Thursday, August 24, 2017

পোস্টমডার্ন ও ঋকবেদ-সংহিতা

পোস্টমডার্ন কালখণ্ড মানে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী দশকগুলির কথা। অর্থাৎ উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখণ্ড। বিদেশি শাসক ও শাসনের থেকে মুক্ত হয়ে এই সময়কালে আমরা সত্যিই কতটা নিজস্ব চিন্তায় বেড়ে উঠতে পারছি সেটা যেমন বিবেচিত হওয়া দরকার, তেমনি উপনিবেশবাদীদের শেখানো বুলি থেকে বেরিয়ে এসে এই পরিবর্তিত সময়ের নানান চরিত্র-লক্ষণ সাপেক্ষে আমাদের অতীতকে আমরা কতখানি বুঝে নিতে চাইছি বা পারছি আমার মনে হয়েছে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমার এই ঋকবেদ-সংহিতাকে কিছুটা ফিরে দেখার চেষ্টা।
একথা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত যে ঋকবেদের স্তোত্রগুলি যখন রচিত হয়েছিল তখন এই ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশ বিস্তারকারী আর্যদের কোনো লিপি ছিল না। অক্ষরজ্ঞানও ছিল না। স্তোত্রগুলি লেখা হত মুখে মুখে, শিষ্য ও বংশধরদের তা মুখস্ত করানো হত এবং সেভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম শিষ্য ও বংশ-পরম্পরায় এই শ্লোকগুলি বাহিত হয়ে এসেছিল। যে কারণে বেদের আরেক নাম শ্রুতি। আবার তাদের শুনে শুনে মুখস্ত করতে হত বলে রচনাগুলি ছিল ছন্দোবদ্ধ ও সুরেলাএদেশে আসার অনেক পরে (প্রায় হাজার বছর) লিপির প্রচলন ঘটে এবং বৈদিক শ্লোকগুলি সংকলিত হয়।
ঋকবেদ-সংহিতায় কবিতার উপাদান খুব কম। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ কোনো রকম সাহিত্য-চর্চার গরজ থেকে নয়, এই স্তোত্রগুলি রচিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ব্যবহারিক প্রয়োজনে। ইন্দ্র-অগ্নি-মিত্র-বরুণ প্রভৃতি দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বেশিরভাগ রচনাতেই প্রথমে দেবতাদের রূপ ও গুণের বর্ণনা শৌর্য-বীর্যের ফিরিস্তি তারপর ধন দাও বল দাও মান দাও প্রতিপত্তি দাও গাভি দাও নারী দাও আশ্রয় দাও ক্ষমতা দাও ইত্যাদি ইত্যাদি অর্থাৎ কেবল একটা দাও দাও ভাব। তাই সেই সব স্তোত্রের ছত্রে ছত্রে কাব্যরস নয় বরং তৎকালীন দখলদারদের কামনা-বাসনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শধু স্তোত্রে স্তোত্রে গুণকীর্তন নয়, দেবতাদের খুশি করার জন্যে সেইসব প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞাগ্নিতে নানাবিধ হবি ও সোমরসও নিবেদন করা হত। আমার তো মনে হয় সেই সময় থেকেই নবগঠিত ভারতীয় আমাদের সমাজে এই যে ক্ষমতাবানদের স্তাবকতা করা (স্তুতি থেকেই তো স্তাবক), এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে উৎকোচ প্রদানের মধ্যে দিয়ে তাদের খুশি করে কাজ আদায়ের যে অপসংস্কৃতি সেটা সেই বৈদিক সময় থেকেই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। মনে রাখতে হবে বৈদিক ঋকগুলি দীর্ঘ সময় ধরে রচিত হয়েছিল এবং মুখস্ত করে মনে রাখা হয়েছিল সুতরাং কালের নিয়মেই তাদের শরীরে বিস্তর পরিবর্তন পরিবর্জন ও পরিবর্ধন ঘটে গিয়েছিল। আবার এই সময়কালেই আর্য-সমাজও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে অটুট রাখতে পারেনি সমাজ-পরিবর্তনের নিয়মে সেখানেও ভাঙা-গড়া কিছু কম হয়নি।
