Tuesday, September 6, 2016

পোস্টমডার্ন ও বৌদ্ধধর্ম ০০ মুরারি সিংহ

পোস্টমডার্ন ও বৌদ্ধধর্ম  ০০  মুরারি সিংহ

বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে লিখতে বসে তার শুরুতে রাখতে চাইছি এই বঙ্গভূমির শাক্ত-কবি রামপ্রসাদ সেনের সেই বিখ্যাত পদটি
                                       মন রে কৃষি-কাজ জান না।
এমন মানব-জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা।।
 তথাগত-প্রসঙ্গে এই পদটির কথা স্মরণ করলাম একটা বার্তা বুঝে নেবার জন্যে। সেই বার্তাটি হল প্রাক-আধুনিক যুগে সাধক-কবি রামপ্রসাদ মানব-জমিনকে আবাদ করার কথা বলেছিলেন, আর সেই আবাদ দক্ষ হাতে কী ভাবে করা যায়, তার কৃৎ-কৌশল, রামপ্রসাদেরও বহু আগে, পরবর্তী বৈদিক যুগে শাক্যমুনি বুদ্ধদেব মানব-সমাজকে হাতে-কলমে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।
তাই বলা যায়, বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রথাগত ছককে অতিক্রম করে গৌতম-বুদ্ধ ধর্মের যে নতুন পরিসর তৈরি করলেন সেখানে বৌদ্ধধর্ম মানে যেমন একদিকে নিজের মধ্যে নিজেকে খোঁজা অর্থাৎ আত্ম-অনুসন্ধান, আত্ম-বিশ্লেষণ এবং নিরন্তর আত্ম-পরিশুদ্ধির মধ্যে নিজেকে মগ্ন রাখা বা এককথায় সুনিপুন ভাবে রামপ্রসাদ-কথিত সেই চাষের জমিটা তৈরি করা, তেমনি অন্যদিকে বৌদ্ধধর্ম মানে মানুষের হৃদয়ে মানুষের জন্যে দয়া, করুণা, অহিংসা, মৈত্রী, কল্যাণ এবং সবার উপরে মানবপ্রেম এই সবকিছুরই এও এক অফুরন্ত আবাদ 
বোঝাই যাচ্ছে, এই আবাদ পুরোপুরি মানসিক। আর এই আবাদের ফসল হল, ব্যক্তি-মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্ট-জ্বালা-যন্ত্রণা-হতাশা থেকে মুক্তি এবং টানা-পোড়েণহীন এক সমাজ। তাই বৌদ্ধধর্ম মানে জীবন সম্পর্কে কোনো নেতিবাদ নয়। বৌদ্ধধর্ম মানে হিংসা নয়, অসহিষ্ণুতা নয়, স্বার্থপরতা নয়। বৌদ্ধধর্ম মানে উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা-হতাশা-বিরক্তি-বিতৃষ্ণা-ক্লান্তি-ভয়-গ্লানি কোনো কিছুই নয়। বৌদ্ধধর্ম মানে ব্যক্তি-মানুষের মনে শুভ-ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ বিকাশ। বৌদ্ধধর্ম মানে মানুষের মনে স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তার এক অনির্বাণ আলোক-জ্যোতির প্রজ্জ্বলন।   
শরীরকে সুগঠিত ও পেশিবহুল করতে যেমন শরীরের ব্যায়ামের দরকার হয়, তেমনি মনকে সুগঠিত ও পেশিবহুল করতেও দরকার হয় মনের ব্যায়াম। বুদ্ধের বাণী, বচন, উপদেশ সেই মনের ব্যায়ামেরই এক পথ-নির্দেশিকা। 
আমরা জানি, বৌদ্ধধর্মের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে। এই ভারতীয় উপমহাদেশেরই এক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক রাজ্যে। বর্তমান সময়ে শাক্যমুনির প্রবর্তিত এবং প্রচারিত সেই ধর্ম নিয়ে আলোচনার যৌক্তিকতা নিয়ে বলতে গিয়ে এখানে জানাতে হয় যে, এই পোস্টমডার্ন কালখণ্ডে এসে আজ একবিংশ শতকের বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান অশান্তি-হিংসা-হানাহানি-হত্যা-উগ্রপন্থার ভয়ংকর সময়ে দাঁড়িয়ে, সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে, আড়াই-হাজার বছর আগের ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া অথচ আজো সমান তাজা সেই ধর্ম তার নিজস্ব প্রাণশক্তির জোরে আরো আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
পাশাপাশি আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে ঠিকঠাক বুঝে নিতে হলে আমাদের যেমন বুঝে নেওয়া দরকার আমাদের ঘিরে থাকা বর্তমান সংস্কৃতি-বিশ্ব সম্পর্কে বিশ্ব-মতামত কী, তেমনি নতুন প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনার প্রকৃত ছাঁদটাই বা কী, সেটার হদিশ পাওয়াটাও সমান জরুরি
এই হদিশ পাবার জন্যেই এখানে আমি বেছে নিচ্ছি পোস্টমর্ডানিজিমকে। এখানে পোস্টমডার্ন মানে সময়ের দিক থেকে আধুনিকের পরবর্তী বা উত্তর-আধুনিক কোনো ব্যাপার-স্যাপার নয় বরং আধুনিকতার থেকে উত্তরণ। মানে আধুনিকতার তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে তাঁর বিকল্প চিন্তা-ভাবনা। 
এই আধুনিকতা মানে ইউরো-আমেরিকান আধুনিকতা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির পক্ষ থেকে যা জোর করে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছিল তাদের নানান উপনিবেশে। আজকের বিচারে আধুনিকতা একটা চূড়ান্ত অসফল ঘটনা। তাই পোস্টমর্ডানিজিম মানে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসা। আধুনিক মানুষ যে যে বিষয়গুলোতে বিশ্বাস রেখেছিল তার থেকে সরে আসা। যে যে বিষয়ে আধুনিকতা ব্যর্থ হয়েছে সেগুলোকে তুলে ধরা। যদিও আমরা এখনো যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে বাস করছি সেখানে আধুনিকতার বিস্তর টানা-পোড়েনই আমাদের বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। ঔপনিবেশিক-অবশেষ থেকে এই সমাজ এখনো মনে-প্রাণে বেরিয়ে আসতে পারেনি। 
আমরা জানি, আধুনিক সময়ের ইউরোপে ইজ্‌ম-এর এক মহাবিস্ফোরণ হয়েছিল। তবে এর আগের অনান্য ইজমগুলির চেয়ে পোস্টমডার্নিজিম আমাদের সমসাময়িক সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক বেশি অবহিত করেএই পোস্টমডার্নিজিমই এই সময়ের যাবতীয় সংবাদ-মাধ্যম, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মতামতকে  পুষ্টি জোগাচ্ছে সুতরাং তার নিরিখে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে একটি আলোচনাও আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ সময়ে সময়ে বৌদ্ধ নির্বাণ নাগার্জুনের শূন্যতা ছুঁয়ে পোস্টমডার্ন বিনির্মাণ-এ এসে মিশে যাচ্ছে।
অনেকের মতে পোস্টমর্ডানিজিম ইউরো-আমেরিকার ব্যাপার সুতরাং তা নিয়ে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মাথা না ঘামানোই ভালো। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে এ-কথাটাও বুঝে নেওয়া জরুরি যে এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে এই ধরণের সব ভেদাভেদ, অর্থাৎ এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা বা প্রথমবিশ্ব, দ্বিতীয়বিশ্ব, তৃতীয়বিশ্ব, আধুনিকতার এইসব অভিধা দ্রুত মুছে যাচ্ছে। প্রযুক্তি-বিপ্লবের কল্যাণে এখন পৃথিবী একটা ভুবন-গ্রাম। সেখানে সবাই এখন বিশ্ব-নাগরিক এবং যে কোনো বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার ও মতামত জানানোর অধিকার এবং সুযোগ সব মানুষেরই সামনেই সমান ভাবে খোলা।  অর্থাৎ কোনোকিছুই আর মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের কুক্ষিগত নয়, যেটা আধুনিক সময়ে আমরা দেখেছি। তাই আমরা এখন পোস্টমডার্ন চিন্তা-চেতনার ভিতর জলের রুপোলি-ফসলের খোঁজে অনায়াসে আমাদের জেলে-ডিঙি ভাসিয়ে দিতে পারি কারণ পোস্টমডার্নিজিম মানেও শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়ায় তা সেই রামপ্রসাদ-কথিত মানবজমিনের চাষ।
ধর্মের কথা যদি বলি, তাহলে দেখব আধুনিকতাবাদীদের একটা অংশ যেমন খ্রিশ্চানধর্মকে সর্বশক্তিমান এবং বাইবেলকে মনে করেছিল নৈতিকতার চরম মানদণ্ড তেমনি আরেকটি অংশ ধর্মকে আফিং বলেছিল। আবার অনেকেই এই ধর্মীয় টানাপোড়েনের মধ্যে সামিল না হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ খুঁজতে চেয়েছিল। কিন্তু খ্রিশ্চান ধর্মের নীতিবোধ কতটা ফাঁপা এবং আফিং বলে জীবন থেকে ধর্মকে বাদ দেবার ফলটা যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধে দু-দুটো পারমাণবিক বোমা ফাটানোর মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশ পেয়ে গেছে। পৃথিবীর মানুষ টের পাচ্ছেন, মানুষে মানুষে হানাহানি রেষারেষি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে প্রতিটি মানুষকেই নিজের আত্মিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে, নিজেকে মনে-প্রাণে পবিত্র রাখতে হবে এবং সেই পবিত্র থাকতে হলে মানুষকে অবশ্যই ধর্মের শরণ নিতে হবে।
তাই পোস্টমর্ডানিজিম আবার অভিমুখ বদলে ফেলে অ-ধর্মনিরপেক্ষ হতে চাইছে। 
এই অ-ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে ঝুঁকে পড়ার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেউ কেউ বলছেন আধুনিক যুগে যে সব নতুন ঠাকুর-দেবতাকে আমদানি করা হয়েছিল, অর্থাৎ পুঁজিবাদ অথবা সমাজতন্ত্র, নগরায়ন, উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, সারা পৃথিবীর কোণে কোণে জনপ্রিয়-পাশ্চাত্য-সংস্কৃতির-তুমুল-বিস্তার -- এসব কোনো কিছুই তো আর সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাতে পারল না, বরং তা বহুগুণে বেড়ে গেল, সুতরাং আবার সাবেক দেবতাদেরই শরণ নেওয়া যাক। 
এই ভাবে ধর্মের পথে হাঁটতে গিয়ে কেউ কেউ আঁকড়ে ধরতে চাইছেন ধর্মীয় মৌলবাদ। যার ফলে মাথা চাড়া দিচ্ছে হিংসা, ঘৃণা, ধর্মীয় উগ্রপন্থা। আবার অনেকেই খ্রিশ্চান-ধর্মের প্রতি অন্ধ-আনুগত্য থেকে সরে এসে সন্ধান শুরু করেছেন একটা নতুন ধর্মের।
এই ভাবনা-চিন্তা থেকেই এই সময়ের মানুষের কাছে একটা নতুন অনুসন্ধান জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে যে, মানব-সমাজ ও সভ্যতা তো আর গলে-পচে শেষ হয়ে যায়নি, সুতরাং এমন একটা ধর্ম প্রয়োজন যা মানুষকে আন্তরিক ভাবে পবিত্র হতে শেখাবে। আপাদমস্তক শুদ্ধ বানাতে পারবে। প্রকৃত মানুষ বানাতে পারবে।
সুতরাং এদিক দিয়েও বৌদ্ধধর্মের দিকে নজর দেবার দরকার আছে, কারণ নতুন যুগের সেই নতুন ধর্ম, তথাগতের বাণী ও উপদেশ থেকেও উঠে আসতে পারে।
বুদ্ধদেবের ধর্ম বা দর্শন সম্পর্কে নতুন আলোচনা শুরু করার আগে এর আগে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমার পোস্টমডার্ন ও চর্যাপদ বইটির একজায়গায় কিছু কথা লিখেছিলাম, পাঠকদের অবগতির জন্যে প্রথমেই তা এখানে তুলে আনছি
ভারতীয় দর্শনের প্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যায় ভারতীয় দর্শনকে যে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে অর্থাৎ আস্তিক ও নাস্তিক, তার মধ্যে বৌদ্ধদর্শন দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। দর্শন-বইয়ের পাতা উলটে দেখা গেল এখানে আস্তিক মানে ঈশ্বর-বিশ্বাসী নয়, আস্তিক মানে যে সব দর্শন বেদ-নির্ভর অর্থাৎ বেদকে প্রধান বা প্রমাণ হিসেবে মেনে নেয়, স্বভাবতই তাহলে নাস্তিক মানে দাঁড়াল বেদ-বিরোধী। যেহেতু সেই সময়ে  বেদ মানেই এক প্রতিষ্ঠান, অতএব বৌদ্ধদর্শন প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, বামপন্থী।
বৌদ্ধদর্শন বেদ-ভিত্তিক প্রমাণ ও অনুশাসনগুলিকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করে। অর্থাৎ তা অবৈদিক। এবং শুধু বেদ-বিরোধী নয় একেবারে ঘোরতর বেদ-বিরোধী। অর্থাৎ যাকে বলা হয় চরমপন্থী।
জ্ঞান ও তত্ত্ব সম্পর্কে নানান দার্শনিক আলাপ-আলোচনাকে একেবারে নস্যাৎ করে বুদ্ধদেব বললেন, সেইসব জ্ঞান ও কর্মই প্রয়োজনীয় যা জীবনমুখী, অর্থাৎ মানুষের জীবনের নান দুঃখ কষ্ট ও সমস্যার সমধান করার পক্ষে যা উপযোগী এবং যাকে প্রয়োগ করা যায়। কারণ শুধুমাত্র খটমট জ্ঞান বা বায়বীয় তত্ত্বের আলোচনা মানুষকে শুদ্ধ করে না, তাকে মুক্ত করে না। সে-রকম জ্ঞান বা তত্ত্বে মানুষের কামনা-বাসনার নিবৃত্তি হয় না, চিত্তও শান্ত হয় না। এককথায় জীবনের সঙ্গে এই রকম সব তত্ত্ব ও জ্ঞানের কোনো যোগ নেই। তাই বুদ্ধদেব তাদের বর্জন করলেন।
মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্টের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে বুদ্ধদেব জোর দিলেন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপর। কী করে মানুষ জীবনের নানান দুঃখ-কষ্ট-সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে নির্দেশ দিলেন সেই পথের।
বৌদ্ধধর্মে তাই প্রাধ্যান্য পেয়েছে কল্যান ও মৈত্রী। প্রাধান্য পেয়েছে অহিংসা ও প্রেম।
অর্থাৎ পীড়িত ও আর্ত মানবের দুঃখ-কষ্টের উপর ভিত্তি করেই একদিন জন্ম নিয়েছিল বৌদ্ধ-দর্শন। যার মূল কথাই হল -
১.        মানুষের জীবনে দুঃখ আছে,
২.        সেই দুঃখের কারণ আছে
৩.       দুঃখের নিরসন আছে,
৪.        দুঃখ নিরসনের উপায় বা পথও আছে,
এই হল বৌদ্ধ-দর্শনের চারটি আর্য-সত্য। আর মানুষের জীবনে দুঃখ নিরসনের যে পথ, আমরা জানি বৌদ্ধ-দর্শনে তা অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামেই পরিচিত। সেই অষ্টাঙ্গিক মার্গগুলো হল
          এক.     সম্যক দৃষ্টি         অর্থাৎ       Right Vision
          দুই.      সম্যক সংকল্প           অর্থাৎ       Right Resolve
তিন.     সম্যক বাক               অর্থাৎ       Right Speech
চার.      সম্যক কর্মান্ত            অর্থাৎ       Right Conduct
