ্ডে আরেক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। সেটা বিশ্ব-যোগাযোগ ব্যাবস্থায়। কমপিউটার ইন্টারনেট সোশাল-মিডিয়া এইসবের কল্যাণে অত্যন্ত দূরের মানুষটিও আর দূরে নয়। একেবারে হাতের কাছে। ইচ্ছে করলেই তার সঙ্গে যখন তখন কথা বলা যায় আলোচনা করা যায় মত বিনিময় করা যায়। দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সমাজ কোনোকিছুই সেখানে কোনো বাধা নয়। ফলে যেমন দেশের ক্ষুদ্র বা বৃহত্তর অংশে তেমনি বিশ্বব্যাপী যে কোনো অনিয়ম বা অন্যায় অত্যাচার শোষণের বিরুদ্ধে অজস্র জনমত তৈরি হচ্ছে এবং মুহূর্তে তা পৌঁছে যাচ্ছে আরো আরো মানুষের কাছে। ছোটো বড়ো পরিসরে নানা রাজনৈতিক ও সামজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে। মানুষ সোচ্চার হচ্ছে দুর্নীতি ও স্বজন-পোষণের বিরুদ্ধে, পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে, নারী-নির্যাতন, শিশু-নির্যাতন, তথাকথিত উচ্চবর্ণের হাতে দলিত ও নিম্নবর্গীয় জনগণের নির্যাতন ও হত্যার বিরুদ্ধে। সেখানে নারীর স্বাধীনতা এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার অর্জনের বিষয়টিও এখন অন্যমাত্রা পেয়েছে। আবার এই ব্যবস্থার অপ-প্রয়োগ বা অপব্যবহারও কিছু কম হচ্ছে না। উগ্রপন্থী দুষ্কৃতি থেকে অন্যান্য অশুভ-বুদ্ধির লোকজনও যে-যতটা পারে তার থেকে সুবিধে নিতে চাইছে। সব মিলিয়ে এমন এক পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে যা আগের শতকের মানুষের অগোচরে ছিল।
এবার আসা যাক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আধুনিক পর্বে ইউরো-আমেরিকান শাসকরা চেয়েছিল তাদের অধিকৃত অন্যান্য দেশের তাবৎ সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে দলা করে মণ্ড পাকিয়ে একই ছাঁচে ঢেলে বিশ্বময় পরিবেশন করবে। এতে ওই সব দেশের মানুষদের কাছে তাদের নিজেদের অতীতকে অপ্রাসঙ্গিক করে ঝাঁ-চকচকে পশ্চিমি মডেলকে আত্মীকরণে বাধ্য করবে। এতে করে ওইসব দেশে শাসন শোষণ ও লুণ্ঠনের জন্যে বেশি করে সামরিক শক্তির প্রয়োগ দরকার পড়বে না। কারণ নিজের দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য একটা জাতির মেরুদণ্ড। তাকে যদি দুর্বল ও অকেজো করে দেওয়া হয় তাহলে সেই জাতি মেরুদণ্ডহীন পড়বে। শাসকদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। লাভ হবে শাসকদের। বিনা বাধায় তাদের কুকর্ম চালিয়ে যেতে পারবে।
পোস্টমডার্ন সময়ে এসেও এই চেষ্টার খামতি নেই। শুধু পদ্ধতির বদল হয়েছে। আগে ছিল কিছুটা অস্ত্রের ডগায় কিছুটা শিক্ষা-প্রসারের বাহানায় অন্যদেশে গিয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে গেলানো। এখন আর সেটা নেই। এখন বিদেশি পুঁজির হাত ধরে আমদানিকৃত হচ্ছে বিদেশি সংস্কৃতির হইচই। তাকে সাহায্য করছে বিশ্বায়ন ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাদের লক্ষ্য বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। তারা সেই ঔজ্জ্বল্যে মোহমুগ্ধ হচ্ছে। নাগরিক পরিসর থেকে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রাম। আর দেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে এখন লুপ্তপ্রায়।
আমার চোখে এই হল পোস্টমডার্নিজিমের প্রধান প্রধান লক্ষণ।
তবে আমার মতে আমাদের চিন্তা-চেতনায় ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া দাসত্ব ভাবের যে ঔপনিবেশিক বোঝা আজো আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি তার থেকে নিজেদের ভাবনাকে মুক্ত করাটাই আজকের ভারতবাসীর কাছে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে মুক্তচিন্তা ও যুক্তি-তর্কের ব্যাপারে প্রাচীন ভারতের যে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও পরম্পরা সেগুলিকে আরো বেশি করে চর্চা করতে হবে। 
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, আধুনিকতার সবটুকু যদি টেমস-পার থেকে এদেশে আমদানি করা হয় তাহলে পোস্টমডার্নিজিমের অনেক কিছু গঙ্গা-পার থেকেই সাহেবরা আত্মগত করেছে। যেমন প্লুরারিজিম তথা বহুরৈখিকতা। ইউরোপ আমেরিকা কখনো বৈচিত্রকে প্রশ্রয় দেয়নি। চিরকাল তারা একের উপাসক। নিজের নিজের দেশে তাদের নীতি ছিল এক রাষ্ট্র এক জাতি এক ভাষা এক সংস্কৃতি এক ধর্ম এক ধর্মগ্রন্থ আর একজনই ধর্ম-প্রচারক। সেখানে যেটুকু বিরোধিতা সবই ছলে বলে কৌশলে ধ্বংস করা হয়েছে। আধুনিকতা থেকে যে পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছিল তা তো বিবিধতাকে ধ্বংস করে। তা সমরূপতা বা অখণ্ডতা তৈরির চেষ্টা করে। এই পুঁকিবাদ অনমনীয় অসহিষ্ণু একগুঁইয়ে ও হিংস্র। তাকে প্রতিরোধ করতে হলে চাই বহুত্ববাদ।
এই জায়গা থেকে আমরা এখন যদি নিজেদের দেশের দিকে তাকাই তাহলে বুঝে নিতে অসুবিধে হবে না ভারতবর্ষ বৈচিত্রের দেশ। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বহু-ভাষা বহু-জাতি বহু মত বহু-বহু ধর্ম-বর্ণ-পোষাক। সব দিক দিয়ে প্লুরাল সোসাইটি। এই প্লুরাল সোসাইটির অন্যতম লক্ষণই হল গণ-আলোচনা ও পারস্পরিক মতবিনিময়। যা খুব খোলাখুলি এবং এবং মুক্তমনা, যার মাধ্যমে উঠে আসে নতুন নতুন উচ্চারণ নতুন ভাব নতুন পছন্দ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নতুন অভিব্যক্তি ফলে অনেক মুক্তাঞ্চলের জন্ম হয় এবং পারতপক্ষে যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার পক্ষে খুব গুরুপূর্ণ হয়ে ওঠে। আবার এই বহুরৈখিকতার অন্যতম শর্ত অপরিসীম ধৈর্য সংযম এবং পরমত সহিষ্ণুতা। ফলে সমাজে বৈরিতা বা হিংসার ঘটনা হ্রাস পায়। নিজের সম্প্রদায় বা জাতিকে বড়ো করে অন্যদের ছোটো করে দেখানোর প্রবণতা কমে। ব্যক্তি-মানুষের আচার-ব্যবহারে নম্রতা আসে, অন্যকে যথাযোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো মনোভাব উৎসাহিত হয়। চেনা-জানা তথা জ্ঞানের পরিসরও প্রসারিত হয়। ফলে তা সামাজিক প্রগতি ও সংহতির পক্ষে খুবই ইতিবাচক হয়ে ওঠেপ্রাচীন ভারতে সম্রাট অশোক এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন। পোস্টমডার্ন কালখণ্ডে সারা বিশ্বেই আজ সর্বস্তরে এই প্লুরারিজিমের দাবি খুব জোরালোভাবে উঠে আসছে।
