পাঁচের-দশক ছয়ের-দশক সাতের-দশক আটের-দশক এমনকি বহু-ঢক্কা-নিনাদিত নয়ের-দশক
পর্যন্ত এই নতুন শতকে এসে ক্রমশই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তবু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে
প্রতিদিন বাংলা ভাষায় বিস্তর কবিতার জন্ম হচ্ছে। ছোটো-বড়ো ভালো-মন্দ অজস্র কবিতা। তাদের
নানান স্ফূর্তি নানা মেজাজ নানান চলন-বলন-কথন ছড়িয়ে পড়ছে নানান দিশায়। অহরহ সোশাল
মিডিয়ার পাতায় পাতায় আছড়ে পড়ছে নতুন কবিতার ঢেউ। যেন এক মহা-বিস্ফোরণ। যেন এক
মহোৎসবে মাতোয়ারা কবিতাপ্রেমী নতুন প্রজন্ম। দরকার শুধু একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট
কানেকশন। ব্যাস স্ক্রিনে জায়গা মতো টাচ করলেই কত ব্লগ, কত ওয়েব্জিন, ফেসবুক, ট্যুইটার,
হোয়াটসঅ্যাপ। মাথায় দু-চার
লাইন পাক মারছে, কি-প্যাডটাকে বশ করে একটু টেপাটিপি করে নামিয়ে দাও। পোস্ট করো।
ব্যাস, ইচ্ছে থাকলে কবিতা লেখা কে আটকায়।
যেমন আটকানো যায় না সেলফি তোলা ও পোস্ট করা।
কবিতা ও সেলফি। একাকার। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় দেখ। আসলে গোটা
সেলফি-প্রজন্মই বলছে আমাকে দেখো। এ যেন এক নার্সিসাস-প্রজন্ম। নিজের রূপে নিজেই
বিভোর।
আবার দিনে দিনে দিগ-দিগন্তে প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের
সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তথাকথিত পেটমোটা-থানইঁট-সদৃশ
লিটিল-ম্যাগাজিন-প্রসবকারী শুদ্ধতাবাদীরা এবং বড়োপক্ষের বড়োবাবুদের কেউ কেউ বিরক্ত
হচ্ছেন বটে। প্রশ্ন করছেন, এত কবি কেন। এত কবিতা কেন। কী হবে
এই সব ছাইপাঁশ লিখে। আলোচনা হচ্ছে। সমালোচনা হচ্ছে। কেউ পক্ষে, কেউ বা বিপক্ষে।
নানা মতামত উঠে আসছে। তাতে কিন্তু কবিয়া-লিখিয়ে জনগণের কিছু যাচ্ছে-আসছে না। কবিতা
লেখায় কোথাও কোনো ভাটা পড়ছে না। ঝাঁক ঝাঁক নতুন ছেলেমেয়েদের মাঝে শিং-ভেঙে অনেক প্রবীনও
ঢুকে পড়ছেন সেই মোচ্ছোবে। ভাগ্যে কবিতায়
কোনো জন্ম-নিয়ন্ত্রণ
চালু হয়নি। তবে স্বঘোষিত নিয়ন্ত্রক কিছু আছেন।তারা বলছেন এসব করে বাংলা কবিতা এক
ইঞ্চিও এগোবে না। তারা অবশ্য নিজেদের বিশ্বাস থেকেই তা বলছেন। যদিও সেই বিশ্বাস
মান্ধাতার বাপের আমলের। তামাদি হয়ে যাওয়া ছেঁড়া তমসুক। অনড় গোঁড়ামি ও প্রথাবদ্ধ
সংস্কারের নাগপাশে আবব্ধ হয়ে গিয়ে কেউ যদি মনের উদারতা হারিয়ে ফেলেন নতুনকে
স্বীকার করার মানসিকতা নষ্ট করেন তাহলে তাকেও তো শেষ পর্যন্ত সেই গুহাবাসী মানুষেই
পর্যবসিত হন। সুতরাং যতই অসহ্য মনে হোক যতই অশুচি অশ্লীল বা অপবিত্র লাগুক বদলকে ঠেকিয়ে
রাখা যাবে না। নতুন নিজেই তার আত্মপ্রকাশের রাস্তা খুঁজে নেবে।
আবার যারা বলছেন না না, এত নতুন নতুন ছেলেমেয়ে তারা চুরি করছে না, ডাকাতি
করছে না, খুন-রাহাজানি করছে না। শুধু তো কবিতা লিখছে, এতে আপত্তি কোথাও। তারাও
বলছেন নিজেদের বিশ্বাস থেকে। সেই বিশ্বাস আবার তৈরি হচ্ছে চারপাশে ঘনিয়ে ওঠা সামাজিক
রাজনৈতিক সামাজিক হিংসা দলাদলি উগ্রপন্থা হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতেই।
একথা ঠিক, কোনো কবিতা হয়ত কেউই পড়ছে না। কোনো কবিতা দু-দশ জন অন্তরঙ্গ
বন্ধু-বান্ধব আত্মীস্বজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আবার কোনো কোনো কবিতা প্রচুর লাইক পাচ্ছে।
কমেন্ট পাচ্ছে। হয় ধারে অথবা ভারে। সব মিলিয়ে আসর এক্কেরে জমজমাট।
এসব কিছু নিয়ে নানান আলোচনাও হচ্ছে। তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। ভদ্রতা-শালীনতার
সীমা টপকে কাদা-ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। ব্যক্তি-আক্রমণ হচ্ছে। এই বিতর্ক এই হইচই এই
কর্তৃত্ববাদ ও দখলদারি জাহির করার লড়াই নতুন সময়ের নতুন সংলাপ। এসব তো শেষ হবার
নয়। চলতেই থাকবে। তা চলুক না। তৈরি হোক আরো নতুন নতুন আলাপ ও সংলাপ। এই সুযোগে আমি
বরং একটু অন্য কথা বলি।
এত ছেলেমেয়ে যে কবিতা লিখছে লেখার মান যেমনই হোক না কেন তারা তো কবিতাই
লিখছে। তাদের নিশ্চয় অজানা নয় যে কবিতা লেখা পারফর্মিং-আর্ট নয়, ক্রিয়েটিভ-আর্ট।
তার মানে তারা কবিতা লিখে আনন্দ পাচ্ছে, লেখাটাকে উপভোগ করছে, কবিতাকে ভালোবাসছে। তা না হলে এত কাজ থাকতে তারা কবিতা লিখতে আসছে
কেন। তাহলে তাদের কবিতা নিয়ে এত লোকের এত যে হইচই এত মাথাব্যাথা এত টিকিদাড়ি নাড়ানো;
এসব কেন। তাদের লেখালিখির পক্ষে বা বিপক্ষে এত হ্যাঁ-না তাই বা কেন। কী এমন
প্রাণশক্তি আছে কবি ও কবিতার মধ্যে যা এই উচ্চ-প্রযুক্তির মহাবিস্ফোরণের যুগে এই
ভোগ-উপভোগ ও বিনোদনের এক লক্ষ উপাদানকে বুড়ো-আঙুল দেখিয়ে এখনো এত মানুষের এত
বি্দগ্ধ ও বিচক্ষণ মানুষের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। কী ও কেমন সেই জাদুমন্ত্র।
এসব নিয়ে তাহলে কিছু আলোচনা হয়ে যাক। আমি আমার মতো করে আমার ভাবনার কথা