আর্যরা ছিল বহিরাগত পরিযায়ী এবং পশুপালক সম্প্রদায়। সুদূর মধ্য-এশিয়া থেকে গোরু-ভেড়া চরাতে চরাতে নতুন চারণভুমির খোঁজে একদিন এসে পড়েছিল ভারতীয় উপমাহাদেশের ত্রিসীমানায়। কিন্তু সুসভ্য ও নাগরিক সভ্যতার অধিকারী এদেশের ভূমিপুত্রদের ধন-সম্পদ ও উন্নতি দেখে সেই আধা-সভ্য বর্বরদের চোখ কপালে উঠে গেল। লোভ ও লালসার বশীভূত হয়ে তারা চাইল এদেশের দখল নিতে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সেই ভূমিপুত্ররা। আর্যরা যাদের চিহ্নিত করল অনার্য নামে। আধা-সভ্য হলেও আর্য্রা এগিয়ে ছিল সামরিক শক্তিতে। তাদের ছিল যুদ্ধের সহায়ক দ্রুতগামী ঘোড়া। ঘোড়ায়-টানা রথ। এবং লোহার তৈরি মস্ত্র-শস্ত্র। বিপরীতে ভূমিপুত্রদের কোনো সামরিক শক্তিই ছিল না। তখনকার শান্তিপ্রিয় নাগরিক সমাজে তার দরকারও পড়েনি। বন্যজন্তু প্রভৃতির হাত থেকে আত্ম্ররক্ষার জন্যে তারা ব্যবহার করত তামার তৈরি কিছু নিতান্ত মামুলি ছুরি তির বল্লম এইসব। সুতরাং সামরিক শক্তিতে বলীয়ান যুদ্ধবাজ আর্যরা প্রায় বিনা প্রতিরোধে একের পর এক নগর ধ্বংস করে সেখাঙ্কার অধিবাসীদের নির্বিচার হত্যা করে তাদের ধন-সম্পদ লুঠপাট করেছিল। আরেকটি জিনিসের উপর আর্যপুত্রদের নজর পড়েছিল। তা হল এদেশের নারী। আর্য-গোষ্ঠীগুলি ছিল পুরুষ-শাসিত এবং পুরুষ-প্রধান। তাছাড়া পথশ্রমের কষ্ঠ-জনিত কারণে গোষ্ঠীগুলিতে নারীর সংখ্যায় বেশি ছিল না।। তাই অনার্যদের সঙ্গে সংঘাতে তাদের পুরুষদের হত্যা বা বন্দি করে দাস বানালেও আর্যযোদ্ধারা সুন্দরী ও সুমার্জিত পুরনারীদের সাদরে জায়গা দিয়েছিল নিজেদের অন্দর-মহলে। এই ঘটনাতে প্রায় অজান্তেই এক ভবিষ্যত সমাজ-বিপ্লবের বীজ রোপিত হয়েছিল। এর পরে অনিবার্য আর্য-অনার্য সংকরায়নের ফলে যে নতুন প্রজন্মগুলি আসতে শুরু করল তাদের উপর মায়ের প্রভাব বেশি হল। সেই সূত্রে বৈদিক-সমাজে অজস্র অনার্য উপকরণ হু হু করে ঢুকতে শুরু করল। একটু খেয়াল করলে পরবর্তী সময়ে রচিত বেদের ঋকগুলিতে তার অনেক নমুনা সহজেই দৃষ্টিগোচর হবে।
ঋকবেদ সংহিতায় মোট সূক্তের সংখ্যা ১০১৭, ঋক ১০৪৭২, তাদের সংকলিত করা হয়েছে ১০টি মণ্ডলে। তথ্য বলছে এদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ওই দাও দাও গোত্রের। বাকিরা একটু অন্য রকম। মাননীয় পাঠক তাদের মধ্যে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি দশম মণ্ডলের এমন কিছু সূক্তের দিকে যাদের সুর একেবারেই অন্য রকম। বা যারা একেবারের বেসুরো। সেগুলি দ্বারা প্রমাণিত হয় অন্তিম মণ্ডলে এসে ঋকবেদের ঋষিদের ভাবনা-চিন্তা কীভাবে এবং কতখানি আপডেটেড হয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় ঋকবেদের ৯০ সূক্তের কথা। অন্যান্য সূক্তে উল্লেখিত এই বিশ্বের সীমানায় দেহধারী বহুদেবতার ভিড়ে হঠাৎ এমন ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এক পুরুষের কল্পনা করা হল, যার শরীরকে আর পৃথিবীর গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা গেল না। সহস্র মাথা, সহস্র চোখ, সহস্র পা নিয়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে তার শরীরকে আরো দশ আঙুল বাড়িয়ে দেওয়া হল। কল্পনা করা হল তারই দেহের নানা অংশ থেকে বিভিন্ন প্রাণী জন্ম নিয়েছে। জানিয়ে দেওয়া হল সেই পুরুষের মুখ হল ব্রাহ্মণ, দু-হাত হল ক্ষত্রিয়, উরু হল বৈশ্য এবং দুই পা হল শূদ্র। আরো বলা হল আকাশ-বাতাস-চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা-অগ্নি-স্বর্গ-মাটি-দিক-ভুবন এসবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে সেই পুরুষ থেকে। এটি পণ্ডিতমহলে পুরুষ-সূক্ত নামে পরিচিত।