আবার বলছি, আমাদের দেশের কথা ভাবুন। বৈচিত্রের মধ্য ঐক্য এটাই হল স্বাধীন ভারতবর্ষের  মূল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আধুনিকতাবাদী ইউরোপের অনুকরণে এদেশেও মণ্ড-পাকানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। এই কাজ যারা করছে তারা বুঝতে পারছে না তারা আসলে আধুনিকতার এঁটোকাঁটা ভক্ষণে মত্ত। সুতরাং এই সময়ে এদেশে রাজনীতি সমাজ অর্থনীতি সংস্কৃতি এই সব নানা ক্ষেত্রে যে সব সংকট দেখা দিচ্ছে যে সব চ্যালেঞ্জ উঠে আসছে সেগুলিকে ঠিকঠাক বুঝে নিয়ে তাদের সুষ্ঠ মোকাবিলা করার জন্যে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সব মানুষ প্রাচীন ভারতের সেই বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিকেই বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছেন।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ভাষা ও ধর্মের ব্যাপারে হিন্দি ও হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসী মনোভাব ক্রমশই দিকে দিকে প্রসারিত হচ্ছে ও এক অভূতপূর্ব অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। সেই আগ্রাসনে আবার সরাসরি মদত দিচ্ছে রাষ্ট্র। এখানেও এক মৌলবাদী হাওয়া ক্রমশই প্রবল হচ্ছে। আগেই বলেছি সাহেবদের একটা বিশেষ পছন্দ যে কোনো নতুন ভাবনার শেষে একটা ism সেঁটে দেওয়া সুধী পাঠক খেয়াল করলে দেখবেন সাহেব্রা এদেশে আসার আগে হিন্দুধর্ম এই নামে আমাদের কোনো ধর্ম ছিল না। ভারতীয় ধর্মমতগুলি ছিল নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত। যেমন বৌষ্ণব শাক্ত শৈব গাণপত্য সৌর বৌদ্ধ জৈন শিখ ইত্যাদি। হিন্দু একটি বিদেশি শব্দ। আমাদের প্রাচীন কোনো ধর্মীয় গ্রন্থে তার উল্লেখ পাওয়া যাবে না। সিন্ধু শব্দটি বিদেশিদের জিভে একসময় হিন্দু হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে সিন্ধু নদীর উপত্যকা অর্থাৎ একটা বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলকে এই নামে অভিহিত করা হত। পরে এই অঞ্চলে বসবাসকারী মনুষজনকে হিন্দু বলে ডাকা শুরু হল। ইংরেজরা এদেশে এসে এখানে এত সব ধর্ম সম্প্রদায় দেখে অস্বস্তি বোধ করল। কারণ ওই যে বললাম তারা ছিল একের ভক্ত। তাদের এক ধর্ম এক ঈশ্বর একজনই ধর্ম-প্রচারক। ভারতে আসার আগে তারা প্রাচ্যের যে জাতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল তা হল মুসলিম। কিন্তু ঘটনাচক্রে সাহেবদের মতো তাদেরও একটাই ধর্ম ইসলাম এবং একজন ঈশ্বর ও একজন ধর্ম-প্রচারক। সুতরাং ভারতের বহু ধর্মের ব্যাপারটা তাদের হজম হচ্ছিল না। হাতের কাছে হিন্দু শব্দটিকে পেয়ে তার পরে ওই ism বসিয়ে তারা হিন্দুইজিমের জন্ম দিল আমরাও ভারতীয় ধর্মের একটি নাম পেয়ে গেলাম হিন্দুধর্ম তার মানে যে হিন্দু শব্দটি এতদিন একটি বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চল বা সেখানে বসবাসকারী সমস্ত জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহার করা হত বিদেশি বণিকদের কূটবুদ্ধিতে তাই হয়ে গেল একটি ধর্মের নাম এর ফলে ইংরেজদের একটা বিশেষ সুবিধে হল তা হল এদেশে প্রচলিত দুটি প্রধান ধর্ম হিন্দু ও ইসলাম অনুসারীদের মধ্যে একটা বিভেদ তৈরি করা। এটিও শাসক ইংরেজদের একটি সূক্ষ্ণ কৌশল তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ সেই ভেদাভেদকে সমর্থন করে হিন্দুধর্ম এই-শব্দটিকে লুফে নিয়েছিলেন
আমরা জানি ইংরেজরা ভারতবর্ষের ধর্মীয় ভেদাভেদকে কাজে লাগিয়ে তাদের কূটবুদ্ধির প্রথম প্রয়োগ করল সিপাহি-বিদ্রোহ দমনের জন্যে তারপর চালু করল দ্বিজাতি-তত্ত্ব পরবর্তী সময়ে সেই ভেদাভেদ আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে দূষিত করল তার ফলেই হল ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ। সেখানেও থামল। আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি এই ধর্মীয় ভেদাভেদের বিষফল আজো এই উপমহাদেশের মানুষকে কতদূর হানাহানি কলহ ও বিবাদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে অথচ আমরা জানি আমাদের বাংলা-কবিতার সূচনাই হয়েছিল সাম্প্রদায়িক মানসিকতা প্রতিহত করা জন্যে স্বর্গ ও ঈশ্বরলাভের মহা-আখ্যানকে ভেঙে ফেলে সেদিন চর্যপদের সিদ্ধাই-যোগীরা জানিয়েছিলেন মহাসুখ ও সহজানন্দের কথা বলেছিলেন মনকে খ-সম অর্থাৎ আকাশের মতো উদার ও মহৎ করতে হবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব্ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে শ্রীচৈতন্যদেব জোর দিয়েছিলেন প্রেমের উপর নিজের লেখায় তিনি বলেছিলেন – “তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা /অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।অর্থাৎ একজন কীর্তনীয়ার কাজ হবে তৃণের থেকেও নম্র এবং একটি গাছের থেকেও বেশি সহনশীল হয়ে নিজের জন্য কোন রকম সম্মানের প্রত্যাশা না করে অপরকে সম্মান প্রদর্শন করা সারা ইউরোপ যখন রেনেসাঁ-তরঙ্গে উত্তাল তখন সাধারণ বাঙালির চিরপ্রিয় সেই নদের নিমাই তাঁর প্রেমধর্ম প্রচারের জন্য এক বিশাল গণ-আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন। সেটাও তো এক ইতিহাস। কেউ কেউ তো তাকে বলতে চেয়েছেন চৈতন্য-রেনেসাঁ।