ব্যক্ত করি। পাঠকও ভাবতে থাকুন নিজেদের মতো করে।
কবিতা কী বা কেন এ নিয়ে নানা মতবাদ নানা তত্ত্ব নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ
লেখা হয়ে গেছে। সে সব উল্লেখ করে পাতার পর পাতা ভরিয়ে তোলা যায়। সে প্রসঙ্গে
যাচ্ছি না।
আপাতত নিজের কথা বলি। আমার মনে হয় কবিতা মানে এক প্রাণ-শক্তির উপাসনা।
যে দাঁড়িয়ে থাকে ভাষার উপর। ভাষা মানে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। কয়েক হাজার
বছর ধরে যা বিকশিত হয়ে চলেছে। তাকে কত বাঁক-বদল কত ভাঙাগড়া অতিক্রম করতে হয়েছে।
এখনো হচ্ছে। বহমান নদীর মতো তার গতি তো থেমে থাকে না।
কবিতাও তাই। মানুষে মানুষে যোগাযোগের বাহন। যুগে যুগে তারো নানান হয়ে
ওঠা আছে।কাল থেকে কালান্তরে তাকেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হয়েছে। নিজেকে বদলে নিতে
হয়েছে। অতিক্রম করতে হয়েছে বহু ক্রোশ ক্রমবিকাশের পথ।
এখন একজন মানুষ যখন কবিতার নামে কিছু লিখতে চাইছেন তার মানে তাঁর মন
নিজের অন্তর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের জগতে নিজেকে প্রকাশ করছে চাইছে। সেই প্রকাশের
ক্ষেত্র হিসেবে কিছু না কিছু ভেবেই তিনি কবিতাকেই পছন্দ করেছেন। অর্থাৎ তার ভেতরে একটা তাগিদ আছে। একটা গরজের
ধাক্কা আছে।
প্রথমেই বোঝা দরকার সেই ধাক্কাগুলি কী। এবং কেন।
প্রাকৃতিক কারণেই প্রতিটি মানুষের মধ্যেই যে চাহিদাটি সুপ্ত থাকে তা
হল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দেহ ও মনের প্রয়োজনীয় বৃদ্ধি ও বিকাশ। তার জন্য নিজেকে জানতে
হয়। আমাদের প্রাচীন ঋষিরা বলতেন আত্মাং
বিদ্ধি। সক্রেটিস বলেছিলেন নো দাই-সেলফ।
আমরা অনেকেই কম-বেশি জানি যে, যে-কোনো কাজ করার পিছনে মানুষের
মনের মধ্যে নানা সময়ে যে গরজগুলি জন্ম নেয় তা নিয়ে স্বনামধন্য মনোবিজ্ঞানী আব্রাহম
মাসলোর একটি তত্ত্ব আছে। যার নাম Maslow’s hierarchy of needs । যদিও তার বিপক্ষেও কিছু জোরালো সওয়াল আছে তবু
একবার সেই তত্ত্বের সারাংশটা দেখে নেওয়া যেতে পারে।
এই তত্ত্ব অনুসারে মানুষের চাহিদাগুলিকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে।
যাদের একসঙ্গে সাজালে একটি পিরামিডের আকার ধারণ করে, পিরামিডটির নাম মাসলোর
পিরামিড। পিরামিডের একেবারে নীচের ধাপে আছে মানুষের
শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলি। যেমন নিশ্বাস নেওয়া থেকে খিদে-তেষ্টা মেটানো,
মাথা-গোঁজার আশ্রয়, যৌন-খিদে মেটানো, ঘুম অর্থাৎ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-যৌনতা এইসব
জৈবিক চাহিদাগুলি (Biological and Physiological needs)। পরের ধাপটির নাম সুরক্ষা ও নিরাপত্তার চাহিদা
(Safety needs)। সেখানে
রাখা হয়েছে শৃঙ্খলাপরায়ণতা রীতি-নীতি, স্থায়িত্ব, নানান ভয়-ভীতি থেকে মুক্তি রোগ-ব্যাধি
থেকে মুক্তি এইসব ব্যাপারগুলি। তৃতীয় ধাপে উঠে এসেছে প্রেম-বন্ধুত্ব-আত্মীয়তা-বিশ্বাস-স্বীকৃতি-প্রশংসা
স্নেহ-ভালোবাসার বিনিময়-একজোট হয়ে কাজ করা বা দলবদ্ধতা এইসব সামাজিক চাহিদা (Love
and belongingness needs)। পরের
স্তরে অর্থাৎ চতুর্থ ধাপে আছে শ্রদ্ধা-সম্মান-সফলতা-কর্তৃত্ব-খবরদারি-স্বাধীনতা-পদমর্যাদা-আভিজাত্য
এইসব আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা্র চাহিদা (Esteem needs)।
শেষ ধাপ বা সব চেয়ে উঁচুতে অর্তাৎ পিরামিডের
চুড়োয় রাখা হয়েছে আত্মোপলব্ধি-সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপার (Self-Actualization
needs)। যেমন নিজের ভিতরে
সুপ্ত নানান সম্ভাবনা ও প্রতিভাকে আবিষ্কার করে সেগুলি বিকশিত করা এবং প্রয়োগ করা।
অর্থাৎ নিজেকে আরো বেশি উন্নত করা এবং নিজেকে সদা সৃষ্টিশীল রাখা।
যদিও মাসলো সাহেবের এই তত্ত্বের অনেক বিরোধিতাও আছে। এমনকি স্বয়ং
মাসলোই পরে পাঁচটি ধাপের সঙ্গে আরো তিনটি ধাপ যোগ করেছিলেন। তাতে প্রথম চারটি ধাপ
একই থাকলেও পঞ্চম ধাপে এল Cognitive needs বা মানুষের জ্ঞান-পিপাসা। জগৎ ও জীবনকে জানা ও
বোঝা। সেই পিপাসার মধ্যে কৌতূহল আবিষ্কার অর্থ-নির্ণয় ও ভবিষ্যৎকে বোঝার তাগিদ
এসবই লীন হয়ে থাকে। ষষ্ঠ ধাপটি হল Aesthetic needs। অর্থাৎ নন্দন-তত্ত্বের রসাস্বাদনের তাগিদ, সুন্দর ও রূপের
প্রতি আগ্রহ। আমাদের কবির ভাষায় - ‘জনম অবধি হম রূপ নেহারনু/নয়ন না
তিরপিত ভেল,/লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু/তবু হিয় জুড়ন
না গেল’। সপ্তম ধাপে ঢুকে পড়ল Self-Actualization
needs। আর অষ্টম বা শেষ ধাপ অর্থাৎ পিরামিডের
চুড়োয় আসীন হল Transcendence needs। এক কথায় যার অর্থ উত্তরণের
চাহিদা। তখন নিজেকে আর নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা নয়। নিজেকে ছাপিয়ে নিজের থেকে বেরিয়ে
এসে অন্যদেরও বিকশিত হতে সাহায্য করা।