এই একটি শ্লোক থেকে তৎকালীন সমাজ-সংগঠনের অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানা গেল- প্রথমত, এতদিন ধরে চলে আসা বহুদেবতার ভাবনাকে নস্যাৎ করে ততদিন বৈদিক ঋষিদের কল্পনায় এক অতি-পুরুষের ছবি উঠে এসেছেদ্বিতীয়ত, সমাজে জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব ঘোষণা, যা কিনা সেই সহস্রশীর্ষা পুরুষের থেকেই আবার সেখানে পরাজিত ও বন্দি অনার্যদের শূদ্র নামে অভিহিত করে সেই সহস্রাক্ষ পুরুষের পদতলে অর্থাৎ আর্য-সনাজের একেবারে নীচের মহলে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, চেতন-অচেতন সবকিছুর সৃষ্টি এক অধি-পুরুষের থেকে যা হয়েছে, যা হবে, সকলি সেই পুরুষ। অর্থাৎ সমাজে পুরুষেরাই প্রধান। আর একটি বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সীমাকে অতিক্রমের চিন্তা। অর্থাৎ গণ্ডি-ভাঙা। আর্য-ঋষির কল্পনায় তাই সেই পুরুষের বিস্তার পৃথিবীর চেয়ে দশ-আঙুল বেশি।  
প্রাকৃতিক নিয়মেই একটা চলমান সমাজের বিকাশ কোনো সময়েই এক জায়গায় থমকে থাকে না। বৈদিক সমাজও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সেখানেও নানা বিপরীত ভাব-ভাবনার দ্বন্দ্ব ও সমন্বয় যে প্রবল ভাবে চালু ছিল তার আরো প্রমাণ পাওয়া গেল পরবর্তী ১২৫ সংখ্যক সূক্তে। এটি পুরুষ সূক্তের পালটা বলে ভেবে নিতে অসুবিধে নয়। পণ্ডিতদের কাছে এটির পরিচিত নাম দেবীসূক্ত। এখানে এসে দেখা গেল পুরুষের বদলে নারী-প্রাধান্য। সূক্তের রচয়িতা বাক নামের ঋষিণী যিনি অম্ভিন-ঋষির কন্যা। এই সূক্তে পরমাত্মার জবানিতে জানিয়ে দিলেন তিনিই সর্বনিয়ন্তা ও সর্বনির্মাতা। তিনিই ঈশ্বর। যারা তাঁকে মানে না তারা ক্ষয় হয়ে যায়। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর মধ্যে এই প্রথম একটা Vs. এসে গেল।
শুধু পুরুষ-সূক্ত বা দেবী-সূক্ত নয়। একটু কান খাড়া করে শুনলে ঋকবেদ সংহিতার আরো বেশ কিছু সূক্ত ভিন্ন সুর যায়। শোনা যায় সরাসরি প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যে দিয়ে আসা কিছু নতুন সংলাপ। বিশেষ করে যে সূক্তগুলির রচয়িতা কোনো ঋষিণী। যেমন একেবারে প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সূক্তটি।এটি একটি কথোপকথন। পতি-পত্নীর  আলাপচারিতা। নারী ও পুরুষের সংলাপ। আশ্চর্যভাবে সম্ভোগকামীর নারী ও পুরুষের প্রতি-বচনে সেখানে প্রথাগত কোনো দেব-দেবীর উপস্থিতি নেই। অগস্ত্য ও তাঁর পত্নী লোপামুদ্রার এই বাক্যালাপের বিষয়বস্তু সেখানে নারী-পুরুষের রতি বা সম্ভোগ, তাই গতানুগতিকাকে অতিক্রম করে সেখানে রতিকেই দেবতা বানানো হয়েছে। প্রথমেই লোপামুদ্রা বলছে বছরের পর বছর রাতদিন অগস্ত্যর সেবা করে সে ক্লান্ত। বয়সের কারণে তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই নারীর যুক্তি দেবতাদের সঙ্গে যে-সব ঋষি সত্যকথা আলোচনা করেন তারাও তো সমানে প্রণয়সুখ সম্ভোগ করেছেন। থই পাননি। সুতরাং সেই সঙ্গমকামী নারির প্রার্থনা তাহলে পুরুষ স্ত্রীর কাছে যাক। উত্তরে অগস্ত্য আর না করতে পারছেন না। তিনি বলছেন আমরা সমস্ত ভোগই উপভোগ করতে পারি। যদিও আমি আপাতত জপ ও সংযম নিয়ে আছি তবু আমার মধ্যে প্রণয় জেগে উঠছে। এখন লোপামুদ্রা তার পতিকে উপভোগ করতেই পারে। সূক্তটির রচয়িতা অগস্ত্য-লোপামুদ্রা।
