Wednesday, June 22, 2016


কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (৬)

প্রতিষ্ঠানবাদীরা বেদকে যতই একটা ব্র্যান্ডনেমের ভিতর আবদ্ধ করার চেষ্টা করুক মজার কথা হল বেদ কখনোই বেদবাক্য মেনে চলেনি। বেদ রচিত হয়েছিল কয়েক শো বছর ধরে। এই সময়কালে বহিরাগত আর্য-জাতি যেমন এদেশের ভূমিপুত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ফলে ক্রমাগত ভাঙন ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক বহু-জাতিতে পরিণত হয়েছিল, তেমনি বেদের বিষয়বস্তু ও বৈদিক স্তোত্রের উচ্চারণ কোনো সময়েই একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে থমকে যায়নি। কালের অভিঘাতে ক্রমাগত আপডেট হবার ফলে সেখানেও এসেছে নতুন নতুন সংবাদ, নতুন চলন-বলন, নতুন মেজাজ ও মর্জি। ঋকবেদ-সংহিতা কর্মকাণ্ডের আধার। কিন্তু ঋকবেদের শেষের দিকে দেখা গেল বৈদিক ঋষিদের কেউ কেউ কর্মকাণ্ডের ব্যবহারিক প্রয়োজনের দমবদ্ধ গতানুগতিকতা যান্ত্রিকতা এবং একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। বুদ্ধিবৃত্তি তথা জ্ঞানের চর্চা করতে চাইছে এবং তাদের মধ্যে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, মননে জন্ম নিচ্ছে নানান প্রশ্ন। জন্ম নিচ্ছে দর্শন-অভিমুখিনতা। যেমন ১২১ সূক্তটি। এটি সেই বিখ্যাত ‘কস্মৈ দেবায়’। সেখানে ১০ টি মন্ত্রের ৯টির শেষেই প্রশ্ন তোলা হল কোন দেবতাকে হবি দিয়ে পুজো করা হবে। ১০ নম্বর ঋকে জানিয়ে দেওয়া হল প্রজাপতির ছাড়া আর কেউ সব উৎপন্ন বস্তুকে আয়ত্ব করতে পারেনি।তবে ঋকবেদে দার্শনিক-চিন্তার হদিশ পেতে গেলে অবশ্যই বলতে হয় দশম মণ্ডলের ১২৯-সংখ্যক সূক্তের কথা। যেখানে চিন্তার খুব গভীরে গিয়ে প্রাচীন ঋষি চেষ্টা করেছেন সৃষ্টি-রহস্যকে জানতে। প্রশ্ন করেছেন- ‘ইয়ং বিসৃষ্টিঃ কুত আবভূব’ অর্থাৎ এই সৃষ্টি কোথা থেকে এল! এখানে সৃষ্টি-রহস্যের মীমাংসা করতে গিয়ে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে তার কিছুটা এই রকম – নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোম পরো যৎ। / কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম।। শ্রদ্ধেয় রমেশচন্দ্র দত্তের অনুসরণে বাংলা করলে তার মানে দাঁড়ায় –“সেকালে যা আছে তাও ছিল না, যা নেই তাও ছিল না। পৃথিবী ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কী ছিল? কোথায় কার জায়গা ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল? তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না। কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারী আত্মছাড়াই কেবল আত্মাকে অবলম্বন করে নিস্বাসপ্রশ্বাসযুক্ত হয়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। রাত ও দিনের ফারাক ছিল না। প্রথমে অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার ঢাকা ছিল। সবকিছু চিহ্নবর্জিত তার চারদিকে জলের তলায় ছিল। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সেই সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিল। তপস্যার প্রভাবে সেই এক বস্তু জন্মিলেন, ইত্যাদি।”তবে এই স্তোত্রের শেষ মন্ত্রটিকে চরম হেঁয়ালিপূর্ণ করে সৃষ্টি-জিজ্ঞাসা কিন্তু জিইয়ে রাখা হল। - ‘এই যে নানান সৃষ্টি তা কোথা থেকে হল, কার থেকে হল, কে সৃষ্টি করল, কী করল না, সেসব তিনিই জানেন যিনি তার প্রভুর মতো পরমধামে আছেন। অথবা তিনিও না-জানতেও পারেন’। পণ্ডিতমহলে সূক্তটিকে নাসদীয় সূক্ত বলা হয়। লক্ষ করার বিষয় এই সূক্তগুলিতে যেমন মানবমনের জিজ্ঞাসা জায়গা পেয়েছে তেমনি জেগে উঠছে বুদ্ধিশক্তি এবং ইচ্ছাশক্তি। মূর্ত থেকে বিমূর্তে উত্তীর্ন হবার কথা আছে। এই সূক্তগুলি রচিত হয়েছিল শেষের দিকে। সুতরাং তাদের পিছনে অনার্য-ভাবনার প্রভাব ছিল এই দাবি কোনো কষ্ট-কল্পনা নয়। আরো যেটা উল্লেখযোগ্য এই সময়ের বেশ কিছু স্তোত্রে এতদিন ধরে চলে আসা যজ্ঞকেন্দ্রিকতা দেবকেন্দ্রিকতা এবং ভোগসর্বস্বতাকে অতিক্রম করে আরো অনেক বিসদৃশ অসংগত এবং বিচিত্র ভাবনার সমাবেশ ঘটানো হল। ভাষাও হল ভিন্নপথগামী। সব মিলিয়ে বোঝা যায় আর্য-অনার্য ব্যাপক সংমিশ্রণের ফলে এই পর্বে একটা বুদ্ধি-বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। যা চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল অনেক পরে রচিত উপনিষদের মন্ত্রগুলিতে।