পাঁচ.      সম্যক আজীব           অর্থাৎ       Right Livelihood
ছয়.      সম্যক       ব্যায়াম      অর্থাৎ       Right Exercise
সাত.     সম্যক       স্মৃতি     অর্থাৎ       Right Mindfulness
আট.     সম্যক    সমাধি       অর্থাৎ       Right Concentration
অষ্টাঙ্গিক মার্গের এই তালিকাতে মানুষের জীবনে দুঃখ নিরসনের পথ হিসেবে যে যে কাজগুলো করার কথা বলা হয়েছে তার থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় বৌদ্ধদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি কতখানি ইতিবাচক।
এখানে বলা দরকার যে সারা পৃথিবীতে হিন্দুধর্ম, খ্রিশ্চানধর্ম, ইসলামধর্ম এই রকম অন্যান্য যে সমস্ত জনপ্রিয় ধর্মগুলি আছে তাদের মধ্যেও ইতিবাচক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু অভাব নেই। কোনো ধর্মমতই মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না। প্রত্যেকেই বলে সত্যকে অনুসন্ধান করতে, অসৎ তথা দুষ্টকে বিনাশ করতে। প্রত্যেক ধর্মই বলে ধ্যানের কথা, সাধনার কথা, জ্ঞানলাভের কথা, ত্যাগের কথা। প্রত্যেক ধর্মের মূলকথা মানবপ্রেম।
বৌদ্ধধর্মও সেকথাটাই বলে, তবে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে অন্য সকল ধর্মমতের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। যাদের মধ্যে প্রধানতম হল, অন্য ধর্মগুলি ঐকান্তিক ভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, অলৌকিকতায় বিশ্বাস করে, ভাগ্যে বিশ্বাস করে, পাপ-পুণ্যে বিশ্বাস করে, স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করে। তাই সবসময় সব ব্যাপারে অন্যান্য ধর্মের একটা সাধারণ প্রবণতাই হল মানুষকে ঈশ্বর-নির্ভর করে তোলা, শাস্ত্র-নির্ভর করে তোলা, ধর্ম-নির্ভর করে তোলা। বৌদ্ধধর্ম সেটা করে না। ঈশ্বর আছে কী নেই এমন কোনো কূটতর্কে যাবা কোনো আগ্রহই তাঁর নেই।
আবার দেখুন, আধুনিক ইউরোপের ধর্মানুরাগী মানুষেরা দাবি করেছিল যিশুই সমস্ত মানবের একমাত্র পরিত্রাতা, ক্রিশ্চান-ধর্মই সেরা ধর্ম, অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে পৃথিবীর সব মানুষকেই একদিন যিশু-ভজনা করতে হবে। শুধু তাই নয় এই দাবিকে কেবলমাত্র চিন্তা-ভাবনার স্তরে আটকে না রেখে, গুলি-বন্দুক নিয়ে উপনিবেশ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সেই শ্বেতাঙ্গ-বাহিনীর পিছনে পিছনে বাইবেল-হাতে পাদ্রি-সাহেবরাও কালো ও অসভ্য নেটিভদের ব্যাপটাইজ করে ঘৃণ্য ও নীচ ধর্মের নরক থেকে উদ্ধার করে আলোকিত-করার মহান ব্রত নিয়ে পৃথিবীর কোণে কোণে হাজির হয়েছিলেন।  তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আবার আধুনিক সময়েই আবার কার্ল মার্কসের অনুগামীরা ধর্মকে আফিংয়ের সঙ্গে তুলনা করলেন। 
পোস্টমডার্ন-চিন্তাবিদরা যেমন যিশু-উপাসকদের দাবির নিন্দা করলেন, তেমনি তাঁরা ধর্মকে আফিং বলতেও নারাজ। প্রতিটি ধর্মের অনুরাগীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁরা বললেন সমস্ত ধর্মেরই সমান গুরুত্ব আছে। তাঁদের দাবি, যখন চরম সত্য বলে কিছু নেই তখন কোনো একটি বিশেষ ধর্ম - সমাজ ও মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে পারে না। তাঁরা আরো বললেন, যখন কোনো ধর্মই সত্য নয় তখন ব্যক্তি-মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির হেরফেরে সমস্ত ধর্মই সমান মিথ্যা বা সমান সত্য হয়ে যায়।  
পোস্টমডার্নদের এই দাবি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক কম হচ্ছে না।
সে যাই হোক, আগেই যেমন উল্লেখ করেছি -- পোস্টমডার্নরা ধর্মের ইতিবাচক দিকটাকে অবহেলা করতে পারছেন না। মানুষের বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে তাঁরা তাই নতুন যুগের নতুন ধর্ম-নির্মাণের উপর জোর দিচ্ছেন। যে ধর্মে ঈশ্বর বলে কোনো ভদ্রলোক থাকবেন না।
এখানে বলা দরকার, বৌদ্ধধর্ম কিন্তু এখনও কম নতুন নয়। বৌদ্ধধর্মের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, পুণ্য করলে স্বর্গে পাঠাবে আর পাপ করলে নরকবাসে, এমন কোনো চিরাচরিত সর্বশক্তিমানের অস্তিত্ব আছে কিনা এরকম কোনো কূট তর্কে সে বিশ্বাস করে না। তার মনোযোগ মানুষের দিকে। সে মনে করে ওসব ঈশ্বর-টিস্বর বা ভাগ্যকে দায়ী করে কোনো লাভ নেই, মানুষের জীবনের যাবতীয় সুখ-দুঃখের মূলে আছে তার নিজেরই উলটা-পালটা-চিন্তা-ভাবনা ও কাজ-কর্ম । বৌদ্ধধর্মের মূল-ভিত্তিই তাই কার্য-কারণ সম্পর্কের উপর দাঁড়িয়ে আছেসে বলে দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে কৃতকার্যের সম্পর্ক আবিষ্কার এবং দুঃখের কারণগুলিকে নাশ করার মধ্যে দিয়ে যে কোনো মানুষ বুদ্ধত্ব অর্জন করতে পারে। এই বুদ্ধত্ব মানে কিন্তু কোনো ঈশ্বরত্ব নয় বরং প্রকৃত মনুষত্ব।
বুদ্ধ-প্রচারিত ধর্মের ত্রিরত্নের প্রথম রত্নটিই হল বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...।
অর্থাৎ ঈশ্বর নয়, চিরন্তন শান্তি ও সুখ লাভ করতে হলে মানুষকে বুদ্ধত্ব অর্জন করতে হবে। এবং ইচ্ছে থাকলে ও চেষ্টা করলে সব মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব। এবং এই বুদ্ধ মানে কোনো দেবতা নয়, একজন আলোকপ্রাপ্ত মানুষ। বুদ্ধ-মানুষ মানে যে মানুষ মনে করেন অন্যের কোনোরকম অনিষ্ট চিন্তা নয়, সমস্ত জীবেরই সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণ-কামনাই তাঁর একমাত্র প্রার্থনা ও কর্ম।
বৌদ্ধধর্মে এই যে আলোর কথা বা আলোক-প্রাপ্তির কথা বলা হয়, সেই আলো কোনো অচেনা অজানা স্বর্গ থেকে চুঁইয়ে নামা দেবতাদের কৃপা বা দয়া নয়, এ আলো মানুষের অন্তরের আলো বা জ্ঞানের আলো। তথাগতের উপদেশ বলে, মানুষকে নিজের ভিতর জমে থাকা অবিদ্যার নানান অন্ধকারকে নাশ করতে হবে, অহংকারের অন্ধকার, গর্বের অন্ধকার, রাগ-লোভ-লালসা-ঘৃণা এই রকম সব অন্ধকার। কেউ যদি তা পারে, সাধারণ মানুষের একজন হয়ে থেকেও তাহলে সে হতে পারবে একজন আলোক-প্রাপ্ত মানুষ। একজন বুদ্ধ। সাধারণের একজন হয়েও সে হবে অসাধারণ। সব মানুষের মধ্যেই রয়ে গেছে সেই আলোক-প্রাপ্তির সম্ভাবনা।
সুতরাং বৌদ্ধধর্ম মানুষকে শুদ্ধ বানাতে চায়, সচেতন বানাতে চায়, জ্ঞানী হবার কথা বলে, স্ব-নির্ভর হবার পথ বাতলে দেয়। বৌদ্ধধর্ম মানুষের উত্তরণের কথা বলে।
যত দিন যাচ্ছে একটা কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আধুনিক সময়েইউরোপ সব ব্যাপারেই নায়ক হতে চেয়েছিল। সব কিছুতেই শ্রেষ্ঠ নামের এক বিন্দুর কল্পনা দিয়ে তাঁরা একটা কাল্পনিক সীমানা বানাতে চেয়েছিলভেবেছিল তাঁদের আবিষ্কার করা এনলাইন্টমেন্ট-নামক এক মহা-আখ্যানের দোহাই পেড়ে সারা পৃথিবীতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা বাজিমাত করবেন। সে রাজনীতি-সমাজনীতি অথবা ধর্ম-দর্শন-শিক্ষা-সংস্কৃতি যাই হোক না কেন--  সবকিছুতেই তাই বলে দেওয়া হল- ওয়েস্ট ইজ দ্য বেস্ট।
এখানে বলে নেওয়া ভালো পোস্টমডার্নিজিমের অন্যতম প্রবক্তা জ্যাক দেরিদার সমালোচনার তির পশ্চিমি আধুনিক চিন্তা-ভাবনার যে যে মহা-আখ্যানগুলিকে বেশি বিদ্ধ করেছেন সেগুলি হল
এক- লোগোসেন্ট্রিজিম বা যে কোনো বিষয়ে একটা সত্যকে খাড়া করে তার উপর অগাধ বিশ্বাস।
দুই- ইগোসেন্ট্রিজিম বা একটা শক্তপোক্ত আমি খাড়া করে তার উপর অগাধ বিশ্বাস।  
তিন - ফোনোসেন্ট্রিজিম বা লিখিত শব্দের চেয়ে উচ্চারিত ধ্বনির উপর গুরুত্ব আরোপ করা। চার- ফ্যালোসেন্ট্রিজিম বা লিঙ্গের উপর বিশ্বাস রেখে নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্বকে জাহির করা।
পাঁচ- এথনোসেন্ট্রিজিম বা অন্যদের খাটো করে একটা বিশেষ জাতি ও তার বিদ্যে-বুদ্ধিচর্চার ঐতিহ্যকে বড়ো করে দেখানো।
ইউরো-আমেরিকার আপনারে বড়ো বলে বড়ো হবার সেই আশা পূর্ণ হয়নি। সেইসব কেন্দ্রাভিমুখী বা অভিকেন্দ্রিক মহা-আখ্যানের দিনও শেষ।  
পঞ্চাশের দশকের শেষপর্বে এসে, যখন সারা পৃথিবী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এবং ক্ষয়-ক্ষতি একটু একটু করে সামলে উঠছে,  তখন একথাটাও বোধগম্য হল যে এই মারণ-যুদ্ধে গুলি-বোমা-বন্দুক দিয়ে অজস্র মানুষকে হত্যার ধাক্কাসবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের বিশ্বাসের জগৎ। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উপর নির্মিত মানুষের সেই নিভৃত অন্তর্জগৎ ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে গেছে।     
অনেক আগেই এই ভাঙনটা রবীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞায় ধরা পড়েছিল। বীথিকা-কাব্যগ্রন্থের দুর্ভাগিনী কবিতাটিতে তিনি জানিয়েছিলেন
মূর্ছাতুর আঁধারের উঠিছে নিশ্বাস
           ভাঙা বিশ্বে পড়ে আছে ভেঙে-পড়া বিপুল বিশ্বাস
                   তার কাছে নত হয় শির
              চরম বেদনাশৈলে ঊর্ধ্বচূড় যাহার মন্দির ...
দেখা গেল মানুষের এই বিশ্বাসের জগতে ফাটল ধরার ফলে মানুষের জ্ঞানের জগৎও আর নিটোল থাকছে না। আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে জ্ঞানের আরতি, জ্ঞানের মর্যাদা, সত্যের গতি-প্রকৃতিকারণ অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশ্বের মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি। সুখের পথ দেখাতে পারেনি। শান্তির পথ দেখাতে পারেনি।
ইউরোপে গত প্রায় ৪০০ বছর ধরে বিজ্ঞানকেই মনে করা হত জ্ঞান-লাভের চূড়ান্ত উপায়, যে বিজ্ঞানের ভিত্তি হল সত্যের অনুসন্ধানকিন্তু এটা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যা বিজ্ঞান মানুষকে সাধু বানাতে পারেনি আরো বেশি শয়তান বানিয়েছে।
পোস্টমডার্নরা দাবি জানালেন পরম সত্য বলে কিছু হয় না, কোনোদিন তা ছিলও না। সব কিছুই আপেক্ষিক এবং পরিবর্তনশীল। তাই যাঁরা সত্য জানেন বলে দাবি করেন তাঁরা হয় প্রতারক অথবা বোকা। কারসত্যের ধারণা কিছু মানুষের  তৈরি করা একটা ব্যাপার। তা দিয়ে বেশ কিছু লোককে ঠকানো যায়, কিছু মানুষকে ধোঁকা দেওয়া যায়, কিছু মানুষ বা গোষ্ঠীর উপর নিজের কর্তৃত্ব জাহির করা যায়। এবং আমরা দেখেছি, আধুনিক-পর্বে ইউরোপের নানা দেশ যে-কাজে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
পোস্টমডার্নরা আরো বলছেন, সত্যি বলে যেমন কিছু নেই তেমনি মিথ্যে বলেও কিছু হয় না। সবই আপেক্ষিক। যা সত্যি একই সঙ্গে সেটা একটা ভ্রান্তি। কিছু ঘটনার সাপেক্ষে কোনো কিছুর বিচার করার ভিতর সবসময় একটা সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। সত্য সর্বদা পরিবর্তনশীল, আজকে যেটা ঠিক বলে মনে করা হচ্ছে, কাল তা ভুল প্রমাণিত হতে পারে।
বহুকাল আগে প্রতীত্য-সমুদ্দপাদ তত্বের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মও একই মত পোষণ করেছিল।   
সুখের কথা পোস্টমডার্নরা আধুনিক ইউরোপের চিরাচরিত যুক্তি এবং নৈব্যর্ক্তিকতাকে বর্জন করেছেন। এমনকি জ্ঞানই শক্তি আধুনিকদের মতো এই ধরণের কোনো গর্বিত উচ্চারণেও তাঁরা আগ্রহী নন। তাই তাঁরা চিন্তা-ভাবনায় কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকেও মানতে রাজি নন, কারণ বিশ্ব-সমস্যা সমাধানে সেই সব পদ্ধতির ঘাটতি ধরা পড়ে গেছে। সত্য ঘটনা বলে যা কিছু উপস্থাপিত করা হচ্ছে তাকে আঁকড়ে ধরার চেয়ে তাঁরা বেশি নির্ভর করছেন ব্যক্তি-মানুষের মতামতের উপর, কারণ একজন মানুষের মতামতই তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে চালিত করার মূল-শক্তি । পোস্টমডার্নরা মনে করছেন একজন মানুষ তাঁর বুঝতে-পারা বা মতামতকে যদি যুক্তিবাদী করে তুলতে পারেন তবে সেটাই বেশি সত্যের কাছাকাছি এবং সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধদেব প্রায় একইভাবে ব্যক্তি-মানুষের সচেতনতার উপর জোর দিয়েছিলেন। বড়োদের শেখানো কোনো ন্যায়-নীত-শাস্ত্র-দর্শন, দৈব-নিয়ন্ত্রণ, পূর্ব-নির্ধারিত ধারণা, ঐতিহ্য, গুজব, শোনা-কথা, প্রবাদ বা বিশ্বাসের প্রতি অন্ধ-আনুগত্য বা দায়বদ্ধতা নয়, বুদ্ধদেব বললেন প্রশ্ন করতে, প্রশ্ন করে কারণ খুঁজতে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে। কেন এই মানব-জীবন, সেখানে কেন সারা জীবন-ভর এত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, এই জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী,  সেই উদ্দেশ্য-সাধনের উপায়ই বা কোনটি, প্রকৃত সুখ কী, আনন্দ কী, সেই সুখ ও আনন্দ-লাভের পথই বা কী জীবন সম্পর্কে এই রকমই প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবিক সব হাজারো প্রশ্নের মধ্যে ঘুর-পাক খেতে খেতে দীর্ঘ সাধনার পর নৈরঞ্জনা নদীর ধারে এক পিপুল-গাছের তলায় ৪৯-তম দিনে শেষ পর্যন্ত এক আত্মিক জাগরণের পর শাক্য-রাজপুত্র বোধিলাভ করে বুদ্ধদেব হলেন। মানুষকে জীবন সম্পর্কে নতুন বার্তা দিলেন। নতুন ধর্মের কথা শোনালেন।