ঋকবেদে এই প্রথম দেবদেবীকে পাশ কাটিয়ে স্তোত্রের বিষয় হিসেবে উঠে আসছে মানব-মানবীর প্রেম। তাও একেবারে রতির কথা। অর্থাৎ দেব-দেবীর উপাসনার যজ্ঞশালা থেকে ঋষিদের নজর চলে যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর বেডরুমের দিকে।   
পঞ্চম-মণ্ডলের ২৯ সূক্তটিও এক নারীর লেখা।নাম বিশ্ববারা। তিনি অত্রি গোত্রের কন্যা। একজন মহিলা হয়ে পুরুষের পাশাপাশি তিনিও অগ্নিদেবতার উদ্দেশ্যে স্তব উচ্চারণ করছেন। অর্থাৎ পুরোহিতের কাজ করছেন। নারী-সুলভ ভঙ্গিতেই এই শ্লোকের একটি মন্ত্রে সুশৃঙ্খল দাম্পত্য-জীবনের কামনা করা হয়েছে।
এবার আসা যাক অষ্টম-মণ্ডলের ৯১ সূক্তটিতে। এখানে দেবতা সেই বহু-পরিচিত ইন্দ্র হলেও শ্লোকটির রচয়িতা একজন নারী, নাম অপালা। তিনি অত্রি-কন্যা। শ্লোক থেকে  বোঝা যাচ্ছে তার শরীরে চর্মরোগ হয়েছে, এবং স্বামী তাকে পরিত্যাগ করেছে। তার ঠাঁই বাবার ঘরে। জন্মদাতার মাথা কেশশূন্য। এই স্তবে দেখা যাচ্ছে অপালার পক্ষ থেকে যেমন পতি-পরিত্যক্ত নারীদের হয়ে ইন্দ্রের সঙ্গ কামনা করা হয়েছে, তেমনি নষ্ট-ত্বক উজ্জ্বল করার কথা বলা হয়েছে। আবার তাকে চুল গজানোর কামনাও করা হয়েছে।
দশম-মণ্ডলের ৩৯ এবং ৪০ সূক্ত দুটি আরেক নারীর লেখা। তিনি ঘোষা। কক্ষীবান ঋষির কন্যা। তিনি আবার কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। দুটি স্তোত্রের দেবতাই অশ্বিদ্বয়। ঋকবেদের দেবতা হিসেবে সুপরিচিত এই অশ্বজোড়া সব সময়ে একটা সুন্দর রথকে বয়ে নিয়ে যায়। তারা দুজনেই দক্ষ চিকিৎসক। বৃদ্ধকে নবযৌবন দান করে। দুর্গতকে উদ্ধার করে। ঘটকালি করে মেয়েদের বিয়েও দেয়। গাভিকে দুগ্ধবতী করে। এই শ্লোক দুটিতে ঘোষা তাদের বন্ধুত্ব কামনা করে দাম্পত্য-সুখ কেমন তা বুঝিয়ে দিতে বলছে। এই শ্লোকেই নারীদের দেওরকে বিয়ে করার কথা এবং নারীর ব্যভিচারের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ আবার সেই গণ্ডি-ভাঙার কথা।  
দশম-মণ্ডলের ১৪৫ সূক্তটি আবার অন্য রকম। এবং বেশ মজার। সেখানে দেবতার নাম সপত্নীপীড়ন। সপ্তনী মানে তো সতীন। তার মানে সে-যুগে সতীন নিয়ে ঘর-করার ব্যাপার ছিল। আর ছিল সতীনকে বশ করা চিরকালীন বাসনা। সেই ইচ্ছার থেকেই এখানে দেবতার নাম সপত্নী-পীড়ন। মানে যে দেবতার উপাসনা করলে সতীনকে কব্জা করা যায়। আসলে এটি একটি শক্তিশালী লতা বা ওষধি যা প্রয়োগ করে একদিকে যেমন তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে সতীনকে জব্দ করা যায় অন্যদিকে তেমনি স্বামীকেও নিজের বশে আনা যায়। এই স্তোত্র থেকে যেমন বোঝা গেল সেকালেও বহুবিবাহ প্রথা ছিল এবং সেই সব সতীনদের মধ্যে বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। তেমনি নারী মনের আরেকটি আদিম প্রবণতা ওষধি দিয়ে অন্যান্য স্ত্রীদের নীচে নামিয়ে নিজেকে স্বামীর প্রিয়পাত্রী হিসেবে গড়ে তোলার বাসনা। স্বাভাবিক ভাবেই শ্লোকটি একজন নারীর রইত। নাম ইন্দ্রানী। আর এই নারী-রচিত স্তোত্রগুলি দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ঋকবেদের সময়ে সমাজের প্রান্তিক-চেতনা। বোঝা যাচ্ছে সেখানে পুরুষ একাধিপত্যের ভিত ক্রমাগত আলগা হয়েছে। সমাজের নানান পরিসরে জন্ম নেওয়া বিস্তর সংলাপে গড়ে উঠেছে সামাজিক ভাবনার নতুন নতুন ডিসকোর্স। এই ঘটনাকেই তো আমরা আজকের পরিভাষায় আপডেট বলে থাকি।