Friday, June 17, 2016



কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (৫) 
মুরারি সিংহ


মাননীয় পাঠক, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মতে বেদবাক্য নাকি খণ্ডণ করা যায় না। অথচ আর্যদের এই আদি রচনা কোনো অচল-অনড় কিছু আপ্তবাক্যের সংকলন নয়, বরং কাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য কালোপযোগী করে তোলার তাগিদ তারও যে ছিল, একথাটা বেদের দশম মণ্ডলের সূক্তগুলির উপর চোখ বোলালে পদে পদে বোঝা যায়। সামাজিক বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারায় ঋকবেদের বিষয়-আশয় কী আশ্চর্যজনক ভাবে বদলে গেছে, দেবস্তুতি থেকে সরে এসে কীভাবে সেখানে প্রণয় ও কামাসক্তি জায়গা করে নিয়েছে সে প্রসঙ্গে অগস্ত্য-লোপামুদ্রার আলাপের কথা আগেই বলেছি এবার আরো দুটি সংলাপ-ধর্মী সূক্তর কথা বিশেষ করে বলা দরকার। দশম মণ্ডলের দশম সূক্তটির কথাই ধরুন। যম এবং যমী জমজ ভাইবোন। এখানে তাদের একটি কথোপকথন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আর কী আশ্চর্য সেখানে যমী কামের চোটে নিজের সহোদরকেই শয্যা-সঙ্গী হবার জন্য পীড়াপিড়ি শুরু করেছে। সহবাস করে যমের সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে যমীর সেকী কাকুতি-মিনতি। কিন্তু যম কিছুতেই রাজি হচ্ছে না আদরের বোনকে বোঝাচ্ছে ছিঃ এমন কাজ করতে নেই করলে পাপ হয়। বুঝুন কাণ্ড, এ হেন সংলাপও আর্যদের পবিত্র গ্রন্থে জায়গা করে নিয়েছে এবং যমের সঙ্গে যমীকেও সেখানে দেবতা বানানো হয়েছে। এই প্রসঙ্গে দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্তটির কথাও বলতে হয়। সেটি আবার একটি প্রণয়-কাহিনির অংশবিশেষ। গল্পটা আমরা সবাই জানি স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশীর সঙ্গে মর্ত্যের রাজা পুরুরবার সেই বিখ্যাত প্রেম। ঋকবেদের এই সূক্তই সেই গল্পের উৎস। এটি একটি নিখাদ প্রেম কাহিনি। মর্ত্যবাস সাঙ্গ করে ঊর্বশী স্বর্গে ফিরে যাচ্ছে, পুরুরবা কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। অর্থাৎ নাটকের শেষ দৃশ্য তার যাবতীয় দুঃখ-বেদনা নিয়ে হাজির। যজ্ঞকর্মে