মাননীয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন
কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে মাসলো সাহেবের তত্ত্বটিকে টেনে আনার পিছনে একটাই কারণ
কবিতা লেখাটাকেও আমরা যেহেতু একটি সৃষ্টিকর্ম হিসেবেই বিবেচনা করি তাই কবিতা লেখার
পিছনে যে সব গরজ কাজ করে এই তত্ত্বের আলোয় সেগুলি চিনে নিতে সুবিধে হয়।
একজন মানুষ যিনি কবিতা লিখতে চাইছেন বা লিখছেন তার মনের সচেতন বা
অবচেতনে একের পর এক কিছু প্রশ্নের যাওয়া আসা চলতেই থাকে। হয়ত
ধাক্কাও মারবে। জিজ্ঞাসাগুলি মোটামুটি এই রকম। কেন লিখব। কী লিখব। কীভাবে লিখব। কতটা লিখব।
এইসব। সঙ্গে সঙ্গে নিজের উত্তরগুলিও সাজিয়ে নিতে হয়।
প্রথমেই ধরা যাক ‘কেন লিখব’। এটা
একটা খুব
সাধারণ প্রশ্ন। সকলকেই এর মুখোমুখি হতে হয়। উত্তরটাও ওই মাসলো-সাহেবের তত্ত্বের
মধ্যে বলা আছে। তাগিদ। কেউ বলবে না
লিখে থাকতে পারি না। কেউ বা একটু স্মার্টলি বলতে চাইবেন আমার লেখা পায়। কেউ বলবেন
আমি কি আর
লিখি আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নেই। যে-যাই বলুক আসল কারণটা সেই মনের ভেতর থেকে উঠে
আসা একটা গরজ। একটা ঠেলা। কোনো রসিক হয়ত মজা করে বলবেন ঠেলার নাম বাবাজীবন।
তার মানে ‘কেন লিখব’-এর স্বপক্ষে প্রত্যেককেই একটা প্রতিরক্ষা খাড়া
করতে হইয়। হয় তিনি ভাববেন এটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে বা নাড়া দিয়েছে। আমার ভেতর থেকে
কিছু কথা বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন কিছু অনুভব বন্ধু প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের সঙ্গে দৈনন্দিন
আলাপচারিতায় সেগুলো প্রকাশ করা যায় না, তাই তাদের লিখে ফেলা উচিৎ।
আবার যদি বলা হয় নিজেকে প্রকাশ তো অনেকভাবেই করা যায়। তাহলে কবিতাকেই
বা বেছে নেওয়া কেন। তার উত্তরেও দেখুন কেউ বলবেন আমি অন্য কিছু পারি না। আবার এমন
অনেকেই আছেন যার কবিতা লেখার পাশাপাশি অন্য রকম সৃষ্টিশীল কাজেও নিজেকে মগ্ন
রাখেন। তারা হয়ত বলবেন কবিতা লেখাটা আমার একটা প্যাশন।
যাই হোক, ‘কেন লিখব’ এর পরেই যখন আসবে ‘কী লিখব’ বা ‘কেমন করে লিখব’-র
প্রশ্ন, তখন একটু থমকে দাঁড়াতে হবে। তখনি তার সামনে কোনো বিষয় এসে হাজির হতে পারে।
অথবা কোনো আইডিয়া। সেই বিষয় হতে পারে মানবিক ভাললাগা-ভালবাসা থেকে শুরু করে নিসর্গ
সমাজ রাজনীতি ধর্ম দর্শন বা অন্যকিছু। আইডিয়াও হতে পারে ক্লাসিক লিরিক্যাল রোম্যান্টিক
রিয়েলিস্টিক সুরিয়ালিস্টিক অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বা এই রকম কিছু। সব মিলিয়ে একজনকে
লিখতে হয় তার অস্তিত্বের বেদনা। এই যে বিশ্ব মহাবিশ্ব আকাশ মহাকাশ গ্রহ নক্ষত্র
নিসর্গ প্রকৃতি মানুষ এবং তার কল্পিত ঈশ্বর এসবের সাপেক্ষে নিজের ক্ষুদ্র
অস্তিত্বকে অনুভব করা, তার ব্যথা বেদনা সুখ-দু;খ-হতাশা-আনন্দ-বিদ্রোহ থেকে শুরু
করে চারপাশে ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনাবলি তাকে কতখানি আন্দোলিত করছে অথবা করছে-না সেসব
কথাই উঠে আসে একজন সংবেদনশীল কবির কলমে।
নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাপারে প্রতিটি মানুষেরই কমবেশি থাকে কিছুটা আবেগ-নির্ভরতা
আবার কিছুটা বা যুক্তি-তর্ক বা বুদ্ধি-নির্ভরতা। থাকে স্বপ্ন-কল্পনা-ফ্যান্টাসি
বা মিথের বিলাসিতা। নানান কথাবার্তা বা কাজে সে সে-ভাবেই নিজেকে প্রকাশ ও প্রয়োগ
করতে চায়। কবিতা লেখার বেলাতেও তাই। কারো লেখায় পাবেন চূড়ান্ত আসক্তি বা
মেলোড্রামা আবার কারো লেখায় একটা চরম নৈর্ব্যক্তিক বা নিরাসক্ত ভাব। যে যেভাবে
চিন্তা করে বা নিজের কথাকে প্রকাশ করতে চায়। সেভাবেই গড়ে ওঠে তার কবিতার শরীর ও
মন-মেজাজ।
তার মানে মনে হতে পারে পাঠকের কাছে কবিতার দুটি দিক বিবেচিত হয়। এক
তার দেহ বা শব্দ-শরীর দুই তার আত্মা বা প্রাণ। এর পরেও থাকে দেহ ও আত্মাকে অতিক্রম করে এক অন্য উদ্ভাস বা
উন্মোচন। যা হবে রসময় রহস্যময় এবং একই সঙ্গে চঞ্চল ও স্থির। এই তৃতীয় মাত্রাটিই
একটি লেখাকে কবিতা করে তুলবে। এটাই উত্তরণ।
‘কী লিখব’ এই প্রশ্নের মুখে কেউ কেউ হয়ত আবার কিছু না ভেবেই লেখা শুরু
করে দেন। তাদের ভাবটা অত ভেবে কী হবে যা মনে আসছে তাই লিখে যাই। সত্যিই তো ওত ভেবে
কী হবে, একজন মানুষ তো তার ভাবনায় যা আসছে নিজের মতো করে তাই লিখতে চাইবেন। তবু
কেউ কেউ আবার ভাবেনও। এত দিন ধরে দেশে বিদেশে এত মানুষ কবিতার নামে এত কিছু লিখে
রেখে গেছেন। তারা কী লিখেছেন কেমন ছিল তাদের চিন্তা-ভাবনা অনেকেই সেগুলো জানতে ও
বুঝতে চান। তার সঙ্গে নিজের ভাবনা-চিন্তাগুলোকে মেলাতে চেষ্টা করেন। নিজের সময়ের
ঘটনাক্রমকে বুঝতে চান। তার সাপেক্ষে নিজের অবস্থানটিও ঠিক করে নিতে চান। তার পর
ঠিক করেন তিনি কী লিখবেন। পূর্বজরা যা লিখে গেছেন সেগুলোই রিপিট করবেন না নতুন