সত্যি ভাবলে অবাক হতে হয়, সামাজিক ভাবনার লাগাতর বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের ধারায় ঋকবেদ-সংহিতারশবিষয়-আশয় কী আশ্চর্যজনকভাবে বদলে বদলে গেছে। দেবস্তুতির পাশাপাশি সেখানে অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে নর-নারীর প্রণয় ও কামাসক্তির মতো বিষয়।
এই প্রসঙ্গে দশম মণ্ডলের আরো দুটি সংলাপ-ধর্মী সূক্তের কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমে ধরুন দশম-মণ্ডলের দশম সূক্তটি। যম ও যমী যমজ ভাইবোন। এই স্তোত্রে তাদের এক বিশেষ মুহূর্তের কথোপকথন উঠে এসেছে। যমীর মধ্যে জেগে উঠেছে অসম্ভব কাম-ইচ্ছা। পুরুষের সম্ভোগ-কামনার চোটে নিজের সহোদরকেই সে তার শয্যাসঙ্গী হবার জন্যে পীড়াপিড়ি শুরু করে দিয়েছে। সহোদরের সঙ্গে সহবাস করে তার সন্তান গর্ভে ধারন করার জন্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানান যুক্তি খাড়া করে যমীর সে কী কাকুতি-মিনতি। কিন্তু যম সংযত। এমন কুকর্ম করতে সে কিছুতেই রাজি নয়। আদরের বোনকে সে বোঝাচ্ছে ছিঃ, এমন কাজ করতে নেই। করলে পাপ হয়। বুঝুন কাণ্ড, এ-হেন সংলাপও আর্যদের পবিত্র গ্রন্থে জায়গা করে নিয়েছে। অর্থাৎ বেদবাক্য হয়ে গেছে। এবং সংযত যমের সঙ্গে সম্ভোগকামী যমীকেও সেখানে দেবতা বানানো হয়েছে।
এবার আসা যাক দশম-মণ্ডলের ৯৫ সূক্তটিতে। এটি অবশ্য একটি প্রণয়-কাহিনির অংশ-বিশেষ। গল্পটা আমাদের জানা আছে। সেই বিখ্যাত উর্বশী-পুরুরবার নিখাদ কাহিনি। ঋকবেদের এই সূক্তটিই সেই প্রেম-কাহিনির উৎস। মর্ত্যবাস সাঙ্গ করে স্বর্গের অপ্সরী নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছে। পুরুরবা কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। অর্থাৎ একটি বিয়োগাত্মক নাটকের শেষ-পর্ব তার যাবতীয় দুঃখ-বেদনা নিয়ে হাজির। আর্যদের পবিত্র যজ্ঞকর্মে এমন প্রেম কী কাজে লেগেছিল জানি না, তবে এখানে উর্বশী যে কিনা স্বর্গের একজন পরিচিত নর্তকী ও যৌনকর্মী এবং পুরুরবা যে এই মর্ত্যেরই একজন মানুষ (যদিও সে রাজা) শ্লোকের মধ্যে তাদেরকে দেবতা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বৈদিক স্তোত্রে এই প্রথম একজন মানুষ দেবতা হয়ে গেল।
এবার একটু রসের কথায় আসা যাক। বেদে একটাই রস। সোমরস। আমরা জানি তা ছিল এক রকম মদ। বৈদিক-যুগে সুরাপানের প্রতি আর্য-ঋষিদের বিশেষ আসক্তির কথাও আমাদের অজানা নয়। তো ঋষি-মশায়েরা দেব-দেবীর উপাসনায় বসে (রখন পুজো ছিল না।) সেই মদকেও দেবতা বানিয়ে দিল। কল্পনা করুন একটা গোতা মণ্ডলের (নবম মণ্ডল) ১১৪টি সূক্তর সবগুলোই সেই পবমান সোম-দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হল। বেদবাক্য মোতাবেক মদকে দেবতা বানিয়ে তার পুজো করা এটাও একটা আপডেট বইকি।