এমন প্রেম কী কাজে লেগেছিল জানি না, তবে দেখা যাচ্ছে এখানে ঊর্বশী অর্থাৎ স্বর্গের একজন নর্তকী ও যৌনকর্মী এবং পুরুরবা যে কিনা মর্ত্যের মানব তাদের দুজনকেও দেবতা বানানো হয়েছে। এবার একটু রসের কথায় আসা যাক। বেদে একটাই রস। সোমরস যা এক রকম সুরা। বৈদিক যুগে আর্য-ঋষিদের মদ্যপান প্রীতি আমাদের অজানা নয়। তো ঋষি-মশাইরা উপাসনায় বসে (তখন তো পুজো ছিল না) সেই মদকেও দেবতা বানিয়ে দিল। নবম মণ্ডলের ১১৪টি সূক্ত সবগুলিই পবমান সোম দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এটাও একটা আপডেট বৈকি। আবার যে সব পাথর দিয়ে সোম লতাকে থেঁতো করে মদ বার করা হত তাদেরকেও দেবতা বানানো হয়েছে দশম মণ্ডলের ১৭৫ সূক্তে। এমন কি তার্ক্ষ্য নামের যে পাখি দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সোম বয়ে নিয়ে যেত সেই পাখিই বা বাদ যায় কেন অতএব তাকেও দেবতা বানিয়ে দাও (১০.১৭৮)। একই ভাবে দেব-উপাসনা থেকে নানা স্তোত্রের বিষয়বস্তুর ভিতর জায়গা করে নিয়েছে ভেষজ-চিকিৎসা, ইন্দ্রজাল বা জাদু, বিবাহসংগীত, অন্তেষ্টিবিষয়ক-মন্ত্র, পাশাখেলা, অরণ্যানী, এমনকি ক্রোধ, অলক্ষ্মীনাশ, প্রেতাত্মা, গর্ভরক্ষা, যক্ষ্মারোগনাশ, পাপনাশ, ভয়নাশ, দুর্গতিনাশ, দুর্মতিদূর, দুঃস্বপ্ননাশ, বিষ-নাশ, গর্ভনাশ, কুষ্ঠনাশ, ব্যাঙেদের উল্লাস, ইত্যাদি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ঋকবেদের শেষের দিকে বেশ কিছু মন্ত্রের বিষয়বস্তুর প্রকৃতির মধ্যে একটা মৌলিক পরিবর্তন এসে গেছে। মন্ত্রগুলি হয়ে উঠেছে পার্থি্‌ব, মানবিক এবং জীবনমুখী। সব চেয়ে মজার হল দশম মণ্ডলেরই ৩৪ সূক্তটি যার বিষয় পাশাখেলা এবং সেখানে অক্ষকে দেবতা বানানো হলেও সব কটি ঋকেই পাশাখেলার প্রতি আসক্তি মানুষের কী সর্বনাশ করে তারই ফিরিস্তি, অর্থাৎ পশাখেলার নিন্দা করা হয়েছে। দেব-স্তুতির বদলে দেব-নিন্দা ঋকবেদ-সংহিতার এই আপডেট সত্যিই অবাক করার মতো ঘটনা। বোঝা যাচ্ছে এই পর্বে বৈদিক-সমাজও কতটা বদলেছে এবং তার মূলে অবশ্যই আর্য-সভ্যাতার অনার্যায়ন।

Wednesday, June 8, 2016



কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (৪)