কিছু লিখবেন। এমন কিছু কথা যা এর আগে কেউ বলেননি।
এভাবেই তৈরি হয় একজন কবির কবিতার বিষয়বস্তুর স্বকীয়তা। সেই স্বতন্ত্র
বিষয়-ভাবনা দিয়েই তিনি নিজেকে অন্যদের সঙ্গে আলাদা করতে চান। একই সময়ে সমসাময়িকতার
সঙ্গে নিজের লেখালিখিকে প্রসঙ্গিক করে তুলতে চান।
বাংলা-কবিতার হাজার বছরের উপর যে পথচলা সেখানেও যুগে যুগে নানান বিষয়
উঠে এসেছে। আদিপর্বের চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগের বৈষ্ণব-পদাবলি তারপর মঙ্গলকাব্য
অনুবাদ-সাহিত্য থেকে শাক্ত-পদাবলি আরাকান রাজসভার সাহিত্য কত রকম বিষয়বৈচিত্র। চর্যাপদের
সিদ্ধাই-যোগীদের বৈরাগ্য ও দেহতত্ত্ব, বৈষ্ণব-পদকর্তাদের রোম্যান্টিকতা,
মঙ্গলকাব্য-রচয়িতাদের লেখায় মহাকাব্যিক ঘটনা ও মেজাজ আনার চেষ্টা। আবার
শাক্ত-পদকর্তাদের কবিতায় অফুরন্ত ভক্তি স্নেহ ও বাৎসল্য-রস, আরাধ্য দেবীকে মাটির
ঘরে নামিয়ে এনে তার সঙ্গে মায়ে-পোয়ে কথোপথন। আবার আরাকান রাজসভার সাহিত্যে
দেব-দেবীর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মানব-মানবীর প্রেমকথা।তারপর ছাপাখানার যুগ। ঈশ্বরগুপ্ত
থেকে মাইকেন কিংবা বিহারিলাল থেকে রবীন্দ্রনাথ বিষশয়ভাবনার কত রকমফের কত নতুন নতুন
দিগন্ত-উন্মোচন। রবীন্দ্রনাথের অসামান্য উপস্থিতির পাশাপাশি সমসাময়িক কবিতায় আরো
বিস্তর অদল-বদল। দেশপ্রেম বিদ্রোহ শেকল-ভাঙার ডাক। রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে আবার ইউরোপীয়
আধুনিকতার প্রবল জোয়ার। বাংলা-কবিতাকে বিদেশি বিষয়-ভাবনায় জারিত করা। তারপর ভয়াবহ
বিশ্বযুদ্ধ পারমানবিক বিস্ফোরণ দুর্ভিক্ষ মহামারি দেশভাগ স্বাধীনতা দাঙ্গা
উদ্বাস্তু-সমস্যা দেহজ কামনা-বাসনা আবার স্বাধীনতার আবেগ স্তিমিত হলে স্বপ্নভঙ্গের
যন্ত্রণা বামপন্থী আন্দোলন শ্রমিক-কৃষকের লড়াই থেকে শহুরে যুবকদের ইউরোপের অনুকরণে
নানান কবিতা-আন্দোলন তৈরির চেষ্টা তারপর স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা কবিতায় বোহেমিয়ান
মনোভাব শুদ্ধ-কবিতার সন্ধান তরুণদের একটা অংশের আবার অতিবামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া –
এই ভাবে বাংলা-কবিতার বিষয়-বস্তু যুগে যুগে বদলে গেছে কত নতুন নতুন মাত্রা
যুক্ত হয়েছে, কোনো সময়েই কোনো কিছু এক জায়গায় থেমে থাকেনি।
‘কী লিখর’-র পর আসে ‘কীভাবে লিখব’ সেই চিন্তা। তখনি আসে নিজস্বতার
প্রশ্ন। কারণ প্রতিটি মানুষেরই আছে পাঁচটি ইন্দ্রিয় ও একটি মন। যা দিয়ে সে নিজের
চারপাশকে আত্তীকরণ করে। কিন্তু নিজের ভাবনাকে একজন কীভাবে প্রকাশ করবেন সেটা
একান্তভাবেই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটাই তার স্টাইল। ঘরানা। সিগনেচার। এই বৈশিষ্ট্য
দিয়েই একজনের কবিতাকে আরেকজনের থেকে আলাদা করা যায়। এই নিজস্ব কণ্ঠস্বর গড়ে তোলার
জন্যে কবিকে নিজের কাব্যবোধের আশ্রয় নিতে হয়।
এখন দেখা যাক কী রকম সেই কাব্যবোধ। এই কাব্যবোধ
তৈরি হয় একজন কবির শিক্ষা-দীক্ষা প্রকৃতি রুচি সংস্কার মনন মেজাজ এই সবের সমন্বয়ে।
তার উপর থাকে ব্যক্তি-মানুষের মনোভাব। আমাদের জীবনে রোজদিন যে আনন্দ ও স্ফূর্তি তা
থেকে যেমন ইতিবাচক মনোভাব আসে, আবার যে দুঃখ-কষ্ট-উদ্বেগ তার থেকে আসে নেতিবাদি
মনোভাব। লেখার সময়ে কেমন মনোভাব কাজ করে থাকবে সেই প্রশ্নও। আরো থাকবে তার মুদ্রাদোষ।
কোনো মানুষই ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না।
বোঝাই যাচ্ছে কাব্যবোধ নানা মানুষের ক্ষেত্রে নানা রকম হয়। ধরুন
বিদ্যায়তনিক দিক দিয়ে একজন অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষ। তার কাব্যবোধ তৈরি হয়
শুনে শুনে। রামায়ণ কথকতা পাঁচালি গান কবিগান এইসব শুনে তার যে ভিত গড়ে উঠেছে সে
তারই শরনাপন্ন হবে। সেভাবেই লিখতে চাইবে। আবার যারা শিক্ষিত। জীবনের কিছুটা সময়
সিলেবাসের ভিতর দিয়ে গেছেন তার কাব্যবোধ গড়ে উঠবে সেই পাঠক্রমের ভিত্তিতে। অর্থাৎ
ছন্দ মাত্রা অন্ত্যমিল শব্দচয়ন যে যেটা পছন্দ করেন তিনি সেটাই অনুসরণ বা অনুকরণ
করতে চাইবেন। তার সঙ্গে কার কার ক্ষেত্রে সিলেবাসের বাইরের কিছু রসদও জুটে যেতে
পারে। সেগুলো শ্রুতিলব্ধ। মানে বাচিক শিল্পীদের আবৃত্তি শুনে। বা নানা আবৃত্তির
অনুষ্ঠানে নিজে অংশ নিয়ে। লেখার সময় চেতনে হোক অবচেতনে হোক তাদের মাথাতেও সেই
প্রিয় কবিতার লাইনগুলো ঘুরঘুর করতে থাকবে। এটা একটা প্রসেস। আবার লিখতে লিখতে যারা কিছুটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তারা দেখবেন তাদের
সমকালীন কবিরা কে কী লিখছেন কেমন করে লিখছেন। তাদের চিন্তা করতে হবে সেই প্রভাবে তারাও প্রভাবিত
হবেন। না নিজের পথটিকে আলাদা করে নেবেন।
পরের প্রশ্নটা হল কতটা লিখব। এটা এক এক জনের বেলায় এক এক রকম। কেউ
মিতভাষী তিনি চাইবেন অল্পকথায় বাজি মাত করতে। যিনি প্রগলভ তিনি