এই চৈতন্যধর্মে দীক্ষিত হয়েই কবি চণ্ডীদাস জানিয়ে দিয়েছিলেন এই প্রেম আসলে মানব-প্রেম তিনি গাইলেন সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই এছাড়া মধ্যযুগের সাধক কবি নানক কবির দাদু রবিদাস বজ্জবজি সেনা মালিক মহম্মদ জায়সি এবং আরো অনেক সুফি সাধক ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও অস্থিরতার অবসান চেয়েছিলেন
কবির লিখলেন – “কবিরা খাড়া বাজার মেঁ / লিয়ে লুকাটি হাথ/ জো ঘর ফুকে অপনা/ চলে হমারে সাথমানে কবির লোতা হাতে বাজারে দাঁড়িয়ে আছে যে নিজের ঘরে আগুন লাগাতে পারবে সেই তার সঙ্গে চলুক
আজকের ভাষায় বললে আমাদের দেশের পনেরো-শো শতকের এই সাধক-কবিরা ছিলেন সমাজের সাব-অল্টার্ন শ্রেণির অংশ কবির ছিলেন জোলা বা তাঁতি দাদু ছিলেন ধূনকর, রবিদাস ছিলেন মুচি, সেনা ছিলেন একজন নাপিত তাঁরা মনে-প্রাণে চেষ্টা করেছিলেন সামাজিক ভেদাভেদের কৃত্রিম বেড়া ভেঙে ধর্ম-সমন্বয়ের তার অনেক আগে অবশ্য বুদ্ধদেবের প্রচারিত ধর্মেও কোনো জাতিভেদ রাখা হয়নি বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আরোপিত সামাজিক ভেদাভেদের গণ্ডি ভেঙে শাক্যসিংহই প্রথমে তার ধর্মের দরজা সকল শ্রেণির মানুষের জন্যে উন্মুক্ত করে দিলেন অনেক পরে শ্রীচৈতন্যদেবও তাঁর বৈষ্ণবধর্মে উঁচফু-নীচু ভদাভেদ রাখলেন না আবার মধ্যযুগের সাধক কবিরা জাতি ও ধর্মের ভেদাভেদ ঘোচানোর জন্যে একটা অভিনব পথ বেছে নিলেন তাঁরা ভগবানের শরীর থেকে নামের গন্ধ মুঝে দিলেন আরাধ্য মানুষটিকে তাঁরা কখনো বললেন দরদী কখনো সাঁই কখনো বন্ধু আবার কখনো বা শুধুই কোনো সর্বনাম যা যে কোনো মানুষেরও হতে পারে বাংলার সাঁই ফকির বাউল ভাটিয়ালি এই রকম লোকায়তিক গানেও সে রকম অজস্র প্রয়োগ দেখি যেমন লালনের গানে-“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কি রূপ/ দেখলাম না এই নজরেএই যে আরাধ্যের গায়ে কোনো নামের লেবেল না রাখা এই সাধনা বলা হয় মরমিয়া সাধনা এটি একটি অসাম্প্রদায়িক পথ
পরবর্তী সময়ে গীতাঞ্জলি পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথও সেই পথকেই অনুসরণ করলেন অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতা বজায় রইল আবার কোনো সাম্প্রদায়িক চিহ্ন থাকল না ভাবুন, পাঠক, কী অসাধারণ ছিল সেই যুক্তি ও বুদ্ধির প্রয়োগ কী অসামান্য সেই চৈতন্যের জাগরণ কতখানি বলিষ্ঠ সেই হৃদয়ের অভিব্যক্তি
আবার ধর্মীয় পরিসরে আবদ্ধ থেকেও শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মীয় বহুত্ববাদের স্বরূপকে স্বীকার করে তাকে ভক্তদের সামনে তুলে ধরতে খুব সুন্দর ভাবে বললেন – “যত মত তত পথতাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম-মহাসম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভ্রাতৃভাবের উপর জোর দিলেন সেই কুয়োর-ব্যাঙের গল্পের উদাহরণ টেনে আমেরিকাবাসীকে বললেন - হে ভ্রাতৃগণ, এইরূপ সংকীর্ণ ভাবই আমাদের মতভেদের কারণ আমি একজন হিন্দু -আমি আমার নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসিয়া আছি এবং সেটিকেই সমগ্র জগৎ বলিয়া মনে করিতেছি! খ্রিস্টধর্মাবলম্বী তাঁহার নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসিয়া আছেন এবং সেটিকেই সমত্র জগৎ মনে করিতেছেন! মুসলমানও নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসিয়া আছেন এবং সেটিকেই সমগ্র জগৎ মনে করিতেছেন! হে আমেরিকাবাসিগণ, আপনারা যে আমাদের ক্ষুদ্র জগৎগুলির বেড়া ভাঙিবার জন্য বিশেষ যত্নশীল হইয়াছেন, সেজন্য আপনাদের ধন্যবাদ দিতে হইবে আশা করি, ভবিষ্যতে ঈশ্বর আপনাদের এই মহৎ উদ্দেশ্য-সম্পাদনে সহায়তা করিবেন
এইসব তথ্য অনেকেই জানেন তবু পোস্টমডার্ন প্রসঙ্গে এসব উল্লেখ করলাম এই কারণে যে আজকের এই সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েনের সময়ে এসবই আমাদের নতুন করে ভেবে দেখতে হবে অনেকেই তা ভাবছেন তা নাহলে আজকের দিনে আমাদের অনেক সংগীত-শিল্পী কেন ঝুঁকে পড়বে সেইসব মরমিয়া গানের পুনর্নিমাণে কেনই বা বৃহত্তর লোকসমাজে সেইসব গান আজো এতখানি জনপ্রিয়তা অর্জনে সমর্থ হবে  তার মানে এখনো এই বৃহত্তর লোকসমাজে সাম্প্রদায়িক সমন্বয়ের দীর্ঘ ঐতিহ্যটি লুপ্ত হয়নি বরং প্রবলভাবে বেগবান আছে কিন্তু দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের বিষয় ওপর মহলের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ভাবে সেই সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে চাইছে
আজকের প্রজন্ম অনেকটাই বাজার পোষিত বাজার লালিত ও বাজার শাসিত বেশিরভাগ সময়েই তারা সাংস্কৃতিক পুষ্টি লাভ করছে পণ্য-সংস্কৃতির উচ্ছ্বলতা থেকে বহুজাতিক বাজার তাদের সামনে থরে থরে সাজিয়ে দিয়েছে ভোগ্যদ্রব্যের বিপুল সম্ভার মানুষের মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা লোভ লালসা ও ভোগের বাসনাকে তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলতে চাইছে বলতে চাইছে ভোগই জীবন উন্নত জীবন মানে আরো আরো বিলাসিতা কিন্তু অপরিসীম ভোগের জন্যে চাই অঢেল অর্থ সেটা কোত্থেকে আসবে ফলে অসাধু উপায়ে রোজগারের প্রবণতা বাড়ছে বাড়ছে নানাবিধ সামাজিক অপরাধ ও অপকর্ম সীমাহীন ভোগের পিছনে ছুটতে গিয়ে বহু মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে দিশাহীন হয়ে পড়ছে দেশি পাকস্থলীতে খাবার খাবার ঠিকঠাক পরিপাক হচ্ছে না বদহজম হচ্ছে