বুদ্ধদেব জোর দিলে মানুষের অহং-কেন্দ্রিক পার্থিব কামনা-বাসনা ত্যাগ এবং মানবিক বিকাশের উপরবললেন মানুষের যাবতীয় দুঃক-কষ্টের কারণ তার অহংকার, লোভ, ঘৃণা, কামনা-বাসনা, মিথ্যা আশা, এগুলো ত্যাগ করতে পারলেই যে কোনো মানুষ বুদ্ধত্ব, অর্হত্ব বা নির্বাণ লাভ করতে পারবে। সংসারে পুনর্জন্মের হাত সে থেকে মুক্তি পেতে পারে। বুদ্ধ-মানুষ তাই একজন আত্মশুদ্ধ, আত্ম-আলোকিত মানুষ।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা যেতে পারে
ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব মানবকে বড়ো করিয়াছিলেন। তিনি জাতি মানেন নাই, যাগযজ্ঞের অবলম্বন হইতে মানুষকে মুক্তি দিয়াছিলেন, দেবতাকে মানুষের লক্ষ্য হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন। তিনি মানুষের আত্মশক্তি প্রচার করিয়াছিলেন। দয়া এবং কল্যাণ তিনি স্বর্গ হইতে প্রার্থনা করেন নাই, মানুষের অন্তর হইতেই তাহা তিনি আহ্বান করিয়াছিলেন। এমনি করিয়া শ্রদ্ধার দ্বারা, ভক্তির দ্বারা, মানুষের অন্তরের জ্ঞান শক্তি ও উদ্যমকে তিনি মহীয়ান করিয়া তুলিলেন। মানুষ যে দীন দৈবাধীন হীন পদার্থ নহে, তাহা তিনি ঘোষণা করিলেন। - (মন্দির)
কালের বিবর্তনে বৌদ্ধধর্মের মধ্যেও নানা দল-উপদল তৈরি হয়েছে, ঢুকে পড়েছে তন্ত্র-মন্ত্র-যোগ সাধনা-যৌনাচারের মতো নানান অ-বৌদ্ধ কার্যকলাপ। তাতে বুদ্ধদেবের বাণী ও উপদেশের কিছু যায়-আসে না। বুদ্ধদেবের গায়ে তাঁর ভক্ত ও শিষ্যরা যতই দেবত্বের মহিমা আরোপ করে তাঁকে শিক্ষক থেকে ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে যান না কেন, পরবর্তীকালের অন্যান্য ধর্ম-প্রচারকদের মতো বুদ্ধদেব নিজে কোনোদিন মানুষের উদ্ধারকর্তা বা পরিত্রাতা হতে চাননি। তিনি নানাভাবে তাপিত, পীড়িত ও আর্ত মানূ্ষকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলে।
বুদ্ধের সেই শিক্ষার একটি ছোটো উদাহরণ দিই - কিসা-গৌতমীর সেই গল্পটি আমরা প্রায় সকলেই জানি, একজন সন্তান-হারা মা বুদ্ধদেবের কাছে এসে তার মৃত সন্তানের প্রাণ ফিরিয়ে দেবার জন্যে সকরুণ মিনতি করছেন। বুদ্ধদেব কিন্তু কোনো ভেলকিবাজি বা অলৌকিক ক্ষমতা দেখানোর রাস্তায় হাঁটলেন না, আবার সরাসরি না বলে বাসাংসি জীর্নানি যথা বিহায়...-জাতীয় শোলোক-টোলোক আউরে কিছু খটখটে জ্ঞান দেবার চেষ্টাও করলেন না। তিনি সেই মা-কে শিক্ষা দেবার জন্য তাঁকে একমুঠো সর্ষে চেয়ে আনতে বললেন এমন কোনো বাড়ি থেকে যেখানে কোনোদিন মৃত্যু প্রবেশ করেনি, বললেন সেই সর্ষের ছোঁয়া পেলেই মৃত বালক প্রাণ ফিরে পাবে। স্বভাবতই সেটা ঘটল না। প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রতিটি পরিবারে মৃত্যু একটি অনিবার্য ঘটনা, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কিসা-গৌতমী সেই সত্যি অনুধাবন করলেন। এই হল বুদ্ধের শিক্ষা।
          প্রকৃত মানুষের উদাহরণ হিসেবে বুদ্ধদেব নিজেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন শরীর-মন-বচন সবকিছুকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। তাঁর শিক্ষা তাই মানুষকে শিক্ষিত, মার্জিত, পরিশ্রুত, নিয়মানুবর্তী, মানবিক হতে শেখায়। তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারলে মানুষ অপরিসীম সুখ, শান্তি ও ভালোবাসার মধ্যে বাস করতে সক্ষম হয়।
বুদ্ধত্ব অর্জনের জন্যে মানুষের এই যে নানাবিধ কর্ম-পালন তাকেই বুদ্ধধর্মে বলা হয় ধর্ম বা ধম্মো। বুদ্ধত্ব অর্জনের জন্যে একজন মানুষকে সংসার ত্যাগ করে সংঘে যোগ দিতে হয়। আবার সেই সংসার-ত্যাগ করে আসা মানেই কর্ম-ত্যাগ নয়, সংসার-কর্মকে এড়িয়ে যাওয়া বা পলায়ন-বৃত্তি নয়সংঘে যোগ দেওয়া মানে বৃহত্তর মানবের সুখ ও কল্যাণের চিন্তা আরো ভালোভাবে করার জন্যে ব্যক্তিগত সংসার-জীবনকে বিদায় জানানো। সংঘে যোগ দেবার পর একজন শ্রমণকে নতুন কর্ম গ্রহণ করতে হয়। পালন করতে হয় সংঘের নানাবিধ নিয়ম-বিধি। সেই কর্মও কিছু কম নয়। আসলে ভালো করে ভেবে দেখলে বোঝা যায় সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা মানে তো নিজের শেকড়কেই হারিয়ে ফেলা।  বুদ্ধদেব সেই শেকড় হারানোর কথা বলেননি।  তিনি চাননি মানুষ তার কাজকর্মকে এড়িয়ে চলুক।
তাই বৌদ্ধধর্মের দ্বিতীয় রত্নটি হল -- ধর্মং শরণং গচ্ছামি...।
তার অর্থ, বৌদ্ধধর্ম মানে ধর্মের নামে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়, কোনো জোর-জবরদস্তি নয়, কোনো কর্তৃত্ব বা খবরদারি নয়। বুদ্ধের বাণী ও উপদেশ, নানান কর্ম-পালনের ভিতর দিয়ে মানুষের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এবং নিজেকে প্রয়োগ করার মাধ্যমে আলোকপ্রাপ্ত হওয়া বা জ্ঞানলাভ করার কথা বলে। তা মানুষের ভিতর নিহিত কর্মশক্তিকে আবিষ্কারের উপর জোর দেয়, তাকে প্রয়োগ করতে বলে। এই ভাবে বৌদ্ধধর্ম মানুষের কাজ করার ক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে তোলে।
আমরা জানি, বৌদ্ধধর্ম এইভাবে তৎকালীন সমাজের উপর চেপে বসা বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতার সারা শরীরে প্রবল ভাবে আঘাত করেছিলস্বর্গ, ঈশ্বর, শাস্ত্র-মন্ত্র-যাগযজ্ঞ-পূজাপাঠ-জাতিভেব এই রকম সব মহা-আখ্যান তৈরি করা বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের খরদারি ও কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাকে অস্বীকার করে নড়বড়ে করে দিয়েছিল তার ভিত্তি।  
পোস্টমডার্নদের কাছেও প্রতিষ্ঠান মানেই তা ভুয়ো এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। পোস্টমডার্নরা ধর্মীয় নৈতিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কর্তৃ্ত্ব মানুষ ও সমাজের সামনে যে বাধা-বিঘ্ন তৈরি করছে তার বিরুদ্ধে কথা বলে। চিরাচরিত  ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের মনে যে উদ্বেগ  তা নিয়ে তাঁরা বলেন এনিয়ে মানুষের বুদ্ধির জগতে একটা বিপ্লব দরকার।
প্রাচীন ভারতে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে কথা বলে মানুষের বুদ্ধির জগতে এমনই এক বিপ্লব এনেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও বৈদিক ক্রিয়াকলাপের মোহবন্ধন থেকে জণসাধারণের চিত্ত যাতে মুক্তিলাভ করে সে ব্যাপারে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা ক্রমাগত সচেতন করেছিলেন মানুষকে। জাতিভেদ-প্রথা, অস্পৃশ্যতা, ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের গোঁড়ামিকে তাঁরা দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সামাজিক ন্যায়।
পাশাপাশি অন্য ধর্মমতগুলির দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যাবে তাদের কাঠামোর মধ্যে একটা বড়ো জায়গা দখল করে আছে আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ এবং আগ্রাসন। তাদের মধ্যে আরো আছে কেন্দ্রীয় শাসনের মনোভাব। নানা রকম জোর খাটানো। মানুষের মধ্যে অন্ধ-বিশ্বাস ও আনুগত্য তৈরি করাআক্ষরিক অর্থে বলবান ও তথাকথিত বুদ্ধিমান মানুষদের এই বুদ্ধিজীবী-সন্ত্রাসবাদ ধর্ম-রাজনীতি-সমাজনীতি-সংস্কৃতি সব জগতেই বিদ্যমান। এখনো।
একথা উল্লেখ্যের অবকাশ রাখে না যে আজকের পৃথিবী্র যাবতীয় অশান্তি ও গণ্ডোগোলের অন্যতম প্রধান কারণই হল নানা দেশ, গোষ্ঠী, দল, বা ব্যক্তির মধ্যে এই আধিপত্যবাদ বা ক্ষমতা জাহির করার মানসিকতা। আমরা জানি অন্যকে আঘাত করে, অন্যকে আক্রমণ করে, অন্যের এলাকা দখল করে মানুষ আনন্দ পায় সুখ পায় কারণ তাতে তার অহংকার তৃপ্তি লাভ করে।
এই ক্ষমতা জাহির করা, গায়ের জোরে এলাকা দখল করা, অন্যদের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা বা জোর-খাটানোর মানসিকতা সবকিছুকেই আধুনিক সময়ে সুসভ্য ও বুদ্ধিমান বলে দাবি করা পশ্চিমি-সমাজের প্রধানতম চরিত্র-লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।  এই ক্ষমতা-দখলের এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মানসিকতার কারণেই গত এক শতাব্দীর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আকাশ-ছোঁয়া উন্নতি করতে সক্ষম হলেও সভ্য-মানুষকে ঘাড় পেতে মেনে  নিতে বাধ্য হয়েছে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার ক্ষমাহীন অপরাধ।
অন্য কোনো ধর্মমত, আধুনিকতার পরিভাষায় সে নিজেকে যতই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার বলে প্রচার করুক না কেন, বা কোনো রাষ্ট্রবিদ্যা, সে একনায়কতন্ত্র থেকে ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র যাই হোক না কেন, যত মহত্বের দাবিদারই হোক না কেন, সভ্যতার ইতিহাসে এতটা পথ হেঁটে এসেও তারা কেউই তাপিত, পীড়িত, আর্ত মানুষকে এই যুদ্ধ-হিংসা-হানাহানির ক্লেদ থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি। দেখাতে পারেনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিশা।
সভ্যতার ইতিহাস ঘেঁটে আজ মানুষের বোধগম্য হচ্ছে এই কাজ করতে পেরেছিল এবং এখনো পারে একমাত্র বৌদ্ধধর্ম। কারণ বৌদ্ধধর্মের মধ্যে আধিপত্যবাদ, কেন্দ্রীয় শাসন, অন্যকে আঘাত করা বা অন্যকে হীন প্রতিপন্ন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা এ সবকিছুই আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত।
আমাদের মনে রাখা দরকার প্রাচীন ভারতে এরকমই এক ভয়াবহ যুদ্ধের অজস্র মানুষের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পর চণ্ডাশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ধর্মাশোক হয়েছিলেন এবং সেটা যুদ্ধে হেরে যাবার অক্ষমতা থেকে নয় বরং যুদ্ধে বিজয়ী হবার পর সেই সাফল্যকে হেলায় পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র মানুষের সর্বাঙ্গীন শান্তি ও কল্যাণ কামনার জন্যে মহামতি অশোক পরম সৌগতের শরণ নিয়েছিলেন। যে কারণে বিশ্বের তাবড় তাবড় ঐতিহাসিকেরাও আজ তাঁকে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ নৃপতির শিরোপা দিতে কুণ্ঠিত হননি। 
          সুতরাং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের একটা কথা অবশ্যই বোঝা দরকার, যে গৌতম-বুদ্ধ প্রচারিত ধর্মে সব কিছুর কেন্দ্র হল একমাত্র মানুষ, তার যত জোর তার সবটাই শুধু মানুষকে  সচেতন করার উপর, ব্যক্তি-মানুষের আত্মিক বিকাশের উপর। 
বৌদ্ধধর্ম বলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে মানুষ হিসেবে নিজেকে আরো বেশি শুদ্ধ করার, আরো বেশি সচেতন করার, আরো বেশি উন্নত করার এক অপার সম্ভাবনা। মানুষ নিজেকে শুদ্ধ বানাতে পারে তার যাবতীয় রাগ-ঘৃণা-ঈর্ষা-লোভ-ভয়-কুমতলব-মোহ-আসক্তি এই-সব বদগুণগুলোকে সরিয়ে ফেলে, তাদের বদলে নিজের মধ্যে ধৈর্য-সহিষ্ণুতা-ভালোবাসা-দয়া-করুণা-সততা-মানবিকতা এইসব সদ-গুণগুলোকে আরো বেশি বিকশিত করে। কারণ মানব-জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার মূলে তার ই বদগুণগুলি। বুদ্ধদেব বললেন নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজের কর্মের ভিতর দিয়ে নিজের ভিতরের সত্যকে আবিষ্কার করতে। নিজের মধ্যে করুণা দয়া ভালোবাসার যে অনন্ত সম্ভাবনা তাকে আবিষ্কার করতে। নিজের চিন্তা-ভাবনাকে মুক্তির সপক্ষে উর্বর করে তুলতে, নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে।
এখানে অনায়াসে আমরা আবার রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে পারি
বুদ্ধদেব তাঁহার শিষ্যদিগকে উপদেশ দিবার কালে এক সময়ে বলিয়াছেন যে, মানুষের মনে কামনা অত্যন্ত বেশি প্রবল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাহার চেয়েও প্রবল পদার্থ আমাদের আছে; সত্যের পিপাসা যদি আমাদের রিপুর চেয়ে প্রবলতর না হইত তবে আমাদের মধ্যে কেই-বা ধর্মের পথে চলিতে পারিত। মানুষের প্রতি এত বড়ো শ্রদ্ধার কথা এত বড়ো আশার কথা সকলে বলিতে পারে না। কামনার আঘাতে মানুষ বার বার স্খলিত হইয়া পড়িতেছে, কেবল ইহাই বড়ো করিয়া তাহার চোখে পড়ে যে ছোটো; কিন্তু তৎসত্ত্বেও সত্যের আকর্ষণে মানুষ যে পাশবতার দিক হইতে মনুষ্যত্বের দিকে অগ্রসর হইতেছে এইটেই বড়ো করিয়া দেখিতে পান তিনিই যিনি বড়ো। এই জন্য তিনিই মানুষকে বারংবার নির্ভয়ে ক্ষমা করিতে পারেন, তিনিই মানুষের জন্য আশা করিতে পারেন, তিনিই মানুষকে সকলের চেয়ে বড়ো কথাটি শুনাইতে আসেন, তিনিই মানুষকে সকলের চেয়ে বড়ো অধিকার দিতে কুণ্ঠিত হন না। তিনি কৃপণের ন্যায় মানুষকে ওজন করিয়া অনুগ্রহ দান করেন না, এবং বলেন না তাহাই তাহার বুদ্ধি ও শক্তির পক্ষে যথেষ্টপ্রিয়তম বন্ধুর ন্যায় তিনি আপন চিরজীবনের সর্বোচ্চ সাধনের ধন তাহার নিকট সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সহিত উৎসর্গ করেন, জানেন সে তাহার যোগ্য। সে যে কত বড়ো যোগ্য তাহা সে নিজে তেমন করিয়া জানে না, তিনি যেমন করিয়া জানেন। ( ধর্মের অধিকার )...