বিস্তারে যাবেন। তার কথা আর থামতে চাইবে না। লেখা শেষ করার পরেও মনে হবে আরো
কিছুটা লিখতে পারলে ভালো হত। কেউ
চাইবে গমক-চমক-চটকদারি কিছু বলে-কয়ে বাজার গরম করতে, কেউ চাইবেন হৃদয়ের পেয়ালায়
উপচে পড়া রং-রূপ ও রসের বেদনাকে কথায় প্রকাশ করতে, কেউ চাইবেন প্রচলিত সিস্টেমের
বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্রোহে ফেটে পড়তে, আবার কেউ কেউ বা চলে যেতে চাইবেন কোনো
প্রগাঢ় দার্শনিক উপলব্ধির অতলান্ত গভীরতায়।
আসলে এই কথা বলার ব্যাপার গোড়া থেকেই
উপমাহাদেশের অন্যান্য অংশ থেকে দেশের একেবারে পূর্বপ্রান্তে অবস্থানরত বঙ্গবাসীদের
একটা চরিত্রগত পার্থক্য আছে। এটা আমার কথা নয়। একথা আমাদের পূর্বপুরুষ বলে গেছেন।
প্রাকৃত অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে যখন নতুন আর্যভাষাগুলি ক্রমেই নিজেদের আলাদা করে
নিচ্ছিল যখন দেশের বাকি অংশের কাছে প্রাচীন বাঙলা গৌড় নামে পরিচিত ছিল তখন
আর্যাবর্ত বা মূল-ভূখণ্ডের পণ্ডিতেরা এখানকার মানুষদের রচনারীতির নাম দিয়েছিল
‘গৌড়ীয় রীতি’। যার প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল ‘অক্ষর-ডম্বর’ ও ‘অলঙ্কার-ডম্বর’। অর্থাৎ
সেই বকবকানি। প্রবল ধ্বনি-সমারোহ বা শব্দ ও অলঙ্কারের আড়ম্ভর, বদ্ধ-গৌরব বা রচনার
গাঢ়তা। তার মানে সেই সপ্তম-অষটম শতক থেকেই
গৌড়জনেরা নিজেদের প্রতিভা দিয়ে সর্ভভারতে
প্রচলিত যে ‘বৈদর্ভী রীতি’ (যার বৈশিষ্ট্য শ্লেষ বা শব্দ-ব্যবহারের চাতুর্য প্রসাদ মাধুর্য সৌকুমার্য ইত্যাদি) তাকে
অস্বীকার করে ও তার প্রভাবকে অতিক্রম করে নিজেদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র-রীতির উদ্ভব
ও বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
যেমন ধরুন যদি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ এবং জয়দেবের
‘গীতগোবিন্দ’-এর শুরুটা দেখেন তাহলেই বুঝবেন। কারণ দুটো কাব্যই শুরু হচ্ছে বর্শার
বর্ণনা দিয়ে। কালিদাস যেখানে মন্দ্র-মধুর চালে বলছেন ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে
মেঘমাশ্লিষ্টসানুং/ বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।।’ সেখানে জয়দেব যেন মাদল
বাজিয়ে হই হই করে গেয়ে উঠছেন ‘মেঘৈর্ম্মেদুরম্বরং বনভুবঃ
শ্যামাস্তমালদ্রুমৈ-/র্নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।”। এখানে যে কথাটা না বললেই নয়, মেঘদূত
গোটাটাই মন্দাক্রান্তা ছন্দে, অথচ গীতগোবিন্দের একটা পদেও সেই ছন্দ নেই।
প্রসঙ্গত গীতগোবিন্দের আরো একটা শ্লোকের কথা
বলা যায়। যেখানে স্বয়ং জয়দেব তাঁর সমসাময়িক আরো চারজনের রচনারীতির বর্ণনা
দিয়েছেন।(লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় বিখ্যাত পঞ্চরত্ন – জয়দেব, উমাপতিধর, শরণ,
গোবর্ধনাচার্য এবং কবিরাজ ধোয়ি)। চতুর্থ শ্লোকে জয়দেব যা বলেছেন শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যয়-কৃত তার বাংলা-অনুবাদ, (ব্রাকেটে
টীকা সহ) এই রকম– কবি উমাপতি ধর বাক্যকে পল্লবিত করেন। (অর্থাৎ রচনায় অনুপ্রাসাদি
অলংকার-বিন্যাসেই সুদক্ষ, কিন্তু তাঁর বচন প্রকৃত কাব্যগুণযুক্ত নহে)। দুরুহ পদের
দ্রুত রচনায় শরণ কবি প্রশংসনীয়। (কিন্তু সে রচনা প্রসাদাদি গুণবর্জিত)।
শৃঙ্গাররসের সৎ এবং পরিমিত রচনায় আচার্য গোবর্ধনের কেহ সমকক্ষ আছেন বলিয়া শুনিতে
পাওয়া যায় না। (কিন্তু সে শুধু সামান্য নায়কনায়িকাবর্ণনে এবং তাহাও আবার একটা
নির্দিষ্ট গণ্ডিবদ্ধ)। ধোয়ী কবিরাজ শ্রুতিধর বলিয়া প্রসিদ্ধ। (তাঁহার নিজের কোনো
মৌলিকতা নেই)। একমাত্র জয়দেব কবি শুদ্ধ সন্দর্ভ রচনায় সমর্থ। (অর্থাৎ তাঁহার রচনায়
সমস্ত গুণই আছে যেহেতু তাঁহার রচনায় ভগবদগুণবর্ণনা আছে)।
জয়দেব যে রসের কথা বললেন অনেকেই মনে করেন সেই
রস কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চৌদ্দশো শতকে বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর
‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থে বলেছেন ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’ অর্থাৎ রসাত্মক বাক্যই
কাব্য। পরে ভারতচন্দ্র জানিয়ে দিলেন ‘যে হৌক
সে হৌক বাক্য কাব্য রস লয়ে’। রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘সাহিত্যে যা আনন্দের সামগ্রী তা-ই
রসের সামগ্রী’। রবীন্দ্রনাথ আরো
জানিয়ে দিলেন – ‘রস জিনিসটা কী? না যাহা হৃদয়ের কাছে কোনো-না-কোনো
ভাবে প্রকাশ পায় তাহাই রস, শুদ্ধজ্ঞানের কাছে যাহা প্রকাশ পায়
তাহা রস নহে’। তবে খেয়াল
রাখতে হবে কবিতায় রসের জোগানও যে মাত্রাকে অতিক্রম না করে। রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায় –
‘রসের সচ্ছলতায় সাহিত্য হয় না, রসের উচ্ছলতায় সাহিত্যের সৃষ্টি’।
রস প্রসঙ্গে ভবভূতি ও কালিদাসের সেই বিখ্যাত