আমরা জানি পশ্চিমের মানুষের চেতনায় বস্তুবাদের প্রভাব বেশি যেখানে ভারতীয় চেতনায় আধ্যাত্মিকতা বা ভাববাদ বেশি প্রাধান্য পায় কিন্তু এই ভোগবিলাস কি সর্বগ্রাসী বাজারের হাত ধরে সত্যিই পশ্চিম থেকে আমদানি করা হয়েছে আমাদের অতীত জীবনে কি এমন বিলাস অজানা ছিল তাতো নয় সেই সুদূর প্রাচীঙ্কালে যখন উপনিষদ বলছে-“তেন ত্যাক্তেন ভূঞ্জিথা মা গৃধঃ কস্যসিদ ধনম অর্থাৎ ত্যাগের মাধ্যমে ভোগের কথা, তখন চার্বাক দর্শন বলছে - 'ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ' অর্থাৎ ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো
চতুর্দশ শতকে রচিত মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহ-এর শুরুটাই হয়েছে চার্বাক দর্শন দিয়ে এই চার্বাক দর্শন ছিল বেদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী অর্থাৎ সেখানে ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হয়েছিল তার মানে তা ছিল জড় তথা বস্তুবাদী লোকায়তিক জীবনযাপন থেকে উঠে আসা বিশ্বাসের উপর গড়ে ওঠা সাধারণ মানুষ বর্তমান জীবনযাপনের মধ্যে আনন্দ চায় সুখ চায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঈশ্বর ঈশ্বর করে হেদিয়ে মরে না চার্বাক তাই বলেছেন জীবন যখন তোমার তখন আনন্দের সঙ্গে বাঁচো মৃত্যু করাল গ্রাস কেউ এড়াতে পারে না একবার যখন আমাদের শরীরের এই কাঠামো পুড়িয়ে ফেলা হয় তখন সে আবার ফিরে আসবে কী করে চার্বাক আরো বললেন স্বর্গ বলে কিছু হয় না পরজন্ম বা আত্মারও কোনো অস্তিত্ব নেই এসব ধারণা ব্রাহ্মণ-সমাজের মানুষজনের তৈরি করা তারা মৃতদের জন্যে অনুষ্ঠানবিধি তৈরি করেছে যাতে তার থেকে কিছু রোজগার করা যায় এই চার্বাক দর্শন আবার যেমন তেমন মানুষের রচনা নয় মনে করা হয় যে এই দর্শনের প্রবক্তা স্বয়ং বৃহস্পতির
তার মানে প্রাচীন ভারতে এইসব সাহিত্যে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে পুষ্ট করা হইয়েছে ঠিকই কিন্তু তা শুধুই ঈশ্বরের প্রতি অন্ধ আনুগত্য বা সমর্পন ছিল না সেখানে নানান বিরুদ্ধ মতও ছিল ছিল নানান প্রশ্ন, বিরুদ্ধ-ম্ত তর্ক ও আলোচনা ছিল নানান সংশয় ও সন্দেহবাতিকতা বহুত্ববাদী সংস্কৃতির এটাই মজা
এই প্রশ্ন ও সংশয়ের শুরুটা হয়েছিল অবশ্য সেই ঋকবেদ থেকেই সেখানে একের পর এক শ্লোকে অজস্র দেবতার আগমনে এক সময়ে প্রশ্ন উঠে গেলকস্মৈ দেবায়”, অর্থাৎ কোন দেবতাকে কোন হবি দিয়ে পুজো করা হবে। আবার সৃষ্টি-রহস্য নিয়ে রচিত নাসদীয় সূক্তে প্রশ্ন করা হল - "... এই যে নানান সৃষ্টি তা কোথা থেকে হল, কার থেকে হল, কে সৃষ্টি করল, কী করল না, সেসব তিনিই জানেন যিনি তার প্রভুর মতো পরমধামে আছেন। অথাবা তিনিও তা না-জানতে পারেন"।(রমেশ দত্তের অনুবাদ)। তার মানে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং সৃষ্টি-রহস্য জানতে পারেন আবার নাও জানতে পারেন। এই যে অজ্ঞেয়তা, এই যে সংশয় এবং অমীমাংসা- এও তো সেই বেদেরই অংশ। ওদেশের পোস্টমডার্নিস্টরাও আজ স্বীকার করছেন সর্বকালীন সত্য বা মীমাংসিত সত্য বলে কিছু হয় না। কিছু স্বল্পকালীন সত্যের মধ্যেই আমরা বাস করি। তাঁরা জোর দিয়েছেন অনির্ণেয়তার উপর।
আমাদের দেশে বেদের পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ-দার্শনিক নাগার্জুন বললেন তাঁর শূন্যবাদের কথা। এই শূন্যতা মানে কিন্তু আভিধানিক অর্থে যেমন বোঝায় কোনোকিছুর না-থাকা, সেটা নয়। এই শূন্যতা একটি বৌদ্ধ পরিভাষা। যার অর্থ কোনো নেতিবাচক শব্দ নয়। বরং তার বিপরীত সেখানে শূন্যের অর্থ যা বর্ণনাতীত বা যা অবর্ণনীয় 
এই সময়ের পোস্টমডার্নিজিমে যেমন ডিকন্সট্রাকশন বা বিনির্মাণ একটি অতি পরিচিত শব্দ, যেটা দেরিদা ব্যবহার করেছিলেন যে-কোনো লেখনির পাঠকে বিচার-বিশ্লেষণ করার একটা বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে দেরিদা স্বয়ং বিনির্মাণের কোনো রকম সংজ্ঞা তৈরির বিরুদ্ধে ছিলেন তবে বিনির্মাণের ধারণাটা মোটামুটি এই রকম বিনির্মাণ হল যে জীবন বা পাঠ্যবস্তুতে অনবরত যে ধ্বংস সাধিত  হচ্ছে তাদের সমষ্টি আবার একই সঙ্গে তাদের প্রতিনির্মাণও এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া নিত্য বর্তমান ও সর্বত্রগামী তা সব সময় ওপেন-এন্ডেড বা খোলা-মুখ এবং অসমাপ্ত এর থেকে নির্মাণ এবং ধ্বংস এই দুই বিপরীত চরম বিন্দুর মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে অসংখ্য অনাবিষ্কৃত অনির্ণেয় এবং সদা-পরিবর্তনশীল বিন্দু রয়ে গেছে তাদের খুঁজে বের করে তুলে ধরার আরেক নামকেও আমরা বিনির্মাণ বলতে পারি আবার নিষচিত ও অনিশ্চিত এই দুই বিপরীত আপাত-চরম বিন্দুর মধ্যে প্রতি মুহূর্তে যে অজস্র অজানা সংলাপ রচিত হচ্ছে এবং তাদের অতিক্রম করে যে বিস্তর বিন্দুহীন অনাবিষ্কার তৈরি হচ্ছে, যে অসংখ্য সক্রিয় সম্ভাবনার জন্ম হচ্ছে, ব্যক্তির নিজস্ব অনুভবের ভিতর তাকে সামিল করাকেও আমরা বিনির্মাণ বলতে পারি আমাদের দেশে এই বিনির্মাণের উদাহরণ স্বরূপ আমি আমারপোস্টমডার্ন ও জয়-মা-কালী”-তে বলেছিলাম মা-কালীর রূপের কথা সেখানে পশ্চিমি গবেষকের কালীরূপের পোস্টমডার্ন ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলাম – “এলিনর ডিকেনসকে স্নগী করে মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের মারিয়ন উডম্যানের লেখা বইটির নামDancing in the flames: the dark goddess in the transformation of consciousness”প্রকাশক শাম্বালা। প্রকাশ সময় – ১৯৯৬। ২৪০ পাতার এই বইটিতে মা-কালীকে উডম্যান দেখিয়েছেন ইয়ুংয়ের মনস্তাত্ত্বিক-বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাঁকে চিহ্নিত করেছেন রূপান্তর বা পরিবর্তনের এক নিরন্তর প্তবাহ হিসেবে। তঁর সিদ্ধান্ত হল যে প্রকৃত রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন অহ্ং-এর মৃত্য সেই সঙ্গে অহংযের