তাই একথা স্বীকার না করে উপায় থাকে না যে বৌদ্ধধর্ম মানুষের জীবনের প্রতিটি কোণে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়।
বুদ্ধের বাণী এমন কোনো কল্পকথা নয় যে পড়ে ভুলে যাওয়া যাবে। বুদ্ধের প্রতিটি উপদেশ জীবনের কথা বলে। যে জীবনের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়। সেই বাস্তব জীবন। সেই দৈনন্দিন জীবন। সারা বিশ্বে নিজের জায়গাটা কোথায় তা খুঁজে বের করা। নিজের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা, কী ভাবে সেই লক্ষ্যের দিকে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে তার দিশা ঠিক করা।  নিজেকে অবিরত প্রশ্ন করা। আমি কী হতে চাই... কী ভাবে হব... কোন পথে...। নিজেকে নিরীক্ষণ করা, আত্ম-বিশ্লেষণ , আত্ম-সমালোচনা। নিজেকে আরো ভালো করার নিরন্তর প্রচেষ্টা। কজন মানুষ কতটা সৎ, কতটা শান্ত-মেজাজ, সহজ, দয়ালু, বিবেচক, খোলামেলা, উদার, নম্র, ভদ্র, বিশ্বাসী, শ্রোতা, মনোযোগী, পরিশ্রমী, উৎসাহী, সাবধানী, ধৈর্যশীল, সহনশীল, কুশলী হতে পারে। তাঁর কতটা মানিয়ে নেবার ক্ষমতা। যেখানে যেমন প্রয়োজন তেমনি করে প্রতিদিন একটু একটু নিজেকে বদলানো। ভালো কাজ করাটাকে একটা অভ্যাসে পরিণত করা। সেটাকেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য করে তোলা। কোনো বিষয়ে কতটা নিরাসক্ত থাকব বা কতটা আসক্ত হব তার একটা মাপ ঠিক করা। নিজের মতো করে। এই সময়ের তীব্র কনজিউমারিজিম যখন আপামর জনগণকে প্রবলভাবে কব্জা করতে চাইছে তখন বৌদ্ধধর্মের এই ভাবনাগুলি আরো বেশি প্রাসঙ্গিকতা পাচ্ছে।
মানব-জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য যদি হয় নির্বাণ অথবা জীবনের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ,  সংসারে পুণর্জন্মের আবর্তন থেকে মুক্তিলাভ, তাহলে তার আশু লক্ষ্য হল প্রতিদিন আমরা যে যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি তাকে বোঝা, তার সমাধান করা, নিজেকে জীবন সম্পর্কে আরো বেশি অভিজ্ঞ করে তোলা।
এই চর্চায় বস্তু নয়, মনই প্রধান। নিজের মনকে প্রশিক্ষিত করা, তাকে নানাবিধ সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে তোলা। নিজেকে সুখী করা, তৃপ্ত করা । অন্যদের সঙ্গে, অন্যদের নিয়্‌ অন্যদের পাশাপাশি নিজেকে প্রকৃতির কোলে শান্তিতে বসবাসের উপযুক্ত করে তোলা।
এর জন্যে দরকার চরিত্র গঠন।  এই চরিত্র গঠনের জন্য বৌদ্ধদের মেনে চলতে হয় পঞ্চশীল নীতি। বৌদ্ধদের সেই অবশ্য পালনীয় পাঁচটি কর্তব্য হল - 
প্রাণিহত্যা থেকে বিরতি। অর্থাৎ অহিংসা। এবং কারো কোনো ক্ষতির কারণ হব না এই মনোভাব।   
অদত্তাদান থেকে বিরতি অর্থাএমন কিছু গ্রহণ না করা যা দেওয়া হয়নি  
অব্রহ্মচর্য থেকে বিরতি অর্থা অবৈধ ও অসংযত কাম-ক্রিড়ায় লিপ্ত না হওয়া
মিথ্যা থেকে বিরতি অর্থাৎ কুৎসা রটনা, পরুষ, সম্প্রলাপ ও অসংযত বাক্য ব্যবহার না করা।
সুরাদি মাদক দ্রব্য থেকে বিরতি অর্থাকোনো রকম নেশার প্রতি আসক্ত না হওয়া। 
সব দিক দিয়ে বিচার করলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বুদ্ধের শিক্ষা যে আধুনিকদের মতো শুধু যুক্তি-নির্ভর বা একপেশে তা কিন্তু নয়। সেখানে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি কখনো আবেগ আবার কখনো বা আছে কল্পনাশক্তির প্রয়োগ।
এইভাবে বৌদ্ধধর্ম বুঝিয়ে দিল জীবনও এক শিল্প । লাগাতর চর্চার মধ্যে দিয়ে তাকে বিকশিত করোতে হয়।
মানুষের মধ্যে যে শুদ্ধতা ঘুমিয়ে আছে, সচেতন ভাবে নানান কর্ম ও আচরণের মধ্যে দিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলা। নিজেকে একটু একটু করে খুঁতহীন করে তোলা। লোভ ও ঘৃণাকে কমিয়ে আনা। নিজের ভিতর দয়া, ভালোবাসা, সততা, সত্যতা, কৌমার্য, মান্যতা এই সব গুণের বিকাশ ঘটানো। কথা-বার্তা আচার-ব্যবহার আরো বেশি ইতিবাচক করে তোলা। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও চরিত্র তৈরি করা। নিজেকে স্থিত-প্রাজ্ঞ  করা।
আবার নিজেকে ভোগ-লালসা থেকে বিরত রাখা মানে চরম কৃচ্ছ্র-সাধনা নয়। প্রবৃত্তির ধ্বংস নয়, বরং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, তাকে জয় করা। ভোগ ও ত্যাগের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা। বুদ্ধদেব যাকে বলেছেন মধ্যম পন্থা। বুদ্ধ্ববাণী সেই সব আবেগকে বশ মানাতে বলেছে যেগুলি ধ্বংসাত্মক আর সেই সব আবেগকে প্রাধান্য দিতে বলেছে যেগুলি সৃষ্টিশীল।
খুব নিবিড় ভাবে চিন্তা করলে এই বোধটা আর অধরা থাকে না যে অন্যান্য ধর্মমতের মতো বৌদ্ধধর্ম শুধুমাত্র একটা বিশেষ ধর্মীয় পরিসরে আবদ্ধ নয়। কিছু সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস বা আচার-বিচার-সংস্কার পালনের মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ করা যায়নি। ব্যক্তিগত বোধ ও উপলব্ধির তারতম্য অনুযায়ী তার বিস্তর অভিমুখ, তার অজস্র হয়ে ওঠা, তার অসংখ্য নিশ্চয়-বিনিশ্চয় বা নির্মাণ ও বিনির্মাণ। ঠিক যে যে লক্ষণগুলি থাকলে একটি ঘটনা বা বিষয়কে পোস্টমডার্ন অভিধার মোড়ক লাগানো যায় বৌদ্ধধর্ম তেমনই একটি ঘটনা বা বিষয় বা তার চেয়ে বেশি কিছু।
পশ্চিমি মানুষদের ক্রমশই আধুনিকতা সম্পর্কে আশাভঙ্গ হচ্ছে। মোহভঙ্গ হচ্ছে। কারণ শান্তি-প্রগতি-জ্ঞান সম্পর্কে গত শতকের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-রাষ্ট্র-ধর্ম যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলি সেই কথা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এই কারণে আধুনিক ইউরো-আমেরিকানদের জন্যে পোস্টমডার্নরা দুঃখ প্রকাশ করছেন। পাশাপাশি তাঁরা একথাও বলছেন যে আধুনিকতা একটা অন্তঃসারশূন্য ব্যাপার। 
পোস্টমডার্ন চরিত্র-লক্ষণ ঠিক করতে গিয়ে তার প্রবক্তারা সবাই মেনে নিয়েছেন যে সারা বিশ্বে ইউরোপের প্রভাব পড়তির দিকে। পশ্চিমি-দর্শন এখন পুরোপুরি ভাষাতত্ত্বের কচকচানিতে আক্রান্ত,  সেখানে ধ্রুপদী অধিবিদ্যার কদর কমছে। পশ্চিমি-শিল্পকলা বিমূর্ত থেকে আরো বিমূর্ততার দিকে চলে গিয়ে এখন দিগভ্রান্ত। পশ্চিমি-বিজ্ঞান নিজের দূষণে নিজেই আর্ত। পশ্চিমি-গণতন্ত্র এখন নানান প্রশ্নচিহ্নের মুখে। পশ্চিমি-সমাজতন্ত্রের বেলুন চুপসে গেছে। পশ্চিমি-ধর্মও এখন প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার মানে খুঁজে খুঁজে হয়রান। আর পশ্চিমি-আলোক-প্রাপ্তি এখন আমোদ-গেড়েমির বিশ্ববাজার-প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে চরম সিদ্ধিলাভ করেছে।  
এই পরিস্থতিতে ইউরোপীয় সমাজ যখন একটা বিকল্পের খোঁজে প্রাচ্যের দিকে মুখ ঘোরানো শুরু করেছে এবং তাঁদের মনে আড়াই হাজার বছর ধরে জীবন্ত টাটকা ও তাজা বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ জাগছে, আমার খুব করে মনে হয় পোস্টমডার্নিজিমের সূচনা-পর্বে সেটাও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অর্থাৎ সেই দিক দিয়ে দেখলে এ-কথাটা বলা অসঙ্গত হবে না যে দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সারা ইউরোপ ও আমেরিকায় বুদ্ধ-জন্মের ২৫০০ বৎসর পূর্তি উৎসব পালন করার সময় পশ্চিমি-সমাজের বৌদ্ধধর্মকে আরো বেশি স্বীকার ও গ্রহণের মধ্যে দিয়েই ইউরোপীয় পোস্টমডার্নিজিমের যাত্রা শুরু।
সুতরাং পোস্টমডার্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা ফাঁদতে গেলে তার বহুরৈখিক বিন্যাস ও মানবিক বিকাশের অনন্ত সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখা একান্ত জরুরি।
একটু তলিয়ে বিচার করলে বোঝা যায় গৌতম-বুদ্ধের বাণী, উপদেশ, জীবনী ও আদর্শ মানুষকে যে যে বার্তাগুলি পাঠাতে চায় তা হল -
          ১। ব্যক্তিগত অহংকার থেকে মুক্তি,
২। আধিপত্যবাদ বা আগ্রাসন থেকে নিজেকে দূরে রাখা আবার একই সঙ্গে মানুষের চিন্তা-ভাবনার সমস্তটা জুড়ে নিজেকে হাজির রাখা, অর্থাৎ আধিপত্যহীন পরিব্যপ্তি,
          ৩। কোনো সময়েই কোনো রকম কেন্দ্রীয় শাসন জারি না করা, কোনো উত্তরাধিকারী নির্বাচন না করা, কোনো কেন্দ্রীয় সংঘ তৈরি না করা,
          ৪। জীবন ও জগতের সবকিছুর মধ্যে নিজের মতো করে একটা সুষম ভারসাম্য রক্ষা করা,   
আমরা মুখে নিজের সম্পর্কে যে-যা ভাবি বা অন্যের  কাছে যে-ভাবে নিজেকে প্রচারিত করতে চাই না  কেন, একজন মানুষের পালিত আচার-আচরণই অন্য মানুষদের কছে তাঁর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরে। আমাদের কথাবার্তা-আচার-আচরনই বলে দেয় আমরা কী ভাবছি, আমাদের স্বভাব কেমন, আমাদের শিল্প-শিক্ষা-ধর্ম-নীতি-ন্যায়বোধ-মূল্যবোধ এবং জ্ঞানের বহর। আমরা কোন পথে কোথায় পৌছতে চাইছি সব কিছুই ফুটে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মে। অথচ বেশিরভাগ সময়ে বেশির ভাগ মানুষই রাষ্ট্র-শাসক-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি এই সবকিছুর উপর জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের দায় চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ ভাবি, নিজের নিজের কাজকর্মের গুণাগুণ সম্পর্কে উদাসীন থাকি বা থাকতে পছন্দ করি। অন্যকে দোষী বানিয়ে, অন্যকে গালাগাল দিয়ে নিজের নিজের অহংকে পরিতৃপ্ত করি। এটাই আমাদের মনের ডিফেন্স-মেকানিজিম, নিরাপত্তা-বলয়।  এই কমফোর্ট-জোন ছেড়ে বেরোতে গেলে অনেক ভাবনা-চিন্তা করতে হয়, অনেক ঝুঁকি নিতে হয়, অনেক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়, আমরা সে পথে হাঁটতে রাজি নই। তাই আমরা বাইরে এমন ভাব দেখাই যেন কোনোকিছুই ঠিকঠাক চলছে না, আর মনে মনে বলি এই বেশ ভালো আছি
আগে যে বললাম বৌদ্ধধর্ম কেবলমাত্র একটা ধর্ম নয়, তার রেশ টেনে এখন যদি বলি বুদ্ধদেবের জীবনী এবং তাঁর প্রচারিত জ্ঞান ও বাণী একটি স্বতন্ত্র এবং সামগ্রিক জীবন-দর্শন বা একটি পরিপূর্ণ সংস্কৃতি তাহলেও অনেক কম বলা হয়।
সংস্কৃতির মানে বহুধা-বিস্তৃত। তার মধ্যে ধরা পড়ে মানুষের ভাষা থেকে শুরু করে সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য, নাচ, গান, এমনকি সামাজিক রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, ধর্ম, দর্শন, দৈনন্দিন চিন্তা-ভাবনা -- সবকিছুই। সু-সংস্কৃতি সম্পন্ন হওয়া মানে নিজেকে নানা দিকে সর্বাংশে বিকশিত করা। আজকের মানব-বিশ্ব বুঝে গেছে বৌদ্ধধর্ম এই রকমের এমন একটি বহুবাচনিক সংস্কৃতি- যা মানুষকে কোনো সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপর বিশ্বাসী করে তোলে না বরং মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে যেতে পারে। যেখানে তাঁর মধ্যে কোনো স্বার্থপরতা থাকবে না, কোনো লোভ-ঘৃণা-অহংকার বা মিথ্যা আশা বলেও কিছু থাকবে না। তাই নিজস্ব জীবন-চর্চায় যে মানুষ পরম সৌগতের শরণ নিতে পারবে তাঁর বিকাশ হবে স্বতঃস্ফূর্ত, চারপাশের কোনো কিছুই তাঁকে প্রলোভিত করতে পারবে না। সমস্ত আবেগের দাসত্ব থেকে সমস্ত আসক্তির বন্ধন থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে। নিজের অথবা গোষ্ঠির সামান্যতম আধিপত্যও তখন তাঁর কাছে হয়ে দাঁড়াবে মূল্যহীন।
এইভাবে বুদ্ধদেবই প্রথম ধর্মচর্চার নামে ব্যক্তি-মানুষের সার্বিক বিকাশ ও উন্নতির কথা বলেছেন। বহুত্ববাদের কথা বলেছেন। বলেছেন ভিড়ের হৃদয় নিয়ে নয় নিজস্ব হৃদয় নিয়ে বাঁচতে। কারণ ভিড় মানে গোষ্ঠী-মতে সহমত হওয়া, সেই গোষ্ঠী-দাসত্বের পায়ে পা মেলানো ব্যক্তিগত মানুষেরই সমষ্টি।
সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষই এখন ব্যক্তি-স্বার্থ ও তাৎক্ষণিক লাভের জন্যে লালায়িত। তাঁদের ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতি সবকিছুর মূল এই একমুখী অন্ধ-লোভ। তাঁদের ধর্ম-দর্শন-ইতিহাস-বিজ্ঞান যাই বলি না কেন, তা একটাই -- সারা জীবনে যত পারো লুটে নাও অর্থ-যশ-বিষয়-আশ-প্রতিপত্তি। যে কোনো উপায়ে পার্থিব সম্পদ অর্জন ও ভোগ-সুখে মগ্ন থাকাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। জীবনের সমস্ত লাভ-লোকসানকে তাঁরা জাগতিক দৃষ্টিতেই দেখে থাকেন। তাঁদের সব কাজের সঙ্গেই জড়িয়ে যায় এই চাওয়া-পাওয়ার বাসনা। অন্য কিছু ভাবতে তাঁরা অক্ষম। মানবিকতা ব্যপারটাই তাঁদের কাছে একরকম মূল্যহীন। মানুষের প্রকৃত সত্তা বুঝতেও তাঁরা অপারগ।    
অথচ ব্যক্তি-মানুষের যে কোনো রকম অধর্ম, অসততা, বিকৃতি অতি অবশ্যই শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি তো বটেই পাশাপাশি সারা দেশ, সমাজ ও জাতির জীবনেও দুর্দশা, যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট ডেকে আনবে। সমাজে জাঁকিয়ে বসবে নানান বেনিয়ম, দুর্নীতি, উচ্ছৃশৃঙ্খলা, অপরাধ, মারামারি, হিংসা। সামাজিক উদ্বেগ ও অশান্তি বাড়বে। একটা বাড়ির প্রতিটা ইট শক্ত হলে তবেই গোটা বাড়িটার শক্তি বাড়বে। সুতরাং একজন মানুষ যদি নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে সে সমাজের একজন দায়িত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। মানুষ হিসেবে নিজের দায়-দায়িত্ব-অধিকার সম্পর্কে সে সচেতন হতে পারবে।
সুতরাং ব্যক্তি-মানুষের মনে লুকিয়ে থাকা লোভ লালসা ঘৃণা বদমায়েসি হিংসা এবং সবার উপর অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশই সমাজের যাবতীয় অশান্তির মূলে। এখন তো আবার দেখা যাচ্ছে অনেক অভিজ্ঞজন বলছেন যুদ্ধের অন্যতম কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদতাই সমাজ, সভ্যতার প্রকৃত উন্নতি ও অগ্রগতি তখনই সম্ভব যখন তার প্রতিটি সদস্যকেই উন্নত করা যাবে।
এটার মধ্যে কোনো অতিকথন নেই যে নানা সময়ে এই পৃথিবীর নানান প্রান্তে গড়ে উঠেছে নানান সভ্যতা। দিনে দিনে সেই সব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে নিজস্ব নিয়মে। সব সভ্যতার ভিতরেই গড়ে উঠেছে নানান সাংস্কৃতিক পরিসর যা মানুষকে উন্নত জীবনযাত্রার সন্ধান দিয়েছে। আবার তার পাশাপাশি প্রাকৃতিক নিয়মেই আবহমান কাল নানান সভ্যতার মধ্যে নিরবিচ্ছন্নভাবে ঘটে চলেছে নানান সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। যদি এই বিনিময়ের প্রক্রিয়াটিকে একটু খুঁটিয়ে দেখা হয় তাহলে অবশ্যই টের পাওয়া যায় সেখানে এই আদান-প্রদানে যে সংস্কৃতির অবদান বিশেষ ভাবে চোখে পড়ার মতো তার নাম বৌদ্ধ-সংস্কৃতি। কারণ বৌদ্ধধর্ম সবসময় অনেক বেশি মানুষের কাছাকাছি। মাটির কাছাকাছি। প্রাকৃতিক।