আবার যে পাথর দিয়ে সোম-লতাকে থেঁতো করে মদ বার করা হত, দেখা যাচ্ছে, দশম-মণ্ডলের ১৭৫ সূক্তে তাদেরকেও দেবতা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রূপবান-গুণবান দেবতাদের দলে এখন পাথরও জায়গা করে নিচ্ছে। তার সঙ্গে তার্ক্ষ্য নামের যে পাখি দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সোম বয়ে নিয়ে যেত সেই বা আর কেন বাকি থাকে, অতএব  তাকেও দেবতা বানানো হল (১০.১৭৮)।
বৈদিক-ঋষিদের মননের কারখানায় দেবতা বানানোর নিয়ম-কানুন যখন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, এবং স্তোত্রকারদের কল্পনা নানান নতুন নতুন দিশায় ছুটতে শুরু করল তখন একই ভাবে দেব-কল্পনা ও তাদের উপাসনায় একটা মৌলিক পরিবর্তন এল। স্তোত্রের বিষয়বস্তু হল ভেষজ-চিকিৎসা, ইন্দ্রজাল বা জাদু, বিবাহসংগীত, অন্ত্যষ্টিবিষয়ক মন্ত্র, পাশাখেলা, অরণ্যানী। এমনকি ক্রোধ, অলক্ষ্মীনাশ, প্রেতাত্মা, গর্ভরক্ষা থেকে গর্ভনাশ, যক্ষ্মারোগনাশ, পাপানাশ, ভয়নাশ, দুর্গতিনাশ, দুর্মতিদূর, দুঃস্বপ্ননাশ, বিষনাশ, কুষ্ঠনাশ, ব্যাঙেদের উল্লাস, ইত্যাদি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এই পরিবর্তনের ফলে এই সব মন্ত্রের বিষয়বস্তু ক্রমশই হয়ে উঠেছে পার্থিব, লোকায়তিক, মানবিক এবং জীবনমুখী। সবচেয়ে মজার ব্যাপার যেটা, দশম-মণ্ডলের ৩৪ সূক্তটি যেটা পড়লে দেখা যাচ্ছে তার বিষট পাশাখেলা এবং সেখানে চলতি নিয়ম মেনে অক্ষকে দেবতা বানানো হল ঠিকই কিন্তু তার সবকটি ঋকেই পাশাখেলার প্রতি আসক্তি মানুষের কতটা সর্বনাশ করে তারই ফিরস্তি। অর্থাৎ সেখানে পাশা দেবতা বানিয়ে সুললিত ছন্দে পাশাখেলার নিন্দা করা হচ্ছে। দেব-স্তুতির বদলে দেব-নিন্দা ঋকবেদেব এই পাশ ফিরে শোয়া সত্যিই অবাক করার মতো ঘটনা। বোঝা যাচ্ছে যে প্রত্যয় নিয়ে ঋকবেদ রচনা শুরু হয়েছিল সময় বদলের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তার স্বরূপ একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আর এই বদলের পিছনে কাজ করে চলেছে আর্য-সভ্যতার ক্রম-অনার্যায়ন।
এই প্রক্রিয়াকে অনেকেই ভারতীয় সভ্যতার আর্যায়ন বলেন কিন্তু আমি তাকে এই কারণে অনার্যায়ন বলতে চাইছি, যে ওই সময়ে অনার্য-সভ্যতার কোনো দলিল আমাদের সামনে নেই, আছে আর্য-সভ্যতার নিদর্শন, তারাই ছিল শাসক। সেই নিদর্শন থেকে বোঝা যাচ্ছে আর্য-সভ্যতার গতিপথ বদলে যাচ্ছে আর তার কারণ অবশ্যই তার মধ্যে স্থানীয় প্রভাবগুলি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। নানান পরিসরে অজস্র বিপরীত শক্তির সংঘর্ষ ও সমন্বয়ে যে নতুন নতুন সংলাপ তৈরি হচ্ছে তার ফলে খুব নীরবে ঘটে চলেছে আর্য-অনার্য সংকরায়ন। তথাকথিত উচ্চ-মার্গ ছেড়ে সভ্যতার এই ক্রমশ নিম্নগামী হওয়ার এই প্রক্রিয়াকেই এখন খুব স্পষ্ট করে আর্য-সভ্যতার অনার্যায়ন বা প্রান্তিকায়ন বলতে পারি।
এখানে অবশ্যই স্মরণ করা দরকার অনার্যরূপে চিহ্নিত এদেশের ভূমিপুত্ররা আর্যদের আসার অনেক আগেই গড়ে তুলেছিল এক সুপরিকল্পিত ও সুগঠিত নগর-সভ্যতা। যে নগর-সভ্যতা টিকে ছিল প্রায় দেড়-হাজার বছর। সুতরাং তারা বিদ্যা-বুদ্ধিতে ঢের এগিয়ে ছিল। কিন্তু আর্যদের সামরিক-শক্তি ও উন্নত ভাষা-কাঠামোর মোকাবিলা করতে না পেরে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব আর্য-মননকে ক্রমশই গ্রাস করে নিচ্ছিল। 