গায়ে যে সব ভীতি-জনিত মিথ্যা মূল্যবোধ লেপ্টে থাকে তাদের থেকে মুক্তি। মা-কালীর মূর্তি-কল্পনায় সেটাই প্রকাশিত। অন্তরাত্মার মুক্তিকামী মারিয়ান তাঁর পাঠকদের জানিয়ে দিয়েছেন কালীর রূপকে ব্যাখ্যা করার যে প্রচলিত প্রথা তা আমাদের বলে কালীর কালো বরণ একটা বৈদ্যুতিক চমকের মতো যা থেকে সৃষ্ট হচ্ছে জগতের সব কিছু, এবং যার মধ্যে তারা আবার লীন হয়ে যাচ্ছে। একটানা ঘটে চলা মহাজাগতিক ঘূর্ণির ভিতর বিরামহীন ভাবে মৃত্যুকে পান করে বেঁচে আছে জীবন, জীবনকে পান করে বেঁচে আছে মৃত্যু – এই ভ্রমাত্মক মদে মাতাল হয়ে, মা-কালী লোফালুফি করতে করতে একই সঙ্গে সৃষ্টি করছেন ও ধ্বংস করছেন। এই সামগ্রিক ভাবটিকে গ্রহণ করার অর্থ হল ভয় এবং দুর্বলতা থেকে মুক্ত হওয়া। ব্যক্তিগত ও মহাজগতিক জঙানের দরজা খুলে যাওয়া। উডম্যান মনে করেন প্রতি নিয়ত চেতনার গভীরে মানুষের এই জন্ম ও মৃত্যু আসলে এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা। আমাদের প্রকৃত সত্তাকে আমরা বরাবরই ওপর থেকে দেখি বা বিচার-বিশ্লেষণ করি। তার ভিতরে ঢোকার চেশটা করি না। উডম্যানের মতে সেখানে প্রতি নিয়ত এক ভয়ঙকর গণ্ডগোল ঘটে চলেছে। যা একই সঙ্গে বভ্রান্তিকর আবার স্বতঃস্ফূর্ত। সে এক উন্মাদের পাঠশালা। সেখানে প্রবেশ করলে আমাদের সমস্ত জানা-চেনা জগত ও অচল অটল সংস্কার লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে; আরাম নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তার সব বেড়া কর্পূরের মতো উবে যাবে। তখন মা-কালীর মতো আমাদেরও পাগল না হয়ে আর উপায় থাকবে না। সেখানে সব কিছু মুহূর্মুহূ বদলে যাচ্ছে। বন্যার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ক্ষণে ক্ষণে পুরাতন মুছে যাচ্ছে, জন্ম হচ্ছে নতুনের। নারী শক্তির সমর্থক উডম্যান সেই ঢেউয়ের ছন্দে খুঁজে পেলেন নারীত্বের আদল।
উডম্যান মা-কালীকে দেখেছেন আমাদের মতো দেবী হিসেবে নয় বরং এক অসীম শক্তির উৎস হিসেবে। সেই নারী শক্তির উপর অগাধ বিশ্বাস রেখে তাঁর বইটিতে উডম্যান নির্দ্ধিধায় জানিয়ে দিয়েছেন, মা-কালীকে আপন করে নিতে পারলে সমস্ত মায়াজগৎ টলে যাবে এবং প্রকাশ পাবে যে, সেই অবদমিত নারী-শক্তিগুলি যাদের এতদিন দুর্বল, বোকা-বোকা, এলোমেলো বা অতিমাত্রিক বলে ঠাট্টা-তামাশা করা হয়েছে, তারাই রূপান্তরের শক্তিশালী হাতা-খুন্তি-ঝাঁটা-বঁটি। মা-কালীর এই শক্তি যা একই সঙ্গে মানুষের কষ্টগুলির উপশম করে এবং তাদের ক্ষমতা বাড়ায়, তা শুধুমাত্র নারীদের জন্য নয়; সেই পুরুষদের জন্যও তা সমান কার্যকর, পুরুষতন্ত্রের আঘাতে প্রতিনিয়ত যারা নিজেরাও ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছেন। এভাবেই উডম্যান মা-কালী সম্পর্কে পশ্চিমের মানুষদের ধর্মীয়-চেতনার বিকাশের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন।”
মাননীয় পাঠক, বিনির্মাণ প্রসঙ্গে মা-কালীর রূপের উডম্যানের এই ব্যাখ্যা প্রাসঙ্গিক মনে করেই এখানে উদ্ধৃত করলাম।
তার অনেক আগে অবশ্য নাগার্জুনের মাধ্যমিককারিকাতে বলা হয়েছিল চতুষ্কোটি বিনির্মুক্তির কথাচতুষ্কোটীবিনির্মুক্ত শূন্যমেব যার মূল কথা বস্তু-সত্তার পরমার্থ রূপ হল একই সঙ্গে না সৎ, না-অসৎ, সৎ-অসৎ দুইও নয়, সৎ-অসৎ দুই নয়ও নয়। এই বিনির্মুক্তির ধারণা কিন্তু
বিনির্মাণের চেয়ে বেশি প্রশস্ত।
ভোগের প্রসঙ্গে আবার আসি বুদ্ধদেবের কথায়। আগেই বলেছি বুদ্ধদেব যে দর্শনের জন্ম দিলেন সেখানেও ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হল। বলা হল মানুষই সব। জানিয়ে দেওয়া হল একজন মানুষের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা ঘুমিয়ে আছে। একজন মানুষ ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে সেইসব সম্ভাবনাকে বিকশিত করে সেও বুদ্ধত্ব অর্জন করতে সক্ষম হবে। ভোগ ও ত্যাগের ব্যাপারে তথাগতের অবস্থান হল মাঝামাঝি। তাঁর সেই পথকে বলা হল মধ্যম-পন্থা। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পথ আজো বেশি জনপ্রিয়।
বুদ্ধদেব আবার জানিয়ে দিয়েছেন মানুষের জীবনে দুঃখ বলে কিছু হয় না, যেটা  আসে তা আসলে অতৃপ্তি। সুতরাং একজন মানুষকেই ঠিক করতে হবে নিজের সাধ ও সাধ্যের অঙ্ক অথবা রসায়ন কী হবে আমাদের নোবেলজয়ী অরত্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তো আবার তাঁর নতুন তত্ত্বে জানিয়ে দিয়েছেন আমাদের জীবনযাত্রার মান, সম্পদের ভিত্তিতে না হয়ে স্ব-ক্ষমতার ভিত্তিতে হওয়া দরকার। “তর্কপ্রিয় ভারতীয়”-তে তিনি বলেছেন –“আমরা যদি দীর্ঘায়ু হওয়ার ও ভালোভাবে বাঁচার স্বাধীনতা নিয়ে ভাবি তা হলে আমাদের দৃষ্টিকে সরাসরি জীবন ও মৃত্যুর উপর কেন্দ্রীভূত করতে হবে, শুধুমাত্র ধনসম্পদ ও আর্থিক প্রাচুর্যের উপর নয়।” অর্থাৎ মোদ্দা কথা আয় বুঝে ব্যয় করো। ভালোভাবে বাঁচার চিন্তা করো।
অমর্ত্য সেন তাঁর বইয়ে আরো লিখেছেন –“নির্বাচন ও ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতাকে অনেকটা ছাড়িয়ে গিয়ে গণতন্ত্রের একটি ব্যাপকতর ধারণা খুবই শক্তিশালী ভাবে উঠে এসেছে। শুধুমাত্র সমকালীন রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রটিতে নয়, অর্থনৈতিক যুক্তি ধারার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জ্ঞানচর্চার নতুন শাখা, ‘সামাজিক চয়ন’ তত্ত্ব ও ‘গণচয়ন’ তত্ত্বের ক্ষেত্রেও এটি ভালোভাবে উঠে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে খোলাখুলি আলোচনা, সমাজ ও আমাদের নিজ নিজ পছন্দ সম্পর্কিত তথ্যকে বিপুল ভাবে বাড়িয়ে তুলতে হবে।”