মানবিক ভাবনার এই বিশেষ দিকটাই বৌদ্ধধর্মকে আড়াই হাজার বছর পরেও শুরুর মতো সজীব ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে। তার গায়ে কোনো ক্লেদ, কোনো গ্লানি, কোনো ক্লান্তি বা কোনো মরচে বসতে দেয়নি। তাকে কঠিন কঠোর এক মৌলবাদী শক্তিতে পরিণত করেনি।
অথচ আমরা জানি গৌতম বুদ্ধ প্রথম-জীবনে ছিলেন বৈদিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। বৈদিক সমজের সেই আবহের মধ্যে এবং পৈত্রিক রাজপ্রাসাদের প্রভূত ধন-ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে দিন কাটাতে কাটাতেই সিদ্ধার্থ দেখলেন জীবনের অন্ধকার দিকগুলো, দেখলেন দারিদ্র্য-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু, প্রত্যক্ষ করলেন মানুষের দুঃখ-কষ্ট-অভাব-অভি্যোগ। অনুভব করলেন তৎকালীন সমাজ ও ন্যায়-নীতি-শাস্ত্রের দমবন্ধ অনুশাসন এবং বর্ণাশ্রম তথা জাতিভেদ প্রথা, তার ভাগ্যবাদ বা নিয়তিবাদ শুদ্ধধন-পুত্রকে অন্য কিছু ভাবতে, অন্য কিছু করতে ইন্ধন জুগিয়েছিল।
যার ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি বেছে নিলেন বেদ ও ব্রাহ্মণ-বিরোধীতার পথ। ভেঙে ফেললেন জাতিভেদ প্রথার কৃত্রিমতা। অস্বীকার করলেন চতুরাশ্রমের নিয়ম-নীতি। নিয়তি বা ভাগ্যফল নয়, বিশ্বাস করলেন মানুষের সাংসারিক সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-অশান্তির পিছনে আছে মানুষেরই কামনা-বাসনা ও কৃতকর্ম। তিনি পথ দেখালেন কী করে সেইসব কারণগুলোকে খুঁজে বের করা যায়, কীভাবে তাদের বিনাশ করা যায় এবং কী করে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে জাগতিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে নির্বাণ লাভ করা যায়।
তাই বুদ্ধের বাণী ও শিক্ষা সারা বিশ্বের মানুষকে যেমন দুঃখের কারণগুলি বিশ্লেষণ করতে শেখায় তেমনি দুঃখ-নিরসনের উপায়ের কথাও বলে। বুদ্ধ বলেন মানুষ যাকে দুঃখ বলে মনে করছে আসলে তা অতৃপ্তি, মানুষ যে দুঃখিত হয় কারণ তাঁর অনেক কামনা-বাসনা অপূর্ণ থেকে গেছে।  
বুদ্ধের এই শিক্ষা কোনো তাত্ত্বিক শিক্ষা নয়
অনেকে এই অপবাদ দেন যে কামনা-বাসনার পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধধর্ম নিবৃত্তির কথা বলে, যা সংসার থেকে পলায়নের মনোবৃত্তিকে উসকে দেয়। আসলে বৌদ্ধধর্ম মানে নিবৃত্তি নয়, প্রবৃত্তিও নয়।  বুদ্ধের পরামর্শ মধ্যম-পন্থা বা ভারসাম্য-রক্ষা। অবস্থা-বিশেষে যা বাস্তব-সম্মত এবং যা পুরোপুরি ব্যবহারিক‌ বা প্রায়োগিক।  
বৌদ্ধধর্ম খুব বেশি মাটির কাছাকাছি। কারণ বৈদিক সমাজে ভূমিপুত্রদের গায়ের জোরে, গলার জোরে শাস্ত্রের জোরে দীর্ঘদিন দাবিয়ে  রাখা হয়েছিল, হীন করে রাখা হয়েছিল। এবং সেটাও জাতিভেদের দোহাই পেড়েজ্ঞানের দোহাই পেড়ে।
মানুষে মানুষে এই ভেদাভেদ গৌতম-বুদ্ধের পছন্দ হয়নি। তাই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রাধান্যকে ছাপিয়ে বৌদ্ধধর্মে বৈশ্য ও শূদ্র-সমাজের গুরুত্ব বেড়ে গেল। বলা চলে, এই সময়ে ভারতবর্ষে বুদ্ধদেবের নের্তৃত্বে যেন একটা বৈশ্য-জাগরণ ঘটে গেল। ফলে বৈশ্যরা যে শুধু রাজ-ক্ষমতা দখল করলেন তাই নয়, শ্রেষ্ঠী-সমাজের সামাজিক স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের ব্যবসা-বাণিজ্যেও এই সময় ঘটে গেল এক অভূতপূর্ব উন্নতি।
          মাটির কাছাকাছি থাকা মানে প্রান্তিককে গুরুত্ব দেওয়া। যে কারণে বুদ্ধদেব বৈদিক ভাষার পরিসরকে বর্জন করে তাঁর ধর্ম প্রচারের জন্যে বেছে নিলেন প্রাকৃত জনগণের মুখের ভাষা, আমরা জানি সেই ভাষার নাম পালি।
          এইভাবে একের পর এক ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, বেদ-বিরোধীতা করে, জাতিভেদ-প্রথার কাঠামো-কে আঘাত করে, ভাষার আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসে, প্রান্তিককে গুরুত্ব দিয়ে সমাজ-জীবনের সমস্ত-স্তরে বৌদ্ধধর্ম যে ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটাল তার ফলে  শিলাকলা, সাহিত্য, ভাস্কর্য থেকে শুরু করে গ্রামীণ-শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রেই কয়েক শতাব্দী ধরে সৃষ্টিশীল বিকাশের এক অভিনব প্রকাশ দেখা গেল।
অহিংসার প্রচারে যেমন যাগ-যজ্ঞতে অজস্র পশুবলি তথা গো-হত্যা বন্ধ হল, সাহিত্য-দর্শন থেকে শিল্পকলা-ভাস্কর্য -- বুদ্ধদেবের ছোঁয়ায় সব কিছুতেই লাগল এক পরম মানবিক স্পর্শ। তাঁর অনুপ্রেরণায় মানুষের অন্তর্জগতকে দেখা জানা ও প্রকাশ করার জন্যে তৈরি হল শিল্পের নতুন ভাষা। শুধুমাত্র আনন্দ ও প্রশংসার জন্যে শিল্প নয়, নিজেকে শুদ্ধ করার জন্যেও শিল্প, এই উপলব্ধির মূলেও তাই সেই বৌদ্ধধর্ম। 
একথা আমরা জনি, বুদ্ধদেব মূর্তিপুজোর ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। অথচ আজকে সারা পৃথিবীতে যে মূর্তিটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় তা হল তথাগতের সেই শান্ত, সৌম্য, চোখ-বোজা, স্মিতহাসির মূর্তিটি। সেই কতকাল আগের গান্ধার শিল্প বুদ্ধদেবের এই ধ্যানী মূর্তিটি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিল আজ তা কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে দিচ্ছে শান্তির ছোঁয়া। শুধুমাত্র একটা মূর্তি অনেক কথা বলে দেয়।  সেই শান্ত সৌম্য স্মিতহাসিতে পরিপূর্ণ পরম করুণাময় মূর্তিটির দিকে দু-দণ্ড তাকিয়ে থাকলেই যে কোনো মানুষের শরীরে ও মনে একটা অন্য রকম অনুভূতির ছোঁয়া লাগে। একটা আত্মবিশ্বাস জাগে। আধুনিক-সমাজে আজ সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত যে বস্তুটি, ধ্যানী-বুদ্ধের দিকে তাকালে মনের কোথাও যেন সেই শান্তির ভাব জেগে ওঠে।  সে মুখে কোথাও কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, জ্বালা নেই, যন্ত্রণা নেই, বিরক্তি-ক্রোধ-ঘৃণা-ক্লান্তি বা অসহিষ্ণুতা নেই। সেখানে বিরাজ করছে শুধুই এক অপার শান্তি ও করুণা। এ প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক Hermann Keyserling বলেছেন - 'The East has succeeded in what has never yet been reached in the West: the visible representation of the divine as such. I know nothing more grand in this world than the figure of Buddha.'  যে পশ্চিমি সমাজ ধর্মীয় পরিসরে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি দেখতেই বেশি অভ্যস্ত তাঁদের কাছে ধ্যানী বুদ্ধের মূর্তি যে অন্য বার্তা বয়ে আনবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
সুতরাং আমরাও বলি শান্তি... শান্তি... শান্তি...
বৌদ্ধধর্মের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন সংঘ। বৌদ্ধধর্মেই প্রথম সংগঠিত সংঘ-জীবন বা কমিউন লাইফের সূচনা হয়। ধর্ম-আচরণের জন্যে বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের জন্যে সংঘ, বৌদ্ধ-ভিক্ষুনীদের জন্যে আলাদা সংঘ। সংঘ-পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই সব নিয়ম-নীতিকে যুগোপযোগী করে তোলা। অর্থাৎ তাদের ক্রমবিকাশ। কর্মের মধ্য দিয়ে ধর্মীয়-সাধনার বাইরে সংঘগুলির দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল -- সামাজিক জীবনে নর-নারীর সমান অধিকার, জনশিক্ষা-বিস্তার।
বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য সমাজে বর্ণভেদ বা জাতিভেদ প্রথার কারণে শিক্ষার অধিকার ছিল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের দখলে। বৌদ্ধ-বিহারে সেই ভেদাভেদ রইল না। শিক্ষা হল সব মানুষের জন্য, সর্বজনীন। কয়েক শতাব্দী পরে এভাবে ক্রমশ বৌদ্ধদের হাত ধরেই একদিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষারও সূচনা ঘটে গেল। একথা আজ ইতিহাস যে প্রাচীন ভারতে নালন্দা-বিক্রমশীলা-ওদন্তপুরী-সোমপুর-জগদ্দল-বল্লভীর মতো বৌদ্ধ-বিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দেশ-বিদেশের বহু ছাত্র বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রাচীন ভারতে শিক্ষা-সংস্কৃতির এই যে অসাধারণ বিকাশ, পণ্ডিতেরা মনে করেন এর ঠিক উলটোটা ঘটেছিল খ্রিস্ট-ধর্ম পা রাখার পরবর্তীতে ইউরোপের রোমান-সাম্রাজ্যে, তখন সেখানে নেমে এসেছিল এক অন্ধকার যুগ। সবকিছুতেই জাঁকিয়ে বসেছিল চার্চের অপ-শাসন।
বৌদ্ধ-সংঘগুলি পরিচালনার মধ্যে দিয়েই প্রথম পরিকল্পিত এবং সংগঠিত গোষ্ঠী-জীবন ও ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার সূচনা। সংঘ তৈরি করতে গিয়ে তাই সাংগঠনিক শক্তি বা অর্গানাজিং-স্কিল থেকে শুরু করে তার নেতৃত্ব দেয়া বা লিডারশিপ-স্কিল, জন-সংযোগ বজায় রাখা বা কমিউনিকেশন-স্কিল, পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক রাখা বা ইন্টার-পার্সোনাল স্কিল, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার উপর দখল তৈরি করা বা ল্যাংগুয়েজ স্কিল, দৈনন্দিন নানা সমস্যার ও প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং তাদের সমাধান তৈরি করা বা রিসার্চ-স্কিল এই রকম সব সফট-স্কিলের বিকাশই জরুরি হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ এই বৌদ্ধ-সংঘগুলিতে মডার্ন-ম্যানেজমেন্টের প্রতিটি শাখাই দীর্ঘ-সময় ধরে পল্লবিত হয়েছিল। যে কারণে আজকের ম্যানেজমেন্ট-শিক্ষাতেও বৌদ্ধধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। ম্যানেজমেন্ট সাইকোলজিতে সম্প্রতি এমোশনাল ইন্টেলিজেন্স-এর কথা বলা হচ্ছে, একজন মানুষের সাফল্যের পিছনে ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট-এর চেয়ে যার অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা আছে, বুদ্ধের সামগ্রিক শিক্ষার মধ্যেও সেই এমোশনাল ইন্টেলিজেন্স-এর বিষয়-বস্তু বিস্তর ছড়ানো আছে। নিজের আবেগগুলিকে চেনা, জানা, তাদের প্রভাবে নিজের কার্যকারিতা কতটা কমছে বা বাড়ছে তা উপলব্ধি করা এবং সেইমতো তাদের নিয়ন্ত্রন করা। আবার সমাজে যেহেতু আরো অনেককে নিয়ে কাজ করোতে হয় তাই অন্যের আবেগগুলিকে চেনা, জানা, বোঝা ও সততার সঙ্গে তাদের পরিচালনা করা। নানান কাজে অন্যকে উৎসাহিত ও উদ্দীপিত করা। বৌদ্ধসংঘ পরিচালনার কাজে এই গুণগুলির আকছার অভ্যেস করতে হত। আসলে মানুষের মনকে নিয়ে এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ বৌদ্ধধর্ম যেমন ভাবে করেছে অন্য কোনো ধর্মে তাঁর ছিটে-ফোঁটাও করা হয়নি।   
আর বৌদ্ধধর্মের তৃতীয় রত্নটিও তাই সংঘং শরণং গচ্ছামি...।
পোস্টমডার্নরা দাবি করেন নৈতিকতা একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার- যদি সত্যিকারের ধর্ম বলে কিছু না থাকে, চরম সত্য বলে কিছু না থাকে, তাহলে নৈতিকতার ব্যাপারে প্রত্যেক মানুষের ধারণাই সমান মূল্যবান অথবা সমান মিথ্যা। যখন কেউ বলেন আমার কাছে এটাই ঠিক তখন এই লক্ষণটি পরিষ্কার ফুটে ওঠে।
পোস্টমডার্নরা তাই খোঁজ করছেন নতুন নৈতিকতা ও নতুন মূল্যবোধের। তাঁরা বুঝতে পারছেন নৈতিকতা কোনোদিনই প্রবল যুক্তিবোধ থেকে আসে না, তাকে সর্বজনীনও করা যায় না। মানুষের নীতিবোধ নেহাতই একটি স্থানীয় ঘটনা। একটি সমাজের রীতি-নীতি-বিশ্বাস-সংস্কার এরকম বহু কিছু বিষয়ের গভীরে সেই জায়গার মানুষের নৈতিক-বিকাশের শেকড় ছড়ানো থাকে এবং সেখান থেকে তাঁকে উপড়ে ফেলে বিশ্বজনীনতার খাপে ভরা বা ছাঁচ-বদ্ধ করা একেবারেই অসম্ভব। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ব্যাপারে তাই কোনো সর্বজনীন রীতি-নীতি তৈরি করা যায় না।  তা পুরোপুরি আঞ্চলিক এবং জীবন্ত। 
আর ধর্মীয় নীতিবোধ বজায় রাখতে কিছু অন্ধ নিয়ম-কানুন তৈরি করে দেওয়া মানে তো সেই সব নিয়ম-পালনের মধ্যে দিয়ে মানুষের দায়িত্ববোধকে সংকুচিত করা। নৈতিকতা মানে তাই কিছু রীতি-নীতির প্রতি প্রবল আনুগত্য নয়। আমি চুরি করতে পারছি না কারণ কিছু নিয়ম-নীতি আমার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে বা আমার মনে একটা ভয় বাসা বেধে আছে যে ধরা পরলে আমাকে শাস্তি পেতে হবে, অথবা আমাকে অন্যের কাজে লাগতে হবে, অন্যের ভালো করতে হবে এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা মানুষকে কিছুটা নিয়ম-নিষ্ঠ করে ঠিকই কিন্তু এতে করে তাঁর মানবিকতার সার্বিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটে না। নীতি গল্পের উপসংহার মেনে যিনি আওড়ান সততাই সর্বোত্তম পন্থা তিনি কতটা সৎ হতে পারবেন তা ভাবে দেখার বিষয়। সুতরাং সেই দিক দিয়ে নৈতিকতা নিয়ম-কানুনের চেয়ে কিছু বেশি। নিয়ম-কানুনের চেয়ে আলাদা কিছু। পোস্টমডার্ন পরিভাষায় বললে এটা একটা ওপেন এন্ডেড ব্যাপার।
তাই পোস্টমডার্নরা মনে করেন নীতিবিজ্ঞান আপেক্ষিক, নৈতিকতা একটি ব্যক্তিগত মতামত। চালু এবং চিরাচরিত আচার-আচরণের বাইরে নৈতিকতা প্রত্যেক মানুষের একটি ব্যক্তিগত আচরণীয় বিষয়। সেদিক থেকে অন্য কেউ যদি কিছু চাপিয়ে দেয়, কোনো ধর্ম। কোনো মানুষ, কোনো রাষ্ট্র,  বা অন্য কোনো কিছু যাকে চরম সত্য বলে মনে করা হচ্ছে তাহলে তখন আর তার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।
এ-ব্যাপারে বৌদ্ধ-সংঘগুলির ভূমিকা বেশ চিত্তাকর্ষক। সেখানে প্রতিদিনের কাজকর্ম পরিচালনার জন্যে যেমন কিছু কিছু নিয়ম-নীতি বা বিধি-নিষেধ জারি করা হয়েছিল, তেমনি কোনো কিছুকেই চূড়ান্ত বলে দাবি করা হয়নি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং সময়ের দাবি মেনে সেই সব নিয়ম-নীতি অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। সময়ে সময়ে তাদের আপডেট করা হয়েছে। এর জন্যে ভিক্ষু ও ভিক্ষুনীদের মধ্যে প্রতি নিয়ত আলাপ-আলোচনা থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট সময় অন্তর একবার করে সভা বা সময়ে সময়ে ধর্ম-সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয়েছে।
