ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৮) ০ মুরারি সিংহ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবীকালের মধ্যে এখনো
ভীষণ ভাবে বেঁচে আছেন। তাঁর সেই গণগণে বেঁচে থাকার আঁচ প্রতিদিন টের পাওয়া যায়
আমাদের রোজকার নানান কাজকর্মের ফাঁক-ফোঁকরে – আমাদের আনন্দের, শোকের, ক্লান্তির,
হতাশার নানান ঘনিষ্ট মুহূর্তে। ভাবীকালের সঙ্গে কবিগুরুর এই-যে নিকট-সম্পর্ক তা
কেন এবং কীভাবে তৈরি হয়েছিল তা জানতে গেলে সমসময়ের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধের রসায়নটাও
একটু বোঝা দরকার। ইউরোপীয় মডার্নিজিমকে
রবীন্দ্রনাথ খুব কাছ থেকে দেখেছেন তার ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করেছেন কিন্তু কখনোই
তাকে অকুণ্ঠচিত্তে মেনে
নিয়ে সেই হুজুগে গা ভাসিয়ে দেননি। এটা কি তাঁর নিজের
কালের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে প্রাচীন হবার লক্ষণ? সেই যে নতুন সময়। যখন জীবনের
প্রতি পদক্ষেপে সংশয় সন্দেহ জিজ্ঞাসা যুক্ত-তর্ক বিক্ষোভ বিদ্রোহ আত্মবিরোধ অনিকেত
মনোভাব চারপাশে কেমন যেন একটা অসুস্থ আবহাওয়া। নতুনের নামে তাকেও কি মেনে নিতে
হবে! এনিয়ে তিনি নিজেও বিস্তর টানাপোড়েনে ছিলেন। কারণ মানুষের বার্ধক্য সম্পর্কে তিনি
ভালোমতো ওয়াকিবহাল ছিলেন। “পঞ্চাশের
পরে বানপ্রস্থের প্রস্তাব মনু করেছেন। তার কারণ মনুর
হিসাবমত পঞ্চাশের পরে মানুষ বর্তমানের থেকে
পিছিয়ে পড়ে। তখন কোমর বেঁধে ধাবমান কালের সঙ্গে সমান ঝোঁকে পা ফেলে চলার বেগে
যতটা ক্লান্তি ততটা সফলতা থাকে না, যতটা ক্ষয় ততটা পূরণ হয় না। অতএব তখন থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে থাকে সেই সর্বকালের মোহানার দিকে যাত্রা করতে হবে
যেখানে কাল স্তব্ধ। গতির
সাধনা শেষ করে তখন স্থিতির সাধনা”। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো বরাবর গতিরই সাধক। তাই বিদেশি
লুঠেরাদের নেতিবাদী আধুনিকতা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব দেখালেও সেই
সময়ের যে তরুণরা সেই আধুনিকতাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল তাদের কিন্তু তিনি অশ্রদ্ধা
করেননি। অনাদর করেননি। কবি বললেন – “আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে কাউকে কাউকে
দেখেছি যাঁরা আধুনিক ইংরেজি কাব্য কেবল যে বোঝেন তা নয়, সম্ভোগও করেন। তাঁরা
আমার চেয়ে আধুনিক কালের অধিকতর নিকটবর্তী বলেই য়ুরোপের আধুনিক সাহিত্য হয়তো তাঁদের কাছে
দূরবর্তী নয়। সেইজন্য তাঁদের সাক্ষ্যকে আমি মূল্যবান বলেই শ্রদ্ধা করি”। অবশ্য সেই সঙ্গে কবি
তার সংশয়কেও গোপন রাখলেন না। “কেবল একটা সংশয় মন থেকে যায় না। নূতন যখন
পূর্ববর্তী পুরাতনকে উদ্ধতভাবে উপেক্ষা ও প্রতিবাদ করে তখন দুঃসাহসিক তরুণের মন
তাকে যে বাহবা দেয় সকল সময়ে তার মধ্যে নিত্যসত্যের প্রামাণিকতা মেলে না। নূতনের
বিদ্রোহ অনেক সময় একটা স্পর্ধামাত্র”। চিরনতুনের
প্রতি রবীন্দ্রনাথের বরাবরের পক্ষপাত আমাদের অজানা নয়। অতীত
গৌরবের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাও সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই নতুনকে মেনে নিতে
না-পারার সপক্ষে নিজের প্রত্যয় ব্যক্ত করে সেদিনের যুবক
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যাঁকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘আকাশপ্রদীপ’ উৎসর্গ করতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন-
“বয়সে তোমাকে অনেক দূরে পেরিয়ে এসেছি তবু তোমাদের কালের সঙ্গে আমার যোগ লুপ্তপ্রায়
হয়ে এসেছে, এমনতরো অস্বীকৃতির সংশয়বাক্য
তোমার কাছ থেকে শুনি নি! তাই, আমার রচনা তোমাদের কালকে
স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের
সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো”, সেই আধুনিক কবিকেই একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন–“আমার
মতে সেদিন ইংরেজি সাহিত্যে আমার মন যে অবাধ প্রবেশ লাভ করেছিল তার কারন ছিল
সেযুগের সাহিত্যের অন্তরে। তার মধ্যে সার্বজনীন আমন্ত্রণ ছিল, আতিথ্য ছিল। যেখানে
আতিথ্য নেই সেখানে ঐশ্বর্যের পরিচয় নেই। ভিতরে সেখানে ভৈরবীচক্র বসে, সে কিন্তু
যজ্ঞ নয়, সেখানে বাইরের লোককে রুদ্ধদ্বারের বাইরে বসিয়ে রেখে দেয়”। আধুনিকতা বলতে রবীন্দ্রনাথের কাছে
সময়ের চেয়ে মর্জিটাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল, আধুনিকতার কাছে তিনি চেয়েছিলেন ব্যক্তিগত খুশির দৌড়
কিন্তু ক্রমশই উপলব্ধি করলেন আধুনিকতার নাম করে কেমন করে নানাজনের যে আলাদা আলাদা
বিচিত্র অভিরুচি তাদের একেবারে চাপা দিয়ে একটা মণ্ড তৈরি করে তারপর তাকে ছাঁচে
ফেলে নিখুঁত কেতা-দুরস্ত পুতুল তৈরির চেষ্টা চলছে। তাই রবীন্দ্রনাথের আর আধুনিক
হওয়া হল না, হয়ে গেলেন অন্যকিছু, এবং এমন কিছু যা তাকে আজকের প্রজন্মের মনেও
বাঁচিয়ে রেখেছে।