ঋকবেদের শেষ দিকে দেখা গেল বৈদিক ঋষিদের কেউ কেউ কর্মকাণ্ডের গতানুগতিকতা ও যান্ত্রিকতার দমবন্ধ রীতি-নীতি এবং একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। তারা প্রথাগত স্তুতি-বন্দনা থেকে সরে এসে বুদ্ধিবৃত্তি অর্থাৎ জ্ঞানের চর্চা করতে চাইছে। তাদের মধ্যে জেগে উঠছে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহ। তাদের মননে জন্ম নিচ্ছে নানান জিজ্ঞাসা। তারা প্রাতিষ্ঠানিকতার অচলায়তনকে প্রশ্ন করতে চাইছে। চ্যালেঞ্জ করতে চাইছে। জন্ম নিচ্ছে এক নতুন দর্শনের অভিমুখ।
যেমন দশম-মণ্ডলের ১২১ সূক্তটি। এটি পণ্ডিতমহলে বহু-আলোচিত বহু-চর্চিত 'কস্মৈ দেবায়' সূক্ত নামে পরিচিত। সেখানে দশটি ঋকের মধ্যে ন-টির শেষেই প্রশ্ন করা হল কোন দেবতাকে কোন হবি দিয়ে পুজো করা হবে। অবশেষে দশ নম্বর ঋকে এতদিনের পরিচিত সব দেবতা ইন্দ্র-মিত্র-বরুণ ইত্যাদিকে নস্যাৎ করে জানিয়ে দেওয়া হল এক নতুন দেবতার নাম। তিনি প্রজাপতি। বলা হল প্রজাপতি ছাড়া আর কেউ সব উৎপন্ন বস্তুকে আয়ত্ব করতে পারেনি।
তবে ঋকবেদে দার্শনিক-চিন্তার হদিশ পেতে গেলে অবশ্যই বলতে হবে ১২৯ সূক্তের কথা। সেখানে গতানুগতিক দেব-দেবীর স্তুতি-বন্দনা থেকে বেরিয়ে এসে প্রাচীন ঋষি এক নতুন ভাবনার সূত্রপাত করতে চেয়েছেন। এক অন্য রকম চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে তিনি চেষ্টা করেছেন সৃষ্টি-রহস্যকে জানতে ও ব্যাখ্যা করতে। প্রশ্ন করেছে – "ইয়ং বিসৃষ্টিঃ কুত আবভূব"। অর্থাৎ এই সৃষ্টি কোথা থেকে এল। সেখানে সৃষ্টি রহস্যের মীমাংসা করতে গিয়ে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হল, শ্রদ্ধেয় রমেশ্চন্দ্র দত্তর অনুসরণে তার বাংলা করলে বলা যায় – "সেকালে যা আছে তাও ছিল না, যা নেই তাও ছিল না। পৃথিবী ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কী ছিল? কোথায় তার জায়গা ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কী তখন ছিল? তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না। কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারী আত্ম ছাড়াই কেবল আত্মাকে অবলম্বন করে নিশ্বাসপ্রশ্বাসযুক্ত হয়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি ব্যাতীত আর কিছুই ছিল না। রাত ও দিনের ফারাক ছিল না। প্রথমে অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার ঢাকা ছিল। সবকিছু চিহ্নবর্জিত তার চারদিকে জলের তলায় ছিল। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সেই সর্ব্ব্যাপী আচ্ছন্ন ছিল। তপস্যার প্রভাবে সেই এক বস্তু জন্মিলেন...। ইত্যাদি।" তবে এই স্তোত্রের শেষ মন্ত্রটিকে চরম হেঁয়ালিপূর্ন করে সৃষ্টি-রহস্য নিয়ে এক চিরকালীন দার্শনিক অমীংসার জন্ম দেওয়া হল । - "... এই যে নানান সৃষ্টি তা কোথা থেকে হল, কার থেকে হল, কে সৃষ্টি করল, কী করল না, সেসব তিনিই জানেন যিনি তার প্রভুর মতো পরমধামে আছেন। অথবা তিনিও জা-জানতে পারেন"। কী আশ্চর্য- যাকে সৃষ্টিকর্তা বলে কল্পনা করা হল, বলা হচ্ছে তিনি সৃষ্টি-রহস্য জানতে পারেন আবার নাও জানতে পারে। সুধী পাঠক, বুঝুন, যিনি কিনা ঋকবেদের এক ভূয়োদর্শী ঋষি তিনিও তাঁর শ্লোকে এক সংশয়ের জন্ম দিচ্ছেন। অর্থাৎ নাস্তিকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। পণ্ডিতমহলে এই সূক্তটি নাসদীয়-সূক্ত নামে সুপরিচিত।