 বৌদ্ধধর্মে আমরা চারটি ব্রহ্ম-বিহারের কথা পাই। এই ব্রহ্ম-বিহার মানে কিন্তু বৈদিক-ব্রহ্মের আবাস-স্থল নয়। এই ব্রহ্ম-বিহার মানে মানুষের মনেরই চারটি উচ্চতম বা মহত্তম বাসগৃহ অথবা মানুষের চারটি গুণ।
এই চারটি গুণ বা পারমিতার প্রথমটিই হল মেত্তা বা মৈত্রী, যার দ্বারা এই বিশ্বের প্রতিটি সজীব বস্তুর প্রতি অপরিসীম দয়া ও ভালোবাসা এবং তাদের সুখ-শান্তি কামনা করা বোঝায়। পরেরটি করুণা, যা বোঝাতে  বিস্তারিত ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না, এইটুকু বললেই যথেষ্ঠ যে সকলের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের অবসান হোক- মানুষের মনের এই কামনা বা ইচ্ছা। তৃতীয়টি মুদিতা, যার অর্থ এই অনুভূতি যে সমস্ত প্রাণের আনন্দে আমিও আন্দোলিত ও আনন্দিত। চতুর্থটির নাম উপেক্ষা, মানে মনের সমতা অর্থাৎ যে-কোনো হার-জিৎ, লাভ-লোকসান, নিন্দা-প্রশংসা, সুখ-দুঃখ, সব কিছুকেই সমান ভাবে নিতে পারা । সব কিছুর সঙ্গে মনের সমান দূরত্ব বজায় রাখা।
এই বিষয়গুলো এতদি পশ্চিমিন এথিকসে একেবারেই অচেনা অজানা বিষয় ছিল।   
বৌদ্ধ-সংঘগুলি ছিল ধর্ম-চর্চার এবং বিদ্যা-চর্চার পীঠস্থান। তবে বৌদ্ধধর্ম পালন করতে গেলে যে একজনকে সন্ন্যাসী হতেই হবে এমন কোনো বাধ্য-বাধকতা ছিল না। বৌদ্ধধর্মে গৃহীদের ধর্ম-চর্চাও একটি স্বীকৃত ঘটনা। বাড়িতে বসে সংসারের মধ্যে থেকেও বৌদ্ধধর্মের চারটি আর্যসত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপদেশ পালন কড়া যেত। অবশ্য গৃহীদের জন্য কিছু আলাদা নিয়মও ছিল বোধিসত্ব অর্জন করতে হলে একজন গৃহী বা সন্ন্যাসীকে যে দশটি গুণ বা পারমিতার অধিকারী হতে হত সেগুলি হল দান, শীল, বীর্য, ক্ষান্তি, ধ্যান, প্রজ্ঞা, উপায়, কৌশল্যা, প্রণিধান, বল ও জ্ঞান।  
আবার গৃহী মানুষ শ্রমণ-ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁদের সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে সাধনার জন্যে দূরবর্তী পাহাড়ে বা জঙ্গলে গিয়ে একা একা বাস করতে হত না, তাঁদের আশ্রয় নিতে হত এই সব বৌদ্ধ-সংঘে। ভিক্ষুব্রত নেবার ন্যূনতম বয়স ছিল ১৫ বছর। তখন গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে তাঁকে চীবর ধারণ করতে হত। তাঁর সম্পত্তি হত ভিক্ষার একটি পাত্র, তিন-টুকরো কাষায় বস্ত্র, একটি জলপাত্র, একটি তেল-রাখার জায়গা, একটি ক্ষুর, একটি লাঠি, একটি বিছানা, একজোড়া চটি ও কাপড় সেলাইয়ের জন্যে সূচ-সুতো। তাঁর পালনের জন্যে কিছু নিয়ম ছিল। প্রতি-মাসের ৮, ১৪ ও ১৫ তারিখে ভিক্ষু ও ভিক্ষুনীদের সভা হত।  নানা সমস্যা ও কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা হত। এবং সবটাই হত গণতান্ত্রিক নিয়মে। সেই ভাবেই মঠের নেতাকেও ঠিক করা হত। সুতরাং এটা পরিষ্কার বৌদ্ধরাই প্রথম মিশনারি কাজ-কর্ম শুরু করেন।
সংঘগুলির অবস্থান ছিল জনপদের কাছাকাছি। যাতে করে যাঁরা সাংসারিক মানুষ তাঁদের কাছ নিয়মিত ভিক্ষা সংগ্রহ করা যায়। এই সংঘগুলির যাঁরা সমর্থক তাঁদের বলা হত উপাসক। তাঁদের মধ্যে উপাসিকারাও ছিলেন।  অর্থাৎ বুদ্ধদেব একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন-চর্চা থেকে ধর্মকে আলাদা রাখতে চাননি, তেমনি বৌদ্ধ-ভিক্ষু বা ভিক্ষুনীদেরও জনসমাজ থেকে দূরে সরে যেতে বলেননি।
আমরা জানি পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রভাব থেকে রক্ষা করে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে হিন্দুধর্মকে সংস্কার করে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজে বৈদিক-সংস্কৃতিকে আবার ফিরিয়ে আনতে প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন আদি শঙ্করাচার্য । আমরা এও জানি এী আদি শঙ্করাচার্যও বৌদ্ধধর্মের দ্বারা কম প্রভাবিত হননি। যে কারণে কেউ কেউ তাঁকে বলেন গুপ্ত-বৌদ্ধ বা ছদ্মবেশী-বৌদ্ধ।
আদি শঙ্করাচার্য যেমন বুদ্ধ-কথিত নির্বাণের তত্ত্বকে মেনে নিয়েছিলেন এবং বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বানিয়ে, ধর্মপ্রচারক থেকে তাঁকে একেবারে দেবতার আসন দিয়ে, হিন্দুদের কাছে বুদ্ধের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছিলেন এবং যে যে বিষয়ে বুদ্ধদেব বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধীতা করেছিলেন বৌদ্ধধর্মের সেই নতুন ভাবনার অনেক কিছুকেই হিন্দুধর্মের মধ্যে জায়গা করে দিয়ে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিলেন তেমনি নিবৃত্তি এবং কর্মযোগের উপর জোর দিয়ে সংসার থেকে সন্ন্যাস নিয়ে তিনি বৌদ্ধসংঘের অনুসরণে ও অনুকরণে হিন্দু ধর্মেও মঠ প্রথার প্রবর্তণ করলেন। আদি শঙ্করাচার্য ভারবর্ষের চার-প্রান্তে যে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলে মনে করা হয় সেগুলি হল একেবারে উত্তরে বদ্রীনাথে অলকানন্দা নদীতীরে জ্যোতির্মঠ (জোশিমঠ), পশ্চিমে দ্বারকায় গোমতী নদীতীরে সারদামঠ, পূর্বে পুরীতে সমুদ্র উপকূলে গোবর্ধন মঠ এবং একেবারে দক্ষিণে কর্নাটকে তুঙ্গভদ্রা নদীতীরে শৃঙ্গেরীমঠ। এই মঠগুলি আজও চালু আছে এবং হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র বলে পরিগণিত। যদিও আদি শঙ্করাচার্য সেগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই মত অনেকেই মানেন না কারণ চতুর্দশ শতকের আগে মঠগুলির অস্তিত্ব ছিল এমন কোনো প্রমাণ গবেষকরা আজও পাননি। 
বুদ্ধদেবের ধর্মপ্রচারে যেমন জাতিভেদ ছিল না, তেমনি লিঙ্গ-ভেদও ছিল না। তাঁর যাবতীয় উপদেশ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্যে। সুতরাং পোস্টমডার্ন সময়ের যে আরেকটি চরিত্র-লক্ষ্ণণ - সমাজ-জীবনে নারীর অধিকার সম্পর্কে সরব হওয়া, এ প্রসঙ্গেও বলা যায়, বুদ্ধদেবই প্রথম সচেতনভাবে মহিলাদের অধিকারের কথা চিন্তা করেছিলেন।
পুরুষদের মতো নারীদের মধ্যেও তিনি আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। নারীদের তিনি আত্ম-চেতনার পাঠ দিয়েছিলেন, নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছিলেন। অথচ বোইদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মনু-সংহিতা জানিয়ে দিয়েছিল সংসারে নারীর নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। সে শৈশবে পিতা যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। প্রাচীন ভারতে আক্ষরিক অর্থেই বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য সমাজে নারীর অধিকার বলে কিছু ছিল না।
মহাপ্রজাপতি গৌতমী-কে দিয়ে শুরু করে বৌদ্ধধর্মে মহিলাদের যে শুধু ভিক্ষুনী হবার অধিকার দেওয়া হয়েছিল তা নয়, তাঁদের ভিক্ষা দেবার অধিকারও স্বীকৃত হয়েছিল। কারণ এর আগে বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য সমাজে মহিলাদের পারিবারিক সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার ছিল না। এমনকি ভিক্ষা দেবারও নয়। সেদিক দিয়ে দেখলে বলা যায় বৌদ্ধধর্মের এটি আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এখানে এই তথ্যটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে মৌর্য-সম্রাট অশোক যখন বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে সিংহলে ধর্ম-প্রচারক পাঠান তখন ভিক্ষুদের সংঘ গড়ার জন্যে যেমন পুত্র মহেন্দ্র-কে পাঠিয়েছিলেন তেমনি তাঁর সঙ্গে ভিক্ষুনীদের সংঘ গড়ার জন্যে কন্যা সংঘমিত্রাকেও পাঠিয়েছিলেন। 
বৌদ্ধধর্মের এরকমই আরেকটি পদক্ষেপ হল গণিকাদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া। সমাজতাত্তিক দিক দিয়ে বিচার করলে বলা যায় পরিবর্তিত এবং বিকশিত সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তখন ক্রমশই সমৃদ্ধ জনপদ বা নগরীর সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। সেই নাগরিক জীবনযাত্রার অনিবার্য অংশ হিসেবে বাড়ছিল গণিকাবৃত্তিও। স্বভাবতই ব্রাহ্মণ্য-সমাজে এই দেহোপজীবিনীরা ছিলেন নিন্দিত ও ঘৃণিত। বৌদ্ধ-সাহিত্যে কিন্তু এই সব গণিকাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পরার মতো। সেখানে তাঁরা আদৃত ও প্রশংশিত। বৌদ্ধদের মতে পতিতাবৃত্তি হল জীবিকা নির্বাহের একটি উপায়। সুতরাং তা ঘৃণিত হতে পারে না। বরং বৌদ্ধ-সাহিত্যে দেখা যায় তা অনেক সময় অনেক ব্যাপারে বারবণিতারা সমাজকে সাহায্য করেছেণ। কখনো কখনো তাঁদের জনপদকল্যাণী বা নগরশোভিনী নামেও অভিহিত করা হয়েছে।
বৌদ্ধ-সাহিত্যে এমন সাক্ষ্যও আছে যে লিচ্ছবিদের অনুরোধ উপেক্ষা করে স্বয়ং বুদ্ধদেব বারাঙ্গনা আম্রপালীর ঘরে তাঁর ভিক্ষু-সংঘের অন্যান্যদের নিয়ে ঘটা করে নেমতন্ন খেয়ে এসেছেন।(মহাপরিনিব্‌বান সূত্তং)। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ইনি সেই আম্রপালী সর্বাঙ্গসুন্দর নারী হবার কারণে বৈশালীর তৎকালীন নিয়ম অনুসারে যাঁকে গণভোগ্যা হতে হয়েছিল। পরে আম্রপালী তাঁর প্রিয় আমবাগানটি বৌদ্ধ-সংঘকে দান করেছেন এবং বুদ্ধদেবের অনুমতি নিয়ে ভোগ-বিলাসের জীবন ছেড়ে  ভিক্ষুনী সংঘে যোগ দিয়েছেন, সাধনার মাধ্যমে অর্হত্ব লাভ করেছেন।
এই ভাবে ওই সময়ের অনেক গণিকাই মনোযোগ দিয়ে বুদ্ধের উপদেশ শুনেছেন, তাঁদের কেউ কেউ ভিক্ষুনী-সংঘে যোগ দিয়েছেন এবং নিরলস কর্মের মাধ্যমে ধর্মচিন্তার উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ন হয়েছে। আম্রপালী ছাড়াও আরো অন্তত তিনজন বারাঙ্গনার কথা জানা যায় যাঁরা ভিক্ষুনী সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন অভয়মাতা (পদ্মমাতা বা পদুমাবতী), বিমলা এবং অর্ধকাশী(অড্‌ঢকাসী) । তাঁদের লেখা থেরিগাথা পড়লে বোঝা যায় তাঁরা ছিলেন উচ্চশ্রেণির বারবণিতা এবং তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। আবার ভিক্ষুণী হবার পর তাঁরা সবাই শিক্ষার ও সাধনার জগতে সর্বোচ্চ-স্তরে উঠতে পেরেছিলেন।
আবার অন্তঃপুরবাসিনীদের অনেকেই উপাসিকা হয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচারে ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন এবং উচ্চমানের সামাজিক জীবন কাটিয়েছেন। 
বৌদ্ধধর্মের প্রভাবেই এই সময়ে নারীদের মধ্যে সৌন্দর্য-সচেতনতা, পোশাক-সচেতনতা, অলংকার-সচেতনতা, রূপ-চর্চা, নাচ-গান, শিল্প-কলার চর্চা একটা অন্য মাত্রা পেয়েছিল। আবার বৌদ্ধধর্মে নর-নারীর সমতা স্বীকৃত হবার ফলে পরবর্তী সময়ের ভারতীয় সমাজ-জীবনেও তার প্রভাব পড়েছিল।
বৌদ্ধধর্মে যেহেতু কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না, কোনো সর্বজনমান্য গুরুর আবির্ভাব ঘটেনি, নানান বৌদ্ধ-সম্প্রদায়গুলির ভিতর তাই কোনোদিনই কোনো ঐক্য গড়ে ওঠেনি। নানা দেশে বৌদ্ধধর্মের বিকাশও নানান পথে। অজস্র আচার-বিচার-সংস্কার বিশেষ করে তন্ত্র ও যৌনতা মিশে গিয়ে তার অনেক  দুর্বলতা তৈরি হয়েছে, সংঘগুলিতে বিস্তর অবাঞ্ছিত লোকজনের নানান অপকর্ম ও দুর্নীতি-অনাচারের ফলে সমগ্র বৌদ্ধধর্মের অনেক বদনাম তৈরি হয়েছে। এমনকি বৌদ্ধ-দেশ থাইল্যান্ডে যে সমাজ অনুমোদিত সেক্স-টুরিজিমের চল আছে, পশ্চিমের অনেকেই তার দায় বৌদ্ধধর্মের ঘাড়ে চাপাতে চান, তাঁরা ভুলে যান প্রতিটি দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির নিজস্ব অভিব্যক্তি আছে , এবং থাইল্যান্ডের এই ঘটনা সেই বিকাশের ফল । এত কিছুর পরেও কিন্তু বুদ্ধের বচন, বাণী ও উপদেশের গায়ে কোনো মলিনতার ছাপ লাগেনি। 
বুদ্ধদেব সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে শান্তি অহিংসা দয়া ও করুণার প্রথম শিক্ষক। সেই শিক্ষক থেকেই জনসমাজের ভালোবাসায় কখন যেন তিনি দেবতাতে পরিণত হয়েছেন। তাঁকে ঘিরে অনেক অলোকিক গল্পগাথা, কিংবদন্তী, মিথ। আলোকপ্রাপ্ত মানুষটিকেই করে ফেলা হয়েছে আলোকপ্রাপ্তির উৎস।
প্রাচীন ভারত থেকে তিব্বত, চিন, মঙ্গোলিয়া, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস কোন দেশের জীবনযাত্রায় না পৌছেঁছে তথাগতের জীবন-দর্শনের ছোঁয়া। তবে বৌদ্ধধর্মের এই বিশ্ববিজয় কিন্তু সম্পূর্ণ অহিংস পথে। এই ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য কখনো অস্ত্রের দরকার পরেনি। বৌদ্ধধর্ম কখনোই বড়ো কোনো যুদ্ধের কারণ হয়নি। বরং বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে সিল্ক-রুট দিয়ে সেই প্রাচীন কালেই নানান দেশের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। নানান আদান-প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। বৌদ্ধদের হাতে খোটান রাজ্যের পত্তন হয়েছে। মধ্য-এশিয়ায় নানান বৌদ্ধমঠ গড়ে ওঠার কারণে বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীদের হাতে সেখানকার মরু অঞ্চলের ব্যাপক সবুজায়ন ঘটে গেছে। বৌদ্ধধর্ম এবং দর্শনের উপর প্রচুর পুঁথি লেখা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই সংস্কৃত, কিছু কিছু পালিতে। মূল থেকে অন্য ভাষায় সেইসব বৌদ্ধ-পুঁথির অনুবাদ ঘটেছে। এর মধ্যে দিয়ে ভাষা-চর্চার প্রসার ঘটেছে।
সব চেয়ে লাভবান হয়েছে চিন। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের মধ্যে দিয়েই মধ্য-এশিয়ার তোখারিয়ানরা চিনদেশে দুধের প্রচলন করেছেন। চিন-দেশে যে তুলো-চাষ তাও গেছে ভারতের পূর্ব-বঙ্গ এবং কাশ্মীর থেকে। তুলো-চাষ শুরু হবার আগে চিন দেশে কাগজ তৈরি হত সিল্ক থেকে। পরে সেই জায়গা দখল করেছে তুলো। চিন দেশে প্রথম যে বইটি ছাপা হয়েছিল তাও ছিল একটি বৌদ্ধ-পুস্তক বজ্রছেদিকা। (বইটি এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছে)।  কম্বোজ থেকে চিনে উপহার হিসেবে গেছে আখ-চাষ এবং চিন-রাজের প্রতিনিধিরা ভারতবর্ষে এসে মগধ থেকে শিখে নিয়ে গেছে চিনি তৈরির কায়দা-কানুন। এইভাবে বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে সেই সময়েও ঘটে গেছে এক বিশ্বায়ন।