স্পষ্টতই অমর্ত্য সেন যে-কোনো রাজনীতি অর্থনীতি সামজিক অনিয়ম দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আম-জনতার গণ-অংশগ্রহণের ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। জোর দিয়েছেন আজকের জাগ্রত সোশাল মিডিয়ায় মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে তুলে ধরার উপরকারণ এখন সবার উপরে সোশ্যাল মিডিয়া সত্য, তাহার উপরে নাই।
এই সোশাল মিডিয়ার সৌজন্যেই এখন একটি নতুন ভাবনা উঠে এসেছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে পোস্ট-ট্রুথ। এটিও একটি নবগঠিত ইংরেজি শব্দ এই শব্দটিকে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড অভিধান কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালে বর্ষসেরা শব্দ ঘোষণা দিয়েছে যেমন ১৯১৩ সালে করা হয়েছিলসেলফি’-শব্দটিকে তাদের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অক্সফোর্ড অভিধান কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে অনেক আলোচনা বিতর্ক এবং গবেষণার পর তারা এই নির্বাচন করেছে এ ব্যাপারে অক্সফোর্ড অভিধান কর্তৃপক্ষ  যে মতামত রেখেছেন মোটামুটি তা হল এই রকম এই শব্দটি একটি বিশেষণ যার দ্বারা এমন একটা পরিস্থিতিকে বোঝানো হয় যেখানে জনমত গড়ে তোলার পক্ষে নৈর্ব্যক্তিক ঘটনাগুলি কম প্রভাব-বিস্তার করতে পারে, তার বদলে আবেগ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কাছে আবেদনের ব্যাপারটাই বড়ো হয়ে ওঠে। পোস্ট-ট্রুথ এই ধারণাটি বিগত কিছুদিন ধরে চালু আছে। এটি প্রথমবার ব্যবহার করেছিলেন স্টিভ টিসিক নামের একজন সার্বিয়ান-আমেরিকান নাট্যকার। ১৯৯২ সালে নেশন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর এক রচনায়। প্রতিপাদ্য ছিল রেগন প্রশাসনের সময়ের ইরান/কন্ট্রা স্ক্যান্ডাল ও পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ। যেখানে রেগন আঁচ করতে পেরেছিল মানুষ প্রকৃত সত্য জানতে চায় না। যে কারণে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিথ্যা বলেছিল এবং সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করেছিল। টিসিকের মন্তব্য ছিল সমস্ত স্বৈরাচারী শাসকই সত্যাকে ধামাচাপা দিতে চায়। এতদিন শব্দটির ব্যবহার সীমিত থাকলেও এ বছর যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয়ন ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার বিষয়ে গণভোট(রেক্সিট) এবং আমেরিকান যুক্ত-রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে যেসব ঘটনাবলি ঘটে চলেছে তাতে পোস্ট-ট্রুথ শব্দটি এত বেশি বার ব্যবহৃত হচ্ছে। যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। শব্দটি এখন বিশেষ্যর রূপ ধারণ করে পলিটিক্স-এর আগে বসে পোস্ট-ট্রুথ পলিটিক্স এই শব্দ-বন্ধটি তৈরি করেছে। অর্থাৎ শব্দটি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। অন্য কোনো সংজ্ঞা ছাড়াই এটি এখন নানা লেখার শিরোনাম হচ্ছে।    
পোস্ট-ট্রুথ শব্দের বাংলা মানে দাঁড়ায় সত্যকে ছাড়িয়ে বা ছাপিয়ে যাওয়া বোঝাই যাচ্ছে এটি একটি নতুন ধারণা সত্যকে অতিক্রম করে যাওয়া মানে কি আরো বেশি সত্যের দিকে যাওয়া না কোনো অসত্যকে আঁকড়ে ধরা যদি বেশি সত্য হয় তা হলে তার রূপ কেমন হবে সে প্রশ্ন উঠবেই দেখা গেল ইদানীংকালে এ ব্যাপারে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে আরো দেখা যাচ্ছে পোস্ট-ট্রুথের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেই ব্যক্তি-মানুষের ভূমিকা তার আবেগ তার বিশ্বাস কারণ কিছু পরিস্থিতি বা ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত তথ্যের থেকেও মানুষের মতামতকে নির্মাণ করছে এই ব্যক্তিগত আবেগ কিংবা ব্যক্তিগত বিশ্বাস তার মানে সেখানে প্রকৃত সত্য আর কোনো অর্থ বহন করছে না আবার উইকিপিডিয়া বলছে পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকসমানে হচ্ছে পোস্ট-ফেকচুয়াল পলিটিক্স অর্থাৎ তা এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেখানে প্রকৃত ঘটনার উপর কোনো সুষ্ঠ বিতর্ক নয় বরং মানুষের আবেগের জায়গাটাই মুখ্য মানে ‘জনগণ চিছে’ এই গোছের। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে তা সত্যের অপলাপও হতে পারে। মানে কাকে কান নিয়ে গেছে বললে কানে হাত না বুলিয়ে পরখ না করে কাকের পিছনে ছোটা।
আমাদের সমাজেও এই রকম ফেক নিউজ আছে। অনেক আগে থেকেই আছে। তার তীব্র ফলাফলও আছে। যেমন চোর সন্দেহে পিটিয়ে খুন। সে চোর হতে পারে না হতেও পারে। আবার ডাইনি সন্দেহে খুন। এটা একটা পরিপূর্ণ সামাজিক কুসংস্কার। আবার ছেলে ধরার গুজব। কাউকে ধরে গণধোলাই। একটা সময়ে তো কোনো ঠাকুর বা দেবীর পুজো করুন, করলে এই সুফল না করলে এইসব সর্বনাশ এই রকম পোস্টকার্ড পাঠনোর বা হ্যান্ডবিল ছাপানোর হিড়িক ছিল। ইদানীং কালে দেখা যাচ্ছে মোবাইলের এসএমএসে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ট্যুইটারে ছোটো বড়ো এমন সব মেসেজ স্প্যাম আকারে প্রচারিত হচ্ছে সঙ্গে পড়া ও শেয়ার করার অনুরোধ, যার মধ্যে সত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। এই সবই বিশেষ উদ্দেশ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে প্রচারিত হতো বা হচ্ছে। কিন্তু এই আলোচনায় প্রসঙ্গটি উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে এ দেশিয় প্রেক্ষাপট। চারপাশে চেনা-জানা জগতের দিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি প্রিন্টেড বৌদ্যুতিন এবং সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে কী পরিমাণে ফেক-নিউজ পেড-নিউজ এইসব প্রচার করা হচ্ছে। এক দিকে কত মিথ্যাকথা, ভণ্ডামি, অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে ভুল পরিসংখ্যান, বিকৃত তথ্য, মনগড়া ইতিহাস এইসব তুলে ধরা হচ্ছে এমন ভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন মিথ্যাটাকেই মনে হয় সত্য। অন্যদিকে সত্য সংবাদকে চেপে যাওয়া হচ্ছে। পাবলিকের একটা বড় অংশ সেগুলি বিশ্বাস করছে এবং শেয়ার করছে আবার আর একটি অংশ বিশ্বাস করছে না, শেয়ারও করছে না, বিরক্ত হচ্ছে একটা সময় ছাপা অক্ষরকে অনেক মানুষ বেদবাক্য বলে মনে করত এখন সেই জায়গা নিয়েছে সোশাল মিডিয়ার এইসব পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কোনও তথ্য শেয়ার করলে তার সোর্স কী জানানোর কোনও দায় থাকে না