লক্ষ করার বিষয় উপরে উল্লেখ করা অন্য রকম সূক্তগুলিতে যেমন মানবমনের নানান জিজ্ঞাসা জায়গা পেয়েছে, তেমনি জেগে উঠেছে বুদ্ধিশক্তি ধীশক্তি ইচ্ছাশক্তি এবং মুক্তচেতনা। সেখানে মুর্ত থেকে বিমূর্তে তথা ভেদ থেকে অভেদে উত্তীর্ন হবার কথাও কিছু আছে। এই সূক্তগুলি রচিত হয়েছিল ঋকবেদ-সংহিতার একেবারে শেষের দিকে। সুতরাং আবার বলতে হচ্ছে ঋষিদের বুদ্ধিবৃত্তিতে এইসব বদলের পিছনে তুমুল অনার্য-ভাবনার প্রভাব কোনো কষ্ট-কল্পনা নয়।
আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে ঋকবেদ-সংহিতা ভেদ থেকে অভেদের দিকে যাত্রার সূচনামাত্র। স্তোত্রগুলি নাড়াঘাটা করলে বোঝা যায় সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রতিষ্ঠানবাদীদের পক্ষ থেকে বেদ অনাদি-অনন্ত, বেদ কোনো মানুষের লেখা নয়, বেদের কথা অলঙ্ঘনীয় কারণ তা অপৌরুষেয় ইত্যাদি-প্রভৃতি বলে বেদকে যতই একটা ব্র্যান্ড-নেমের ভিতর আবদ্ধ করার চেষ্টা করুক না কেন, বেদ নিজেই কখনো এইসব তথাকথিৎ বেদবাক্য মেনে চলেনি। বেদ আকাশ থেকে খসে পড়া নয়, অপৌরুষেয়ও নয়। সেখানে যা আছে তা হল সেই সময়কার সমাজ ও মানবজীবনেরই নানান টানাপোড়েন না ওঠানাম নানান হয়ে ওঠার অজস্র সংবাদ। আছে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে কীভাবে বদলে গেছে তার ভাষ্য সেসব কথাও। এবং এসবই সেই সময়ের মানুষরাই রচনা করে গেছেন।
এতক্ষণের আলোচনায় সুধী পাঠকদের কাছে আমি একটা ধারণ দিতে চেষ্টা করলাম কীভাবে ঋকবেদ-সংহিতার নানান শ্লোকে প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনকে, গতানুগতিক প্রত্যয়ের বৈধতাকে, ঘ্যানঘ্যানে-প্যানপেনে একঘেয়েমিকে প্রশ্ন করা হচ্ছে প্রতিযুক্তি তুলে এনে নতুন আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো হচ্ছে। ফলে নতুন নতুন চিন্তার ডিসকোর্স তৈরি হচ্ছে। মুক্ত ভাবনার আবহ তৈরি হচ্ছে।
এই নতুন ডিসকোর্সের একটা স্পষ্ট অবয়ব পাওয়া গেল পরবর্তী পর্যায়ে রচিত উপনিষদগুলিতে। সেখানে আর নানান আকার-বিশিষ্ট চিহ্নে-বর্ণে আলোকিত বৈদিক দেবতারা রইলেন না, তাদের হঠিয়ে দিয়ে নতুন প্রজন্মের ঋষিদের আধ্যাত্মিক কল্পনায় জায়গা করে নিল জগতের সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে থাকা এক নিরাকার। বলা হল সর্বভূতের চৈতন্যস্বরূপ এক ও অদ্বিতীয় সেই-তিনি সব সময়ে সকলের আগে রয়েছেন। ইন্দ্রিয়সমূহও তার নাগাল পায় না। তিনি নিজে স্থির থেকেও অন্য সকলকে অতিক্রম করে যান। শূন্যের দেবতা হিরণ্যগর্ভরূপে তিনি এই স্থূল ও দৃশ্যমান জগতের সবকিছুকে ধরে রেখেছেন। তার নাম ব্রহ্ম। তার কোনো লিঙ্গভেদ নেই।

একথাও স্বীকার করে নেওয়া হল জগতের সবকিছুই ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে।
   
পণ্ডিত-মহলে একথা সুবিদিত বেদের কর্মকাণ্ডের পর আর্য-অনার্য সংকরায়নের ফলে বৈদিক-মুনি ঋষিদের চিন্তা-ভাবনার জগতে ঘটে গিয়েছিল এক বুদ্ধি-বিপ্লব। সে কারণেই এই সুইপিং চেঞ্জ। এই বিপ্লবের ফলেই বৈদিক-সংস্কৃতি পরিবর্তিত হল ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতিতে। পরবর্তীতে দেখা গেল বুদ্ধি-বিপ্লবের গর্ভে জন্ম নেওয়া সেই ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতি কখন যেন নিজেই এক অচলায়তনে পরিণত হয়েছে। সেই অচলায়তন ভাঙতে জন্ম নিচ্ছেন বুদ্ধদেব।