মজাটা দেখুন, আজকের বিশ্বায়নে একদিকে পশ্চিমি-সভ্যতা-প্রসূত পণ্য ও বাজার-নির্ভর ভোগবাদের জীবন প্রতি আরা পৃথিবীর মানুষের মনে নিয়ত অজস্র মিথ্যে ধারণা, মিথ্যে মূল্যবোধের জন্ম দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে বুদ্ধদেবের বাণী ও উপদেশ আড়াই হাজার বছর আগে যতটা টাটকা ও তাজা ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে। শুধু তাই নয় আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে দিনে দিনে নানা দিক দিয়ে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়, মানবিধিকার, পরিবেশ-রক্ষা ব্যাপারগুলিতে নানাদেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক বোঝাপড়া ক্ষেত্রে শাক্যমুনির দেখানো পথই বিশ্ববাসী অনুসরণ করছেন। পশ্চিম সহ সারা বিশ্বের নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু বৌদ্ধ-তত্ত্ব পড়ানোর জন্য আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছে।
আধুনিক সময়ে প্রবল হয়ে উঠেছিল যুক্তিবাদ। যখনি যুক্তিবাদ এল তার পিছনে এল বিভ্রান্তি। আবার পোস্টমর্ডান সময়ে যখনি বলা হল ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট চিন্তা-ভাবনার পিছনে সত্য বলে কিছু নেই তখনি জাতীয়-স্বার্থের চেয়ে বিশ্ব-মঙ্গলের উপর বিশ্বাস বেড়ে গেল। অনেক পোস্টমডার্ন দাবি করলেন জাতীয়তাবাদের গণ্ডি মানবিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা বড়ো বাধা। তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস ব্যক্ত করে জানিয়ে দিলেন জাতীয়তাবাদ যুদ্ধের জন্ম দেয়। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে তাঁদের কাছে একটি বিশ্বসমাজের গুরুত্ব তাই বেড়ে গেল। তাঁরা প্রায়শই আন্তর্জাতিক হবার কথা বলেন, নানা দেশকে এক করার কথা বলেন।   
রাষ্ট্রের যে আধুনিক ধারণা স্বভাবতই বুদ্ধের সময়ে তা ছিল না। আবার সেই সময়ে অনেক ছোটো ছোটো রাজ্য ছিল তাদের আলাদা আলাদা শাসন-কর্তা ছিলেন। বৌদ্ধধর্ম কিন্তু এই রকম কোনো একটি বিশেষ রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বা কোনো বিশেষ রাজ্যের নিয়ম-কানুন তাদের উপর প্রযোজ্য ছিল না। সংঘগুলি চলত তাদের নিজস্ব নিয়মে। আবার প্রতিবেশী রাজ্যগুলির মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা কলহ লাগলে অনেক সময় বুদ্ধদেব তার মীমাংসা করছেন এমন সাক্ষ্য আছে ।
মানবিক কল্যাণ, শান্তি, অহিংসা এইসব গুণের পাশাপাশি বৌদ্ধধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্যটি হল পরধর্মমত সহিষ্ণুতা। সেই সব গুণের জোরেই বৌদ্ধধর্ম একসময় সারা ভারতবর্ষ তো বটেই আবার ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে নানা প্রতিবেশী দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমশই এক বিশ্বজনীন ধর্মে  পরিণত হয়েছে। 
গত আড়াই হাজার বছর ধরে বৌদ্ধধর্মকে অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে। চিন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যাণ্ড, শ্রীলঙ্কা, বার্মা, তিব্ব্‌ত, মঙ্গোলিয়া থেকে আজকের ইউরো-আমেরিকা। এবং লক্ষনীয় যে কোনো রকম কেন্দ্রীয় খরদারি না থাকার ফলে বৌদ্ধধর্ম যখন যে দেশে গেছে তার সঙ্গে সেই দেশের স্থানীয় আচার-আচরণ-সামাজিক প্রথা-দেশাচার-কুলাচার-সংস্কারও সংযুক্ত হয়ে গেছে। তার অজস্র বিচ্যুতি ঘটেছে। তবুও বৌদ্ধধর্মের মূল যে প্রাণ অর্থাৎ ব্যক্তি-মানুষের অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা মহাশক্তির জাগরণ তা কিন্তু একই রয়ে গেছে। এবং সেই কারণেই এই সময়ের ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি, দর্শন এই সব নানা আলোচনায় বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ বার বার এসে যাচ্ছে।
আমরা এমন একটা সময়ে এসে পৌঁছেছি যখন প্রযুক্তিগত উন্নতি আকাশ-ছোঁয়া, চারপাশে ঘটে চলা পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানান জটিলতা। মানুষ বুঝতে পারছে এই নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে দরকার জীবন-সম্পর্কে সমাজ-সম্পর্কে এক সম্পূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। একমাত্র বৌদ্ধধর্মই পারে এ-ব্যাপারে পথ-প্রদর্শক হতে। 
অবশ্যই যদি কেউ বৌদ্ধধর্মকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পেতে চান। কারণ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে এবং দীর্ঘদিন চর্চা করার পরেও জাপান কিন্তু যুদ্ধের মানসিকতা ভুলতে পারেনি। তার হাতেই আক্রান্ত হয়েছিল চিন । জেন-পন্থী বৌদ্ধরা জাতীয়তাবাদ, সামরিক ক্ষেত্র এবং বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অংশ নেওয়াকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করেছিল। সে-সব প্রত্যক্ষ কোঁড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পত্রপুট-এর সতেরো নং কবিতায়  লিখলেন
যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে ।
ওদের ঘাড় হল বাঁকা , চোখ হল রাঙা ,
          কিড়্‌মিড়্‌ করতে লাগল দাঁত ।
মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভর্তি করতে
                     বেরোল দলে দলে ।
সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে
                      তাঁর পবিত্র আর্শীবাদের আশায় ।
            বেজে উঠল তূরী ভেরি গরগর শব্দে ,
                     কেঁপে উঠল পৃথিবী ।
 
         ধূপ জ্বলল , ঘণ্টা বাজল , প্রার্থনার রব উঠল আকাশে
                   ‘ করুণাময় , সফল হয় যেন কামনা ' —
কেননা , ওরা যে জাগাবে মর্মভেদী আর্তনাদ
                             অভ্রভেদ করে ,
          ছিঁড়ে ফেলবে ঘরে ঘরে ভালোবাসার বাঁধনসূত্র ,
                   ধ্বজা তুলবে লুপ্ত পল্লীর ভস্মস্তূপে ,
          দেবে ধুলোয় লুটিয়ে বিদ্যানিকেতন ,
                   দেবে চুরমার করে সুন্দরের আসনপীঠ ।
তাই তো চলেছে ওরা দয়াময় বুদ্ধের নিতে আশীর্বাদ ।
          বেজে উঠলো তূরী ভেরি গরগর শব্দে ,
                             কেঁপে উঠলো পৃথিবী ।
 
ওরা হিসাব রাখবে মরে পড়ল কত মানুষ ,
                             পঙ্গু হয়ে গেল কয়জনা ।
তারি হাজার সংখ্যার তালে তালে
                                 ঘা মারবে জয়ডঙ্কায় ।
পিশাচের অট্টহাসি জাগিয়ে তুলবে
       শিশু আর নারীদেহের ছেঁড়া টুকরোর ছড়াছড়িতে ।
ওদের এই মাত্র নিবেদন , যেন বিশ্বজনের কানে পারে
                                          মিথ্যামন্ত্র দিতে ,
যেন বিষ পারে মিশিয়ে দিতে নিশ্বাসে ।

সেই আশায় চলেছে ওরা দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে
                নিতে তাঁর প্রসন্ন মুখের আশীর্বাদ ।
                বেজে উঠছে তূরী ভেরি গরগর শব্দে ,
                                   কেঁপে উঠছে   পৃথিবী ।
এই একই প্রসঙ্গে নজাতক কবিতার বুদ্ধভক্তি কবিতায় লিখেছিলেন
জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি, জাপানি সৈনিক যুদ্ধের সাফল্য কামনা কোঁড়ে বুদ্ধ-মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিল। ওয়রা শক্তির বাণ মারছে চিনকে, ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।
জাপানের শাক্যমুনির ভক্তদের এই দ্বিচারিতা কবিগুরুর পছন্দ হয়নি। তিনি বজাতক কবিতায় আরো লিখলেন
হিংসার উষ্মায় দারুণ অধীর
সিদ্ধির বর চায় করুণানিধির
                                        ওরা তাই স্পর্ধায় চলে
                                        বুদ্ধের মন্দিরতলে
          সুতরাং বুদ্ধের উপাসক হলেই বৌদ্ধ হওয়য়া যায় না। বুদ্ধত্ব অর্জন করোতে হয়।
এত গেল যুদ্ধবাদী বৌদ্ধদের কথা। এর উলটো দিকে যাঁরা অত্যাচারিত তাঁরাও আছেন। অনেক সময় অনেক বৌদ্ধ-সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী রাষ্ট্রের শাসনের শিকার হয়েছেনতিব্বতে অনেক মঠকে ধ্বংস করা হয়েছে।  তিব্বত ছাড়াও ভিয়েতনাম, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, কাম্পুচিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আছে।
তাই কেউ কেউ চাইছেন বৌদ্ধধর্মকে আরো যুগোপযোগী করে তুলতে তার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করতে। প্রতিরোধীর ভূমিকা। কেউ কেউ তো এশিয়ার বৌদ্ধ-জ্ঞানের সঙ্গে আমেরিকার বৌদ্ধদের সক্রিয়তাকে মিশিয়ে শুরু করতে চাইছে বৌদ্ধধর্মের এক নতুন পথ চলা।
আধুনিক সময়ে এসে তাইক্সু ও ইনশানের শিং য়ুয়ানদের মতো মহাযান-পন্থী বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীরা বললেন মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের কথা। তার মানে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটা মানুষের এক সংহত আধ্যাত্মিক বিকাশ। তাঁরা দাবি করলেন তাদের এই মতবাদ নানা সময়ে বুদ্ধদেব যে সব উপদেশ দিয়েছেন তার সব কটিকে মান্যতা দেয়। তার লক্ষ্য বোধিসত্ত্ব-বোধের ভিতর জীবন কাটানো, যার মানে একজন আলোক-প্রাপ্ত,  তরতাজা, মনোরম মানুষ যে সমস্ত প্রাণিকেই বোধি লাভে (মুক্ত হতে) সাহায্য করবে। স্বভাবতই এই মতবাদ পরলোকের ভাবনা না করে মানুষকে ইহজীবনের সমস্যাগুলির কথা চিন্তা করতে বলে, মৃত্যুর পরে কী হবে সে বিষয়ে ভেবে মাথা ভারি না করে জীবনকে সুন্দর করতে বলে, স্বার্থচিন্তা না করে অন্যকে সাহায্য করতে বলে, শুধুমাত্র নিজের মুক্তির কথা না ভেবে বিশ্বমানবের মুক্তির উপর জোর দিতে বলে।  
আমরা চিনে দেখলাম বৌদ্ধ-সমাজতন্ত্র নামে এক রাজনৈতিক মতাদর্শকে যা বৌদ্ধধর্মের উপর ভিত্তি করে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কথা বলল। সেখানে যেমন সমাজতান্ত্রিক ধারায় মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা এবং শ্রেণি-বৈষম্যের অবসানের কথা বলা হল তেমনি শ্রমিককৃষকের মধ্যে  বৌদ্ধ-ঐতিহ্য মেনে নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে বিষয়ের প্রতি আসক্তিকে জয় করার কথাও বলা হল।
এই তত্ত্বেরই অন্যতম প্রবক্তা ভিক্ষু বুদ্ধদাস ধাম্মিক সমাজতন্ত্র বলে একটি শব্দ তৈরি করলেন। তিনি বললেন সমাজতন্ত্র একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, তার মানে একই আকাশের নীচে সবকিছুর সহবস্থান।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সেখানকার জেন-বৌদ্ধ - Thich Nhat Hanh (known as Thay to his students), চিনের তাইক্সু ও ইনশানের মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের আন্দোলনে উৎসাহিত হয়ে জন্ম দিলেন  লিপ্ত বা এনগেজড বৌদ্ধধর্ম-র ধারণা।
আসলে চিনের তিব্বত আক্রমণ, শ্রীলঙ্কার বা কাম্পুচিয়ার তিক্ত জাতিদাঙ্গা, বার্মার সামরিক একনায়কত্ব এসব ব্যাপারগুলো এই-সময়ের বৌদ্ধধর্মের সামনেও নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বৌদ্ধধর্ম সব রাজনৈতিক ইস্যুতে লিপ্ত হবে কি হবে না এই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নিয়েছে লিপ্ত বৌদ্ধধর্ম, যা আবহমান নির্লিপ্ত বৌদ্ধধর্মের ঠিক বিপরীত।
এই লিপ্ত-বৌদ্ধধর্মই আবার চিনে ফিরে হয়ে গেল "Left Wing Buddhism"।     
ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক জাতপাতের রাজনীতিতে আম্বেদকারের নেতৃত্বে দলিত-সম্প্রদায়ের মানুষজনের দলে দলে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথায় তিতিবিরক্ত হয়ে আম্বেদকর প্রথমে ভেবেছিলেন শিখধর্মে দীক্ষিত হবেন। পরে খ্রিস্ট ও বুদ্ধ-চরিত তাঁকে আকৃষ্ট করে। কিন্ত যখন তিনি জানতে পারলেন দক্ষিণ-ভারতের গির্জাগুলিতে এখনো জাতিভেদ-প্রথা চালু আছে তখন তিনি বুদ্ধধর্মকেই বেছে নিলেন।
         আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা চিনের তিব্বত আগ্রাসনের পর সদলবলে তিব্বতী ধর্মগুরু দলাই লামার ভারতে আশ্রয়। 
এবার বলতে হয় নানা দেশে যে সব রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে করে যে নতুন প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে চলে আসছে তা হল মানবাধিকার।
পশ্চিমি মানুষদের কথাবার্তায় একটা অহংকার লুকোনো থাকে যে আরো অনেক ধারণার মতো মানবাধিকার এই ধারণাটিও পশ্চিমি চিন্তা-চেতনার ফসল। আবার পশ্চিমি মানুষদের একটা প্রবণতাই হল সব সময় ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, সংস্কৃতি এদের আলাদা আলাদা করে দেখা। কিন্তু এই পৃথিবীতে নানান দেশ নানান জাতি তাদের হাজারো রকম ধর্ম অজস্র ঐতিহ্য এবং মানুষের সামাজিক জীবনে সে-সব কিছুর গুরুত্ব অপরিসীম। আর এটা বলাটা অসংগত হবে না যে সমস্ত সমাজের এবং সমস্ত ধর্মের মূলকথা কিন্তু প্রায় এক। মানুষের মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তোলা এবং মানুষকে হিংসা-হত্যা ইত্যাদি থেকে বিরত রাখা। সুতরাং সব ধর্মই কম-বেশি মানবাধিকারের কথা বলে। আধুনিক যুগের ইউরোপ এই বৈচিত্রকে ঠিক মতো উপলব্ধি করতে  পারেনি। কারণ মানবাধিকার আন্দোলনের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৪৮-এর ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র জারি করেছে। তা সেই বিশ্বযুদ্ধের কারণ তো তথাকথিত ইউরোপীয় রাষ্ট্র-নায়কদের অপরিসীম লোভ ও দখলদারির মনোভাব।
প্রাচ্য ও পশ্চিমের বৌদ্ধ-নেতারা এখন এখন পশ্চিমিদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই মানবাধিকারের পক্ষে নিয়মিত সওয়াল করে চলেছেন। তাঁরা বলছেন সময়ের দাবি মেনে বৌদ্ধধর্মকেও নতুন ভূমিকায় অবতীর্ন হতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বৌদ্ধধর্মে কি মানবাধিকার প্রসঙ্গ অনুচ্চারিত থেকে গেছে। তাকে কি পশ্চিমের কাছ থেকে মানবাধিকারের পাঠ নিতে হবে। বৌদ্ধধর্ম মানে তো কতকগুলো নীতি বা আদর্শকে অন্ধ ভাবে মেনে চলা নয়।
কারো কারো মতে রাষ্ট্র-সংঘ-প্রচারিত মানবাধিকারের যে আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র এবং তাতে ন্যয্য মজুরি, ছুটি ও কল্যাণের জন্যে শ্রমিকদের নানা অধিকার থেকে শুরু করে মানবাধিকারের নানান কথা বলা হয়েছে তার সব কিছুই সামগ্রিক ভাবে সমাজ ও জীবন সম্পর্কে বুদ্ধদেবের বাণী ও উপদেশের মধ্যে নিহিত আছে।   