পোস্ট-ট্রুথ নিয়ে বিস্তৃত বলার সুযোগ এখানে নেই যেটুকু বললাম তা ব্যাপারটা পাঠকদের কাছে কিছুটা খোলসা করার জন্য আর এত সব কথা বলার কারণ এই পোস্ট-ট্রুথের ফলাফল কী ভয়াবহ হতে পারে তা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বাদুড়িয়ার ঘটনা প্রমাণ করল সেখানে যে দাঙ্গাটা হয়ে গেল তার পিছনে কী গভীর ষড়যন্ত্র ছিল তা আমরা জানতে পারছি দেখলাম কতদূর শয়তামি করে একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের নেত্রীরা 2002 সালে গুজরাট-দাঙ্গার একটা পুরোনো ছবি, আর একটি ভোজপুরী ছবির একটি নারী- নির্যাতনের দৃশ্যকে এই রাজ্যে হিন্দুপীড়নের ছবি বলে দিব্যি চালিয়ে দিলেন পোস্ট করলেন ফেসবুকে মুহূর্তে তা অজস্র শেয়ার হয়ে গেলতার পরের ঘটনা তো আমাদের জানা আবার উলটো ঘটনাও আছে একটি পোস্টে দেখা গেল সেই দলের এক মুখ্যমন্ত্রী একটি গাই-গোরুর পিছনে মুখ ঠেকিয়ে আঁচলা করে গোমূত্র পান করছে সেছবিও অনেকে শেয়ার করলেন পরে অন্য একজন অন্য একটি ছবি পোস্ট করলেন  তাতে জানা গেল আগের ছবিটি ফেক ওটা আসলে সেই মুখ্যমন্ত্রীর একটি টিউবোয়েলে ঝুঁকে পড়ে জলপানের ছবি বোঝা গেল, ফটোশপে এডিট করে এই কাণ্ড ঘটানো হয়েছে এটাও পোস্ট-ট্রুথ উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে যে সত্যকে নির্মাণ করা হচ্ছে তা আসলে স্ররবৈব মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়
এইভাবে খুব পরিকল্পিত ভাবে আমাদের চারপাশেও একটা অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। সুতরাং আমাদেরও সতর্ক হতে হবে। কারণ এ এক নতুন উপদ্রব। যার সম্পর্কে আমাদের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। তাই যে কোনো সংবাদের সত্যতা যাচাই করতে হবে। সোর্স জানতে হবে। এই ধরণের যে কোনো পোস্ট হুটহাট শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পারলে আসল সত্য বা প্রকৃত ঘটনাকে তুলে ধরার উদ্যোগ নিতে হবে। পালটা যুক্তি সাজাতে হবে। সঠিক পরিসংখ্যান দিতে হবে। নিজের বিচার-বিবেচনা সতেজ রেখে দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য পালন করতে হবে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনও মনে করেন - ‘‘কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াকে সোশ্যাল মিডিয়া দিয়েই প্রতিহত করতে হয়।’’ আশার কথা এই দায়িত্ব পালনে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পালটা প্রচার হয়েছে। জনমত সংগঠিত হয়েছে। তার মানে বিপদটা অনেকেই বুঝতে পেরেছে।
মাননীয় পাঠক, একবার ভেবে দেখুন। এইভাবে সত্য যদি গড়াপেটা হয়, বানানো হয়, নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে মানুষের নৈতিকতা বা মূল্যবোধে তো শৃঙ্খলা বলে আর কিছু থাকবে না। সব ছত্রখান হবে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। যদিও পোস্টট্রুথ শব্দটি এখন পলিটিক্যাল পরিসরে ব্যবহার  হচ্ছে। ক্রমে তা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়বে। পড়ছেও। ইতিহাসের পাঠ বদল করা হচ্ছে। রামায়ণের বয়ান বদলের চেষ্টা শুরু হয়েছে। এবং তা করা হচ্ছে একটা বিশেষ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্যে।
পোস্টমডার্ন থেকে পোস্ট-ট্রুথ। এই শতকের বদলে যাওয়া সময়ের ঘটনাবলির কিছু উল্লেখ ও ব্যাখ্যা এতক্ষণ আমার নিজের মতো করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে পাঠকের সামনে হাজির করার চেষ্টা করলাম। বাকি রয়ে গেল আরেকটি বিষয় - মানুষ+। যেটা এই লেখার শিরোনামের শেষ অংশ। এটি একটি নতুন শব্দ। এই লেখায় আম্নি প্রথম ব্যাবহার করলাম। সুতরাং এ-সম্পর্কে কিছু বলার দায়টা আমাকেই নিতে হয়। কোনো রকম জটিলতা না-রেখে প্রথমেই বলে নিই মানুষ+ বলতে আমি এখানে পজিটিভ মানুষকেই বোঝাতে চাইছি। আসলে প্রথমে ভেবেছিলাম পোস্টমড়ার্ন ও পোস্ট-ট্রুথ নিয়েই লিখব। কিন্তু তাদের নিয়ে ভাবতে ভাবতে ও লিখতে লিখতে অন্য রকম আরো অনেক চিন্তা মাথায় আসছিল। যেমন পোস্টমডার্ন সময়ের বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে লিখতে গিয়ে যেমন উঠে এল হাই-টেকনোলজি বা উচ্চ-প্রযুক্তির রমরমার কথা যেখানে সাধারণ মানুষের ভূমিকা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। আবার পাশাপাশি ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্রপন্থার ক্রমাগত রণ-হুংকার। সেখানেও সাধারণ মানুষ গৌণ। কী ভয়ানক বৈপরীত্য তাই না। একদিকে উচ্চ-প্রযুক্তি অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রপন্থা একটা সভ্য পৃথিবীতে দুই চরম বিপরীতের সহাবস্থান। যার মাঝে পড়ে হাঁসফাঁস করছে মানবিকতা। তাদের সঙ্গে আরেক শক্তি যুক্ত হয়েছে। তা হল ভোগ-নির্ভর বাজার তথা পণ্য-সংস্কৃতি- সেখানেও মানুষ আর মানুষ নয়, একজন ক্রেতা-সাধারণ বা উপভোক্তা মাত্র। অর্থাৎ মানুষের মানবিক-সত্তার উপর ত্রিমুখী আক্রমণ। তার উপর আবার সাম্প্রতিক উপদ্রব হিসেবে মাথা তুলছে ওই পোস্ট-ট্রুথ। এই অবস্থায় মানুষের কী হবে, মানবিকতার ভবিষ্যৎ কী হবে – সভ্যতার অগ্রগতিতে তার ভূমিকা কি ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। এটা অবশ্যই একটা বড়ো প্রশ্ন। ভাবতে হবে। আরো বেশি করে ভাবতে হবে।
এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে মানুষ+, বা পজিটিভ মানুষের ভাবনা। অস্তিত্বের সংকট যত ঘনীভূত হবে তার মোকাবিলা করার জন্য মানুষকে তত বেশি বিকশিত করতে হবে তার ইতিবাচক দিকগুলি। সেটা করতে হবে খুব সংগঠিত ভাবে এবং ধারাবাহিক পদ্ধতিতে। আবার শুধু বিকশিত করলে হবে না জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োগ করতে হবে। আমরা এতদিন মানব-সম্পদের উন্নয়ন ও বিকাশের কথা অনেক শুনলাম তার পক্ষে নানান পরিকল্পনা ও কাজও হচ্ছে। আমার মনে হয় এবার সময় এসেছে তার প্রয়োগের দিকটিতে নজর দেবার এবং তাকে ব্যাপক ভাবে রূপায়িত করার। কারণ এখন সব জ্ঞানই প্রয়োগ নির্ভর। ফলিত। সে জন্যেই নানা ক্ষেত্রে নিত্য নতুন টেকনোলজির আগমন ঘটছে। তাহলে এবার হিউম্যান-টেকনোলজির কথা ভাবা হবে না কেন।
আমরা জানি প্রতিটি মানুষই অজস্র সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেকিন্তু নানান পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য পরিস্থিতির কোপে সেই সম্ভাবনাগুলি ক্রমাগত কচুকাটা হতে থাকে। এক সময় দেখা যায় এক এক জন মানুষ নিজের মতো করে বেঁচে থাকার জন্যে নিজেকে এক একটা ফ্রেমে আটকে ফেলেছে। এক একটা সেফটি জোনে। তার বেশি সে ভাবতে চায় না, তাই ভাবতে পারে না। কারণ এই ফ্রেম তথা সেফটি জোন থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। সাহস সঞ্চয় করতে হয়। তাই দেখা যায় তাদের মধ্যেই যার সাহস বেশি, যে একটু বেশি এগিয়ে যেতে চায় তার ফ্রেমটা হয়ত কিছু বড়ো আর যার মনে নেতিবাচক ভাবনার উপাদান তুলনায় বেশি তার ফ্রেমটা ছোটো থেকে ক্রমশই আরো ছোটো। ডাউন-সাইজড হয়ে যায়। সুতরাং একজন মানুষের কাছে নিজেকে উন্নত ও বিকশিত করা মানে তার ভেতরে সুপ্ত থাকা নানা সম্ভাবনার বিকাশ। তাদের আবিষ্কার করা, ঘষে-মেজে আরো চকচকে ও তীক্ষ্ণ করা, তাদের প্রয়োগ করা। তাদের সাফল্য ও অসাফল্যকে সমান ভাবে উপভোগ করা। এসবই একজন পজিটিভ মানুষের রোজকার রুটিন কাজ হতে পারে।
আসলে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় আমরা তো দেখি আমাদের মধ্যে নানান সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষত্রে যে নানান শক্তি কাজ করে তাদের দুই দলে ভাগ করা যায়। একদল যদি আমাদের মনকে উৎসাহিত করে, সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় তো অন্য দল নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমাদের পিছন থেকে টেনে ধরতে চায়। প্রথম দলটিকে আমরা পজিটিভ শক্তি বলে জানি। আর দ্বিতীয় দলটিকে নেগেটিভ। বোঝাই যাচ্ছে একজন পজিটিভ মানুষের কাজ মনের ভেতরের এই পজিটিভ ফোর্সকে আরো শক্তিশালী করা এবং নেতিবাদগুলিকে না করা। সেই অনুযায়ী কাজ করা। এ কাজ অবশ্য রাতারাতি করা যায় না। নিজের ইচ্ছে ও চেষ্টাকে অদম্য করতে পারলে প্রতিদিন একটু এওকটু করে নিজেকে বদলে ফেলা যায়। অবশ্যই সেটা আরো বেশি পজিটিভ মানুষ হবার পক্ষে।
এই কাজ করার জন্যে নিজেকে সব সময় স্পিরিটেড রাখতে হবে। মোটিভেটেড ও ইন্সপিরেটেড রাখতে হবে। নিজেকে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত রাখার জন্য কিছু পড়াশোনা করা দরকার। এই বিষয়ের উপর বাজারে ভালো ভালো বইয়ের অপ্রতুলতা নেই। আর ছাড়া মনীষীদের জীবনীগ্রন্থ আছে। তাদের বানী ও উপদেশ আছে। সেসব থেকেও অনেক শিক্ষা নিতে পারি। কারণ এটা প্রমাণিত আমাদের মনীষীরা এক একজন পজিটিভ মানুষ। আছাড়া আরো অনেক ভালো বই পড়া, ভালো গান শোনা। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত যা মনকে চাপমুক্ত করতে পারে। তার উপর কিছু শারীরিক ব্যায়াম, পরিমিত আহার এসব তো আছেই। মনে রাখতে নিজেকে একজন পজিটিভ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা কিন্তু একজন ব্যক্তি-মানুষের যুদ্ধ। আর যত দিন যাবে, সময় বদলাবে, এই ব্যক্তি-মানুষের আবেগ বিশ্বাস মতামত কাজকর্ম এসবই কিন্তু আরো বেশি গুরুপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ প্রযুক্তি যতই উচ্চতর হোক, উগ্রপন্থা যতই ভয়াবহ হোক, বাজার যতই শক্তিশালী হোক কিংবা সত্যকে যতই গড়াপেটা করার চেষ্টা হোক, মানুষ কিন্তু একদিন সবকিছুকেই অতিক্রম করতে পারবে। সে ক্ষমতা মানুষের আছে। শুধু দরকার এই এগিয়ে চলার কাজে আমদের প্রত্যেকের সচেতন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ।
এতক্ষণ আমি আমার কথা বললাম। এবার ব্যাপারগুলি নিয়ে পাঠক যে-যার নিজের মতো করে ভাবুন। নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজের নিজের অভিমত তৈরি করুন। সেই মতামত প্রকাশে সোশাল-মিডিয়াকে আরো বেশি ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। মনে করুন অকুপাই ওয়াল-স্ট্রিট আন্দোলন, শাহবাগ-আন্দোলন, হোক-কলরব, দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ড বা আমাদের কামদুনি গণ-ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে, এই সোশাল-মিডিয়াকে ব্যবহার করে সেখানে কী বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে। শাসক ও রাষ্ট্রও তাতে কতখানি ভয় পেয়েছে। সুতরাং কালের অখণ্ড প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিন্তার প্রবাহও চলুক। কথার প্রবাহ চলুক। আরো বেশি মানুষ আরো বেশি করে কথা বলুক। জীবনের নানা পরিসরে আরো আরো নতুন সংলাপ তৈরি হোক। মানুষ আরো বেশি পজিটিভ মানুষ হোক।