কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (৬)
প্রতিষ্ঠানবাদীরা বেদকে যতই একটা ব্র্যান্ডনেমের ভিতর আবদ্ধ করার চেষ্টা করুক মজার কথা হল বেদ কখনোই বেদবাক্য মেনে চলেনি। বেদ রচিত হয়েছিল কয়েক শো বছর ধরে। এই সময়কালে বহিরাগত আর্য-জাতি যেমন এদেশের ভূমিপুত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ফলে ক্রমাগত ভাঙন ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক বহু-জাতিতে পরিণত হয়েছিল, তেমনি বেদের বিষয়বস্তু ও বৈদিক স্তোত্রের উচ্চারণ কোনো সময়েই একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে থমকে যায়নি। কালের অভিঘাতে ক্রমাগত আপডেট হবার ফলে সেখানেও এসেছে নতুন নতুন সংবাদ, নতুন চলন-বলন, নতুন মেজাজ ও মর্জি। ঋকবেদ-সংহিতা কর্মকাণ্ডের আধার। কিন্তু ঋকবেদের শেষের দিকে দেখা গেল বৈদিক ঋষিদের কেউ কেউ কর্মকাণ্ডের ব্যবহারিক প্রয়োজনের দমবদ্ধ গতানুগতিকতা যান্ত্রিকতা এবং একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। বুদ্ধিবৃত্তি তথা জ্ঞানের চর্চা করতে চাইছে এবং তাদের মধ্যে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, মননে জন্ম নিচ্ছে নানান প্রশ্ন। জন্ম নিচ্ছে দর্শন-অভিমুখিনতা। যেমন ১২১ সূক্তটি। এটি সেই বিখ্যাত ‘কস্মৈ দেবায়’। সেখানে ১০ টি মন্ত্রের ৯টির শেষেই প্রশ্ন তোলা হল কোন দেবতাকে হবি দিয়ে পুজো করা হবে। ১০ নম্বর ঋকে জানিয়ে দেওয়া হল প্রজাপতির ছাড়া আর কেউ সব উৎপন্ন বস্তুকে আয়ত্ব করতে পারেনি।তবে ঋকবেদে দার্শনিক-চিন্তার হদিশ পেতে গেলে অবশ্যই বলতে হয় দশম মণ্ডলের ১২৯-সংখ্যক সূক্তের কথা। যেখানে চিন্তার খুব গভীরে গিয়ে প্রাচীন ঋষি চেষ্টা করেছেন সৃষ্টি-রহস্যকে জানতে। প্রশ্ন করেছেন- ‘ইয়ং বিসৃষ্টিঃ কুত আবভূব’ অর্থাৎ এই সৃষ্টি কোথা থেকে এল! এখানে সৃষ্টি-রহস্যের মীমাংসা করতে গিয়ে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে তার কিছুটা এই রকম – নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোম পরো যৎ। / কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম।। শ্রদ্ধেয় রমেশচন্দ্র দত্তের অনুসরণে বাংলা করলে তার মানে দাঁড়ায় –“সেকালে যা আছে তাও ছিল না, যা নেই তাও ছিল না। পৃথিবী ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কী ছিল? কোথায় কার জায়গা ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল? তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না। কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারী আত্মছাড়াই কেবল আত্মাকে অবলম্বন করে নিস্বাসপ্রশ্বাসযুক্ত হয়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। রাত ও দিনের ফারাক ছিল না। প্রথমে অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার ঢাকা ছিল। সবকিছু চিহ্নবর্জিত তার চারদিকে জলের তলায় ছিল। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সেই সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিল। তপস্যার প্রভাবে সেই এক বস্তু জন্মিলেন, ইত্যাদি।”তবে এই স্তোত্রের শেষ মন্ত্রটিকে চরম হেঁয়ালিপূর্ণ করে সৃষ্টি-জিজ্ঞাসা কিন্তু জিইয়ে রাখা হল। - ‘এই যে নানান সৃষ্টি তা কোথা থেকে হল, কার থেকে হল, কে সৃষ্টি করল, কী করল না, সেসব তিনিই জানেন যিনি তার প্রভুর মতো পরমধামে আছেন। অথবা তিনিও না-জানতেও পারেন’। পণ্ডিতমহলে সূক্তটিকে নাসদীয় সূক্ত বলা হয়। লক্ষ করার বিষয় এই সূক্তগুলিতে যেমন মানবমনের জিজ্ঞাসা জায়গা পেয়েছে তেমনি জেগে উঠছে বুদ্ধিশক্তি এবং ইচ্ছাশক্তি। মূর্ত থেকে বিমূর্তে উত্তীর্ন হবার কথা আছে। এই সূক্তগুলি রচিত হয়েছিল শেষের দিকে। সুতরাং তাদের পিছনে অনার্য-ভাবনার প্রভাব ছিল এই দাবি কোনো কষ্ট-কল্পনা নয়। আরো যেটা উল্লেখযোগ্য এই সময়ের বেশ কিছু স্তোত্রে এতদিন ধরে চলে আসা যজ্ঞকেন্দ্রিকতা দেবকেন্দ্রিকতা এবং ভোগসর্বস্বতাকে অতিক্রম করে আরো অনেক বিসদৃশ অসংগত এবং বিচিত্র ভাবনার সমাবেশ ঘটানো হল। ভাষাও হল ভিন্নপথগামী। সব মিলিয়ে বোঝা যায় আর্য-অনার্য ব্যাপক সংমিশ্রণের ফলে এই পর্বে একটা বুদ্ধি-বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। যা চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল অনেক পরে রচিত উপনিষদের মন্ত্রগুলিতে।