গল্পটি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছি যেখানে একটি শুকনো কাঠের খণ্ডকে দেখে
যেখানে একজন বলছেন - “শুষ্কং কাষ্ঠং
তিষ্ঠতি অগ্রে” সেখানে অন্যজনের কথায় “নীরস তরুবর পুরতঃ ভাতি”।
আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে নব রসের কথা বলা
হয়েছে- হাস্য, শৃঙ্গার, করূণ, রুদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত, শান্ত। বলা হয়েছে এগুলি মৌলিক রস, এদের মিলমিশ ঘটিয়ে আরো জটিল রস তৈরি করা যায়। যেমন ছেলেভুলোনো ছড়ার
ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তাদের উৎসে আছে খেয়ালরস।
রসাত্মক বাক্যই যদি কবিতা হয়। তাহলে রসের সঙ্গে
বাক্যর কথাও কিছুটা বলতে হয়। বাক্যের শ্রেণিভাগ করতে গিয়ে প্রথমে ঋকবেদেই বলা
হয়েছিল-‘চত্বারি বাক্
পারমিতা পদানি'। চারটি বাকের নাম
- বৈখরী, মধ্যমা, পশ্যন্তী এবং পরা। পণ্ডিতরা জানিয়ে
দিলেন বাকের এই চারটি অবস্থার মধ্যে একমাত্র বৈখরীর সঙ্গেই সাধারণ মানুষের কিঞ্চিত
পরিচয় আছে। কারণ তা স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হয়। বাকি তিনটি অর্থাৎ পরা পশ্যন্তি ও
মধ্যমাকে একমাত্র সাধকরাই আয়ত্ব করতে পারে। কারণ তারা হৃদয়ে অন্তর্নিহিত থেকে ফলে
সাধারনের কাছে অপ্রকাশিত। বলা হয়েছে পরা বাক একেবারে মূলচক্রে থাকে, পশ্যন্তী থাকে
নাভিতে, মধ্যমা হৃদয়ে, এবং বৈখরী কন্ঠদেশে। সেকথা
মানতে গেলে বলতে হয় বাক্-এর স্থূল এক-চতুর্থাংশই মানুষের কন্ঠে উচ্চারিত হয়। বৈয়াকরণদের
মতে মধ্যমা, পশ্যন্তী এবং পরা এই তিনটি প্রণব বা ওঙ্কার-মন্ত্রের সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর
ও সূক্ষ্মতম রূপ। পরবর্তী সময়ে ভর্তৃহরি অবশ্য শব্দব্রহ্মের কথা বলতে গিয়ে তাঁর ‘বাক্যপদীয়’-গ্রন্থে
বিখ্যাত ‘স্ফোটা’ তত্ত্বে পরাকে বাদ দিয়ে জানালেন পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী একটি
শব্দের তিনটি প্ররযায় সেগুলি যথাক্রমে ধ্বনি, স্ফোট এবং অর্থ। অর্থাৎ
খুব সাধারণ ভাবে ভাবলে ব্যাপারটা কতকটা এই রকম মনের মধ্যে জন্ম নেওয়া একটা ভাব
রূপান্তরিত হতে হতে ক্রমশ ধ্বনি থেকে কুঁড়ি এবং কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে উঠছে এবং
তার সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্যদের কাছে।
কবিতায় এইভাবে মনের ভাবকে কথায় প্রকাশ করে তাকে
সাজিয়ে সাজিয়ে বাক্য গঠন করতে হয়। তার সঙ্গে যেটা থাকে তা হল বাক্যের মধ্যে প্রতীক
চিত্রকল্প ও রূপকের ব্যবহার। ব্যাপারটা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। অনেক
বিশেষজ্ঞের কলমে সে রকম আলোচনাও কিছু কম হয়নি। এনিয়ে বেশি কিছু না বলে এইটুকু বলা
যায় বাংলা-কবিতার শুরু অর্থাৎ সেই চর্যাপদের সময় থেকেই আমরা এর ব্যবহার দেখতে পাই।
যদিও পরবর্তীকালে আমাদের কবিরা তাকে গুরুত্ব দেয়নি। তা নিয়ে এদেশে আবার হইচই শুরু
হয় আধুনিক সময়ে। যখন ইউরোপে বোদলেয়র মালার্মে এলিয়ট প্রভৃতিদের কবিতায় এই প্রতীক-চিত্রকল্পে
ব্যবহার অন্য মাত্রা জুড়ে দেয়।
তো কমবেশি এই হচ্ছে কবিতা লেখার কিছু প্রাথমিক কথাবার্তা। এরপরেও কিছু
প্রশ্ন আসে। যেমন, কে কতদিন লেখা চালিয়ে যাবেন, বা লেখালিখির দৌড়ে কার দম কতটা, কবিতা
লিখে একজন কবি কী পেতে চান, কবিতা লিখতে গেলে কতটা পড়াশোনা থাকা দরকার, সময়ের
বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কবিতারও কি আপডেশন দরকার হয়। বা ঠি এই সময়ে আমাদের কবিতা কেমন
প্রতিবেশীদের কবিতা কেমন বিদেশিদের কবিতাই বা কেমন। সব মিলিয়ে এই একবিংশ শতকে কবিতার
গতিপ্রকৃতি কী হবে। এইসব যা আলোচনা করতে গেলে আরো অনেক বড়ো পরিসরের দরকার।
সংক্ষেপে বলা যায় কবিতালেখা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ বা হান্ড্রেড মিটার রান
নয়, এটা এমন এক লম্বা দৌড় যার জন্য দরকার প্রচুর দম। দৈনন্দিন জীবনচর্চার সঙ্গে
কবিতাচর্চাও অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে থাকে ফলে জীবনে টিকে থাকার লড়াইটা কখন যেন
কবিতা-জীবনেও সত্যি হয়ে যায়। কবিকেও নানান মানসিক টানাপোড়েন সমস্যা ও সংকটের নানান
ওঠাপড়ার ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। তার জন্যে দরকার এক নিবিষ্ট সাধনা। এগিয়ে চলার
জেদ এবং নিজেকে প্রকাশ করার চাহিদা। এটা জেনেই কবিকে কলম ধরতে হয় যে শেষ পর্যন্ত
এক রাশ ব্যর্থতা ছাড়া কবিতা লিখে আর পাবার কিছু নেই। যারা নাম-যশ-খ্যাতি-অর্থ-কর্তৃত্ববাদে
বিশ্বাস করেন তারা অবশ্য অন্য পথের পথিক। তাদের কাছে কবিতার সঙ্গে বাজারের অন্য
পণ্যের কিছু পার্থক্য আছে কিনা বোঝা মুশকিল।
তবে একথা অস্বীকার করে লাভ নেই এই সময়ে অবশ্যই বাজার অবশ্যই একটি
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকাংশ মানুষই বাজারের দ্বারা লালিত পালিত এবং চালিত।