করুণাময় ও সব মানুষের কল্যাণকামী বুদ্ধ তাঁর উপদেশ ও শিক্ষায় এমন কোনো কথা বলেননি যা মানুষের বিরুদ্ধে যায়, মানবাধিকারের বিপক্ষে যায়। তিনি বলেছেন সব মানুষই সমান। বলেছেন সব মানুষের মধ্যেই নিজেকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে বিকশিত করার অসীম ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। প্রত্যেক বীজের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা অঙ্কুর যেমন উপযুক্ত জল-মাটি-হাওয়া পেলে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত করতে পারে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেও তেমনি সেই সম্ভাবনা নিহিত আছে যা উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতির আনুকূল্য পেলে যা নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে মেলে ধরতে পারে । বুদ্ধত্ব মানে তো সেই পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব বা বোধিসত্ত্ব লাভ। যে কারণে বৌদ্ধধর্ম তত্ত্বের চেয়ে কর্মের উপর বেশি জোর দেয়। সে বলে মানূষ ভালো বা মন্দ যে কাজই করুক না কেন তার সম্পূর্ণ উত্তরাধিকার সেই মানুষকেই বয়ে নিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ কুশল বা অকুশল কাজ করলে সে সুখ বা দুঃখ পাবে। তাই মানুষের উচিত অকুশল কাজ ত্যাগ করে কুশল কাজ করা। অপ্‌পামাদেন সম্‌পাদেখ (অপ্রমত্ত হয়ে কুশল কর্ম সম্পাদন কর) (ধম্মপদ-অপ্‌পমাদবগ্‌গো, ৫) এই হল বুদ্ধের বাণী। তিনি বলেছেন- মেধাবী উত্থান অপ্রমাদ সংযম ও দমের দ্বারা এমন দ্বীপ তৈরি করবেন যা মানসিক দ্বন্দ্ব সংঘাতরূপ প্লাবনেও ধ্বংস হবে না। তিনি বলেছেন মূল্যহীন সহস্র বাক্যের চেয়ে চিত্ত শান্তকারী মাত্র একটি বাক্যই শ্রেষ্ঠ।(ধম্মপদং-৮/৩)। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন যদি কেউ যুদ্ধে সহস্র ব্যক্তিকে জয় করেন, অন্য দিকে কেউ যিনি কেবল নিজেকে জয় করেন তাহলে জয়শীল উভয় ব্যক্তির মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ । (ধম্মপদং-৮/৪)। অর্থাৎ একটা কথা পরিষ্কার বুদ্ধদেব মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছিলেন; সেই শক্তির মহিমা প্রচার করেছিলেন। দয়া বা কল্যাণের জন্যে কোনো দেবতার কৃপাপ্রার্থী না হয়ে তিনি মানুষের হৃদয় থেকে তার আত্মপ্রকাশ চেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে চৈতন্য-ভাবনায় দীক্ষিত বাঙালি কবি চণ্ডীদাস এই বাণীকেই কবিতায় রূপ দিয়ে বলেছিলেন সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’’। পাশাপাশি বুদ্ধদেব আরো বলেছিলেন একজন মানুষকে শুধু নিজের মুক্তির কথা ভাবলে হবে না তাঁকে সমষ্টি-মানুষের মুক্তির কথা ভাবতে হবে।
বুদ্ধের এই ভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অধিকার মর্যাদা ক্ষমতা সব বিষয়ে সমস্ত মানুষের মধ্যে সমতা বিধানের নির্দেশ। বুদ্ধের শিক্ষা বলে প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব বিবেকবোধ ও যুক্তিবোধ আছেতাকে সম্মান করতে হবেশ্রদ্ধা করতে হবে। বুদ্ধের বাণী ও উপদেশে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের বার্তা আছে মানুষের জীবনে প্রধান তিনটি শ্ত্রু হল ঘৃণা, লোভ, মিথ্যা-মায়া এবং আমরা জানি এসব কিছুই হল পৃথিবীর যাবতীয় হিংসার মূলে সুতরাং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাদের বশ করা দরকার আজকের দিনে বৌদ্ধধর্মকে পৃথিবীর সবচেয়ে সহনশীল ধর্ম বলে মনে করা হয়।    
এ প্রসঙ্গে আমরা আবার রবীন্দ্রনাথের শরণ নিতে পারি। তিনি লিখেছেন
যিনি সর্বভূতকে আপনারই মতো দেখেন এবং আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন তিনি প্রচ্ছন্ন থাকেন না। আপনাকে আপনাতেই যে বদ্ধ করে সে থাকে লুপ্ত; আপনাকে সকলের মধ্যে যে উপলব্ধি করে সেই হয় প্রকাশিত। মনুষ্যত্বের এই প্রকাশ ও প্রচ্ছন্নতার একটা মস্ত দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। বুদ্ধদেব মৈত্রীবুদ্ধিতে সকল মানুষকে এক দেখেছিলেন, তাঁর সেই ঐক্যতত্ত্ব চীনকে অমৃত দান করেছিল। আর যে বণিক লোভের প্রেরণায় চীনে এল এই ঐক্যতত্ত্বকে সে মানলে না; সে অকুণ্ঠিতচিত্তে চীনকে মৃত্যুদান করেছে, কামান দিয়ে ঠেয়ে ঠেসে তাকে আফিম গিলিয়েছে। মানুষ কিসে প্রকাশ পেয়েছে আর কিসে প্রচ্ছন্ন হয়েছে, এর চেয়ে স্পষ্ট করে ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি। (সংযোজন ৩৩) 
এমনকি আজকের পোস্টমডার্ন সমাজ যে পরিবেশ রক্ষার পক্ষে এত সওয়াল করছে, বলছে মাতা বসুন্ধরাকে রক্ষা করার কথা, বৌদ্ধধর্মে কিন্তু তাও ছোঁয়া কিছু কম নেইযদিও আজকের মতো পরিবেশ রক্ষার মানসিকতা থেকে নয় বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীদের পরিবেশ-চেতনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁরা চারপাশকে সুন্দর করার জন্যে গাছ লাগাতেন। আগেই বলেছি এক সময় তাঁদের হাতে মধ্য-প্রাচ্যের মরু-অঞ্চলের সবুজায়ন ঘটেছিল।
বুদ্ধ জীবন-চরিতে গাছের তথা প্রকৃতির ভূমিকা অপরিসীম। তাঁর জন্মের সময় লুম্বিনি বাগানে তাঁর মা শালগাছকে আঁকড়ে ধরেছেন। কাঁঠাল গাছের তলায় তাঁর প্রথম সাধনা। তারপর জগৎ-বিখ্যাত সেই পিপলগাছ বা বোধিবৃক্ষ যার তলায় বসে গৌতমের সিদ্ধিলাভ। সারনাথের মৃগদাবে ধর্মচক্র-প্রবর্তনা থেকে শুরু করে কোনো না কোনো গাছের নীচে বসেই তাঁর যাবতীয় ধর্ম-প্রচার। আবার জোড়া-শালগাছের নীচে তাঁর পরিনির্বাণ। বৌদ্ধধর্মে ব্যপকভাবে প্রতীকের ব্যবহারও লক্ষ করার মতো। নির্বাণ বোঝাতে হরিণ, আলোক-প্রাপ্তি ও শুদ্ধতা বোঝাতে পদ্মফুল।  
বৌদ্ধযুগে এই পদ্মফুল নানাভাবে নানা চিত্র-ভাস্কর্যের মোটিফ হিসেবে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। বুদ্ধের জন্মের ঠিক আগে তাঁর মা মায়াদেবী স্বপ্নে যে সাদা হাতিটিকে দেখলেন তার শুঁড়ে ছিল পদ্মফুল। অজন্তা গুহাচিত্রে বুদ্ধের যে বিখ্যাত ছবিটি আছে তাঁর হাতেও সেই পদ্মফুল, ফলে সেখানে বুদ্ধের নাম হয়ে গেছে পদ্মপানি। সাঁচি-স্তুপের একজন দ্বারপালের উপরে তুলে ধরা হাতে দেখা যাচ্ছে কোনো অস্ত্র নয় আছে একটি পদ্মফুল।  সুতরাং এই পদ্মফুলকে বলা যায় বিশ্বশান্তির প্রতীক। আবার আধুনিক ঐতিহাসিকদের কী অবাক করা বিশ্লেষণ দেখুন, এই বিশ্বশান্তির বার্তা দিতে চাওয়া বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও তোলা হয়েছে যে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষের রাজনৈতিক কাঠামো এবং সামরিক শক্তিকে দুর্বল করেছে, যার ফলে পরবর্তীতে এই দেশ ঠিক মতো বিদেশি-শক্তির আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রের মোকাবিলা করাটাই সব নয়, অস্ত্রের শাস্ন দু-দিনের। শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নস্তুপ পিছনে ফেল সাধারণ মানুষের জয়যাত্রা কিন্তু চলছেই, যে মানুষেরা নীরবে কাজ করে আর কায়মনোবাক্যে প্রাকৃতিক সুখ শান্তি ও ভালোবাসা চায়।  
অবশ্য আঠারো শতকের শেষে শুরু হওয়া যে শিল্প-বিপ্লবকে একদিন পণ্ডিতরা মানব-সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম প্রধান মাইলস্টোন বলে চিহ্নিত করেছিলেন, এখন দেখা যাচ্ছে আজকের বিশ্ব-উষ্ণায়নের বেশির ভাগটাই হল সেই তথাকথিত মাইলস্টোনটির ফল। কারণ শিল্পবিপ্লবের সময়ে একদিকে হাজারে হাজারে কারখানা তৈরি হল, যন্ত্র বা ইঞ্জিনের ব্যবহার বেড়ে গেল, ফলে তাদের উগড়ে দেওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড মিশে গেল বাতাসে, বাতাসে অবাধে মিশল ভয়ানক সব গ্রিন-হাউস গ্যাস। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন এবং  সালফার হেক্সাফ্লুরাইডের মতো মারণ-গ্যাস তো শিল্পবিপ্লবের আগে ছিলই না। অন্যদিকে রেল-লাইন পাতা, পরিকাঠামো তৈরি করা, নগরায়নের ফলে অজস্র গাছ কাটা হল, পরিবেশকে ধংস করা হল নির্বিচারে । তখন ইউরোপের মাথায় পরিবেশ ভাবনার নামগন্ধও ছিল না। 
অভিযোগ উঠেছে আধুনিক সময়ের ওই রকমেরই আরেকটি মাইলস্টোন কৃষি-বিপ্লবের বিরুদ্ধেও। কৃষির ফলন বাড়ানোর জন্যে সংকর-জাতের কৃষি-বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হল। পণ্ডিতরা বলছেন এতে করে ব্যপক ভাবে নষ্ট হয়েছে জৈব-বৈচিত্র। তার উপর বড়ো বড়ো বাঁধ-নির্মাণ সেটাও পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিয়েছে।
এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন বলা যায় আধুনিক সময় পরিবেশ সুরক্ষার ব্যপারে চরম উদাসীনতা দেখিয়েছে। টনক নড়েছে মাত্র এই সেদিন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে বড়ো বড় আর্থ-সামিট। পিপিএম-এর হিসেব। স্টকহোম থেকে শুরু করে নাইরোবি হয়ে রিও-ডি-জেনারো, কিয়োটো প্রোটোকল, ভিয়েনা ট্রিটি, বালি-আকশনপ্লান হয়ে কোপেনহেগেন। নানা স্তরে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, নিয়ম-বিধি তৈরি কড়া, চুক্তি সই সবই সেই কিভাবে ধ্বংসের হাত থেকে মাতা-ধরিত্রীকে রক্ষা করা যায়। 
আজ এই ২০১১-তে এসে সূর্যোদয়ের দেশে যে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প ও সুনামির ঘটনা ঘটল, বিদ্যুৎ তৈরির কাজে লাগানো পারমাণবিক চুল্লিগুলিতে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে চলল, জলে-স্থলে-বায়ুতে ছরিয়ে পড়ল ভয়ংকর তেজস্ক্রিয়তা, তাতে বিজ্ঞানীরা আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন বিজ্ঞান ও প্রগতি  কখোনোই সর্বশক্তিমান হতে পারে না। তাঁরা উপলব্ধি করছেন যে মানুষের স্বার্থে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোরও সীমানা নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। অগ্রগতির নাকে লাগাম পরানোর কথাও বলা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে নিজের অগ্রগতির স্বার্থে মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে কতদূর যাবে। মানুষ বুঝে গেছে নিজের রকমারি জাগতিক চাহিদা মেটানোর স্বার্থে অতিরিক্ত প্রকৃতি-শোষণ বা প্রকৃতি-বিরোধীতা করা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারা অর্থাৎ ধংসকে ডেকে আনা। সুতরাং আজকে যাকে পরিবেশ দূষণ বলা হচ্ছে তাঁর পিছনেও কাজ করছে মানুষের সেই অপরিসীম লোভ ও ভয় এবং অতিরিক্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভরতা।
বুদ্ধের বাণী ও উপদেশে এই লোভ ও ভয়কে জয় করার কথাই বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্ম জোর দিয়েছে মানুষের চাহিদা নয় প্রয়োজন মেটানোর উপর। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ অঙ্গাঙ্গী ভাবে মিশে আছে। বৌদ্ধধর্মের মূল যে কথা অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভ তাও তো সেই ব্যক্তি-মানুষের নিজের ভিতর মহাপৃথিবী তথা মহাপ্রকৃতির অনুভূতিকে উপলব্ধি করা। বুদ্ধ-প্রকৃতির স্বাদ লাভ করা। সেই অনুভূতির সবখানে রয়ে যায় প্রকৃতির স্পর্শ। বৌদ্ধধর্মকে তাই আর আলাদা করে পরিবেশ-সংরক্ষণের কথা বলার দরকার পরে না। 
প্রকৃতির উপর খরদারি করে তাকে নিজের বশে আনতে হবে আধুনিকদের এই ধারণাটাই সমস্ত সর্বনাশের মূল কারণ, বুদ্ধের নীতি কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কারণ বৌদ্ধধর্ম মনে করে মানুষ এই প্রকৃতিরই একটা অংশ। Klas Sandell সম্পাদিত "Buddhist Perspectives on the Ecocrisis"-বইটির একজায়গায় লিলি ডি সিলভা সুন্দর করে বলেছেন - "The Buddhist admonition is to utilise nature in the same way as a bee collects pollen from a flower, neither polluting its beauty nor depleting its fragrance. Just as the bee manufactures honey out of pollen, so man should be able to find happiness without harming the natural world in which he lives."

এখানে উল্লেখ না করে পারছি না, গাছেদের নিয়ে যে কবিতার বই, সেই বনবাণী-র ভূমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথেরও মনে পড়েছিল বুদ্ধদেবের কথা। তিনি লিখেছিলেন
বুদ্ধদেব যে বোধিদ্রুমের তলায় মুক্তিতত্ত্ব পেয়েছিলেন, তাঁর বাণীর সঙ্গে সঙ্গে সেই বোধিদ্রুমের বাণীও শুনি যেনদুই-এ মিশে আছে।
২৫০০ বছর পরেও তাই গৌতম বুদ্ধের জ্ঞান ও বাণী সারা পৃথিবীর নানা দেশের অজস্র মানূষকে আলোর দিশা দেখাচ্ছে। তাদের চিন্তা-চেতনাকে ভাবিত করছে পুষ্টি যোগাচ্ছে চালিত করছে। পূর্ব থেকে , এশিয়া থেকে ইউরোপ সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই মানুষেরা আজ অনেকেই বুঝতে পারছেন নিজেকে প্রকৃত এবং সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নিজের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা মানবিকতাকে আবিষ্কার করতে হলে সেই পরম-সৌগতকে স্মরণ করা ও তাঁর শরণ নেওয়া একান্ত জরুরি।
এই লেখা শেষ করার আগে, আসুন, আমরা আরেক বার স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথকে, যিনি তাঁর বোরোবুদুর কবিতায় লিখেছিলেন -
           অর্থ আজ হারায়েছে সে যুগের লিখা ,
                 নেমেছে বিস্মৃতিকুহেলিকা
           অর্ঘ্যশূন্য কৌতূহলে দেখে যায় দলে দলে আসি
                       ভ্রমণবিলাসী
           বোধশূন্য দৃষ্টি তার নিরর্থক দৃশ্য চলে গ্রাসি
           চিত্ত আজি শান্তিহীন লোভের বিকারে ,
                 হৃদয় নীরস অহংকারে
           ক্ষিপ্রগতি বাসনার তাড়নায় তৃপ্তিহীন ত্বরা ,
                 কম্পমান ধরা ;
           বেগ শুধু বেড়ে চলে ঊর্ধ্বশ্বাসে মৃগয়া-উদ্দেশে ,
          লক্ষ্য ছোটে পথে পথে , কোথাও পৌঁছে না পরিশেষে ;
          অন্তহারা সঞ্চয়ের আহুতি মাগিয়া
           সর্বগ্রাসী ক্ষুধানল উঠেছে জাগিয়া
                 তাই আসিয়াছে দিন ,
                 পীড়িত মানুষ মুক্তিহীন ,
আবার তাহারে
আসিতে হবে যে তীর্থদ্বারে
শুনিবারে
পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির
কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
আকাশে উঠিছে অবিরাম

অমেয় প্রেমের মন্ত্র— ‘বুদ্ধের শরণ লইলাম

No comments:

Post a Comment