ইদানীং যেসব ছেলেমেয়েরা কবিতা লিখতে আসছে তাদের মধ্যে খুব কম জনই আছেন যারা এর
ব্যতিক্রম। অথচ ব্যতিক্রমী হওয়াটা খুব জরুরি। কারণ বাজারকে মাথায় করে রাখলে মাথাটা
আর ব্যক্তির মাথা থাকে না সেটা বাজারের মাথা হয়ে যায়। বাজার নিজের মতো তাকে
প্রোগ্রামিং করে নেয়। ফলে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।
এই হাই-টেক রেভোলিউশনের যুগে একটা ব্যাপার আমরা সকলেই জানি কিন্তু
অনেকেই সেভাবে খেয়াল করি না। ব্যাপারটা হচ্ছে কোনো টেকনোলজিই কিন্তু এক জায়গায়
দাঁড়িয়ে থাকে না। কোনো না কোনো ভাবে লাগাতার সে নিজেকে যুগোপযোগী করে চলেছে। প্রতিদিন
অভিনব কিছু না কিছু ঘটছে। নতুন নতুন অ্যাপ্লিকেশন আসছে, নতুন নতুন ফিচার, নতুন
সুযোগ-সুবিধা। আমাদের খাদ্যাভ্যাস থেকে পোশাক-আশাক ফ্যাসান-স্টাইল সব জায়গায় একই
ছবি। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হচ্ছে আপডেশন।
প্রশ্নটা হচ্ছে এই প্রক্রিয়া মেনে আমরাও কি নিয়মিত আপডেট করতে পাচ্ছি।
নিজেদেরকে এবং আমাদের কবিতাকে। নাকি গতানুগতিকার পথে হেঁটে বেঁচে থাকাটাকে নিতান্ত
এক অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছি। তথাকথিত সুখ-সমৃদ্ধি-সফলতাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য
বলে মেনে নিয়েছি। প্রত্যেককেই ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি নতুন কিছু ভাবা বা নতুন কিছু
করার ব্যাপারে আমরা ঠিক কতখানি আগ্রহী।
নতুন কিছু ভাবা বা নতুন কিছু করা মানে গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসা।
প্রচলিত রীতিনীতিকে অস্বীকার করা, তাদের অতিক্রম করা। সিলেবাসের বাইরে বেরিয়ে, ভাবালুতা-আবেগ-বুদ্ধি-মেধা
বা আধুনিক সময়ের চাপিয়ে দেওয়া যুক্তি-কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে এই সময়ের নিজস্ব চোখ
দিয়ে জগৎ ও জীবনকে নতুন করে দেখা ও ভাবা। তাদের নতুন দিশার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
সুরম্য শব্দ লিরিক্যাল উপমা সত্য-সুন্দরের চিরকেলে বন্দনা কথায় কথায় নীতি-উপদেশ বা
শান্তিজল ছেটানো এইসবকে বর্জন করা। কাজগুলি কিন্তু খুব ঝুঁকির এবং অনিশ্চিয়তা তথা
অমীমাংসার দিকে ধাববান। আমরা কজন আমাদের চারপাশের নিরাপত্তা বলয় ভেঙেচুড়ে সেই দূর
অনির্দিষ্ট পথের পথিক হতে রাজি আছি।
তার মানে একজন কবির সামনে দুটো পথ। একটা পথ পাকা। পিচ-বাঁধানো। ঝকঝকে
তকতকে। সে পথে লক্ষ মানুষের যাওয়া-আসা। সুতরাং ভিড়াক্রান্ত এবং ভারাক্রান্ত।
সেখানে অনেক হিসেব-নিকেশ। অনেক ঝগড়া-বিবাদ। অনেক ল্যাঙ-মারামারি। নিন্দা-কুৎসা।
মুরুব্বি-ধরা এবং নিজেকেও এক সময় মুরুব্বির আসনে প্রতিষ্ঠিত করা। এই পথ
প্রতিষ্ঠানের বানানো।
এগিয়ে যাবার আরেকটা পথ আছে। পথ না বলে তাকে বিপথ বলাই ভালো। সে-পথে
পদে পদে বিপদ। শ্বাপদ-সংকুল। কণ্টকময়। খানাখন্দে ভরা। সেই পথই নতুন পথ। সে-পথে সুখ
নেই, কিন্তু আনন্দ আছে। উত্তেজনা আছে। অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ। নতুন কিছু আবিষ্কারের
উত্তেজনা। সে পথ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত নয়। তাই সেখানে হয়ত আশেপাশে কোনো
সঙ্গী-সাথী নেই। সে-পথ একলা-চলার পথ।
সুতরাং যে বা যারা কবিতার নামে নতুন কিছু লিখতে চাইছে তাদের ভাবতে হবে
কোন পথে যাবে। ভাবতে হয়। একজন সময়মনস্ক মানুষ যেমন চারপাশের ঘটনাবলিকে এড়িয়ে যেতে
পারেন না, একজন কবিকেও তেমনি এসব নিয়ে ভাবতে হয়। তাকেও
ভাবতে হবে এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে সেও কি গত-শতকের একজন কবি যেভাবে ভেবেছে এবং
লিখেছে সেভাবেই লিখবে। সেই একই বিষয় ছন্দ অলঙ্কার প্রতীক চিত্রকল্প সৌন্দর্যচেতনায়
নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে না তাদের ছাপিয়ে তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে নতুন
সময়ে দাঁড়িয়ে নতুনত্বের সন্ধানে এগিয়ে যাবে। কাজটা কিন্তু খুব শক্ত।
আগেই কিছুটা বলেছি আবার বলছি কবিতা লেখা মানে আরো একটি বিষয়-কর্ম নয়।
গতানুগতিক লেখালিখির অভ্যাস রপ্ত করে কবিতার বংশবৃদ্ধি করা নয়। আমার মতে কবিতা
লেখা মানে একটি সাধনা। একটি সৃষ্টি-কর্ম। তার জন্যে একজনকে যেমন নিরন্তর কবিতা
ভাবনার মধ্যে থাকতে হবে তেমনি অনেক পড়াশোনা করতে হবে। অনেক কিছু জানতে হবে। নিজেদের
ঐতিহ্য ও পরম্পরা প্রতিবেশীদের কথা বিদেশিদের লেখালিখি – এ জানার কোনো শেষ নেই।
আবার দেখতে হবে নিজের এই জানাশোনা বা জ্ঞানের ভার যেন নিজের লেখালিখির উপর এসে না
পড়ে। লেখালিখিকে নিজের মতো হয়ে উঠতে দিতে হবে। তার নিজস্ব চলন বলন মেজাজ-মর্জি তৈরি
করতে হবে। এমনকি নিজের ব্যক্তিগত খবরদারি থেকেও তাকে মুক্ত করতে হবে।
শুরুতেই আরেকটা কথা বলেছি সোশাল মিডিয়ায় কবিতার বিস্তার ও
মহা-বিস্ফোরণের কথা। বলেছি এটা খুব ভালো লক্ষণ। তবে মনে রাখতে হবে কবিতার নামে
যারা তাৎক্ষণিক কিছু লিখে লাইক বা বাহবা পেতে চাইছে তাদের মধ্যে আবেগ বা
ভাবালুতাতাই বেশি। তারা ক্ষণকালের আনন্দে বিভোর হতে চান। আবার যারা এই ক্ষণকালটাকেই
দীর্ঘায়িত করার ভাবেন তাদের কিন্তু কিছু প্রস্তুতি না থাকলে চলবে না। সেই জন্যে
আরেকটা কথাও বললাম কেউ যদি নিজেকে লম্বা-রেসের ঘোড়া হিসেবে বানাতে চান তাহলে তাকে
দমদার হতে হবে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, একজন কবিকে অনেক কিছু শিখতে হবে। যেমন
আমাদের যা কিছু বাস্তব এবং অনিশ্চিত তা যতই অসহ্য মনে হোক না কেন তাদের মেনে নেওয়া
শিখতে হবে। ভালো হোক অথবা মন্দ, তাদের যে যেমনটি তাকে
সেভাবেই গ্রহণ করা শিখতে হবে। আমাদের চিন্তা ও
কাজে স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া শিখতে হবে। আত্মকেন্দ্রিক
না হয়ে
সমস্যা-কেন্দ্রিক হওয়া শিখতে হবে। বন্ধুদের বলব অসম্ভব
রকমের রসবোধ আয়ত্ব করাও শিখতে হবে। জীবনকে
ব্যক্তিগত
ভাবে দেখা তেমনি নৈব্যর্ক্তিকভাবে দেখাও শিখতে হবে। যে
কোনো জাগতিক ব্যাপার-স্যাপারে একই সঙ্গে লিপ্ত হওয়া ও নির্লিপ্ত থাকা শিখতে হবে। হাজার
হতাশা ও বিভ্রান্তির মাঝেও নিজেকে কী করে সৃষ্টিশীল রাখা যায় সেটাও ভাবতে হবে। গতানুগতিক সাংস্কৃতিক হই-হল্লায় নিজেকে ডুবে যেতে দেওয়া চলবে না আবার
ইচ্ছকৃত ভাবে সেসব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা থেকেও বিরত হতে হবে। আমাদের
প্রত্যেকেরই মানবকল্যাণ নিয়ে যে উদ্বেগ তা নিয়ে সজাগ থাকতে
হবে। নিজস্ব ন্যায় ও নীতিবোধকে জোরালো করতে হবে। যে কোনো মানুষের জীবনের
মূল অভিজ্ঞতাগুলোকে অবশ্যই প্রশংসা করা দরকার। আরো দরকার কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করা। সব
মিলিয়ে নিজেকে অভিজ্ঞতার চুড়োয় নিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও বজায়
রাখতে হবে। আর আবশ্যই দেখতে হবে কোনো সময়েই যেন আমাদের গণতান্ত্রিক মনোভাব থেকে
বিচ্যুতি না আসে।
এরপর বন্ধুদের বলব নিজেই নিজেকে কতকগুলো প্রশ্ন
করে দেখুন তো কী উত্তর পান। প্রথম কথা আমারা কি জীবনকে একজন শিশুর চোখ দিয়ে দেখতে
পারি। যাকে বলে একেবারে সহজ-সরল-আদিম চোখে দেখা। যে দেখার মধ্যে কোনো কলুষতা নেই,
কোনো পূর্ব-আরোপিত ধ্যান-ধারণা নেই, আছে শুধু অকৃত্রিম বিস্ময় কৌতূহল ও আনন্দ।
আমরা কি নিজেদের জীবনকে তাকে পরিপূর্ণ আত্তীকরণ করে তার প্রতি মনোযোগ দিতে পারি। নিজেদের দোষ-গুণ বিচার করে নিজেকে আরো উন্নত করার কথা ভাবি। অন্য
ক্ষেত্র বাদ দিয়েও অন্তত লেখালিখির ব্যাপারে একটা কমফোর্ট জোনে নিজেকে আবদ্ধ না
রেখে নতুন কিছু ভাবা বা করার চেষ্টা করি। আমরা কি আমাদের ঐতিহ্য
ও পরম্পরা বা দেশ ও সমাজের কর্তাবাবুরা বা বেশিরভাগ মানুষ কী বলছে তা না শুনে
ব্যক্তিগত অনুভূতির দেয়ালে কান পাতে কিছু শোনার চেষ্টা করি। আমরা কি আমাদের ভনিতা
এবং সততার মুখোস পরিত্যাগ করতে পারি। আরো
ভাবুন আমি যা বলছি তা যদি বেশিরভাগ মানুষের মতের সঙ্গে না মেলে বা পছন্দ না হয়,
এবং সে কারণে যদি বাজারে আমাকে আনপপুলার হতে হয় সেটা মেনে নেবার জন্য আমি কি তৈরি আছি।
নতুন কিছু ভাবা বা করার ব্যাপারে আমি কি দায়িত্ব গ্রহণ করতে এবং শক্ত পরিশ্রম করতে
রাজি আছি। সব শেষে আর একটা প্রশ্ন আমরা কি নিজের রক্ষা-কবজগুলো চিনতে পারি এবং
দরকার হলে তাদের ত্যাগ করার মতো সাহস রাখি।
পরিশেষে জানিয়ে দিই কিছু বলা বা লেখার সুযোগ পেলে অনেকেই চায়
জ্ঞান-বিতরণ করতে। আমি সে দলে পড়ি না। কারণ আমি মনে করি সে রকম পড়াশোনা বা
বিদগ্ধতা কোনোটাই আমার নেই। আমি এক অতি সাধারণ সাহিত্য-কর্মী। যে নার্সিসাস বা
সেলফি-প্রজন্ম কবিতা-বিশ্বের প্রেমে পড়তে চাইছে তার প্রতি আমার কোনো উপদেশ বা
পরামর্শ নেই। কোনো সাবধানবানীও নেই। এই লেখার মাধ্যমে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার
করলাম মাত্র। আমি যা বুঝি নতুন কিছু করতে চাইলে পুরোন অনেক কিছুকে ভাঙতে ভাঙতে
যেতে হবে। পুরোন মিথ, পুরোন মূর্তি, পুরোন ধ্যান-ধারনা-বিশ্বাস। এমনকি কবিকে
নিজেকেও ভাঙতে হবে। ক্রমাগত। কারণ ড্রয়িংরুমে বসে যেমন কোনো সমাজ-বিপ্লব করা যায়
না। তেমনি নিজে নিরাপদ জায়গায় বসে থেকে অন্যকিছুকেও ভাঙা সম্ভব নয়।
এই ভাঙা মানে কিন্তু মোটেই ধ্বংস করা নয়। যেমন কোনো টগবগে তরুণ বা
তরুণী বাবা-মায়ের অমতে প্রেম করে বিয়ে করে যেখানে সে লালিত ও পালিত সেই
স্নেহ-ভালোবাসা-আদরের মায়াময় সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসে, নতুন করে নিজেদের সংসার
পাতবার জন্যে। মুক্ত হাওয়ায় বুক ভরে নিশ্বাস নেবার জন্যে। কবিতার পুরোন ফরম্যাটকে
ভেঙে ফেলে এই প্রজন্মকেও তেমনি নতুন ফরম্যাট গড়ে তুলতে হবে। তাকাতে হবে সামনের
দিকে। আগামীকালের দিকে।