শুধু পুরুষ-সূক্ত বা দেবী-সূক্তের পরস্পর-বিরোধিতা নয় বৈদিক যুগে কবিতার আপডেট প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা দরকার ঋকবেদের বেশ কিছু সূক্তে আরো অনেক ভিন্ন সুর বেজে উঠেছে। তাদের মধ্যে আবার যে গুটি কতক স্তোত্র মেয়েদের লেখা। যেমন প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সূক্তটি। এটি অগস্ত্য ও তাঁর পত্নি লোপামুদ্রার কথোপকথন। সুতরাং তারাই সূক্তটির ঋষি। আশ্চর্যভাবে সেখানে প্রথাগত কোনো দেবতার উপস্থিতি নেই। কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে স্তোত্রটি নিবেদিত হল না। তবে যেহেতু আলাপচারিতার বিষয়-বস্তু নারী-পুরুষের রতি বা সম্ভোগ, তাই পণ্ডিতরা রতিকেই সেখানে দেবতা বানিয়ে দিলেন। প্রথমেই লোপামুদ্রা বলছে বছরের পর বছর রাতদিন অগস্ত্যর সেবা করে সে ক্লান্ত। বয়সের কারণে তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লোপামুদ্রার যুক্তিতে দেবতাদের সঙ্গে যে সব ঋষি সত্যকথা আলোচনা করেন তারাও তো সমানে প্রণয়সুখ সম্ভোগ করেছেন। থই পাননি। সুতরাং সেই সম্ভোগকামী নারীর প্রার্থনা তাহলে পুরুষ স্ত্রীর কাছে যাক। উত্তরে অগস্ত্য বলছে আমরা সমস্ত ভোগই উপভোগ করতেই পারি, যদিও আমি আপাতত জপ ও সংযম নিয়ে আছি তবু আমার মধ্যেও প্রণয় জেগে উঠছে। এখন লোপামুদ্রা তার পতিকে উপভোগ করতেই পারে। অর্থাৎ এই প্রথম দেব-দেবীকে পাশ কাটিয়ে ঋকবেদে মানব-মানবীর প্রেম মানে একেবারে রতির কথা বলা হল। পঞ্চম মণ্ডলের ২৯ সূক্তটিও এক নারীর লেখা। নাম বিশ্ববারা। তিনি অত্রি গোত্রের কন্যা। একজন মহিলা হয়ে পুরুষদের পাশাপাশি তিনিও অগ্নি-দেবতার উদ্দেশ্যে স্তব উচ্চারণ করছেন অর্থাৎ পুরোহিতের কাজ করছেন। নারী-সুলভ ভঙ্গিতেই এই শ্লোকের একটি মন্ত্রে সুশৃঙ্খল দাম্পত্য জীবন কামনা করা হয়েছে। এবার আসা যাক অষ্টম মণ্ডলের ৯১ সূক্তটিতে। এখানে দেবতা সেই বহু-চর্চিত ইন্দ্র হলেও তার রচয়িতা আরেক নারী অপালা। তিনি অত্রি-কন্যা। তার শরীরে চর্মরোগ হয়েছিল এবং স্বামী তাকে ত্যাগ করেছিল। তার ঠাঁই হয়েছিল বাবার ঘরে। তার সেই জন্মদাতার মাথা ছিল কেশশূন্য। এই স্তবে তাই দেখা যাচ্ছে অপালার পক্ষ থেকে যেমন পতি-পরিত্যক্ত নারীদের হয়ে ইন্দ্রের-সঙ্গ কামনা করা হয়েছে, তেমনি নষ্ট-ত্বক উজ্জ্বল করার কথা বলা হয়েছে। আবার টাক মাথায় চুল-গজানোর কামনাও করা হয়েছে। দশম মণ্ডলের ৩৯ এবং ৪০ সূক্ত দুটি আরেক নারীর লেখা, তিনি ঘোষা, কক্ষীবান ঋষির কন্যা, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত।দুটি স্তোত্ররই দেবতা অশ্বিদ্বয়। ঋকবেদের দেবতা এই বিখ্যাত অশ্বজোড়া সব সময় একটি সুন্দর রথকে বয়ে নিয়ে যায়, তারা দুজনেই দক্ষ চিকিৎসক, বৃদ্ধকে নবযৌবন দান করে, দুর্গতকে উদ্ধার করে, ঘটকালি করে মেয়েদের বিয়ে দেয়, গাভিলে দুগ্ধবতী করে, সুতরাং ঘোষা তাদের বন্ধুত্ব কামনা করে দাম্পত্য সুখ কেমন তা বুঝিয়ে দিতে বলছে। এই সূক্তেই নারীদের দেওরকে বিয়ে করার এবং নারীর ব্যাভিচারের কথারও উল্লেখ আছে। দশম মণ্ডলেরই ১৪৫ সূক্তটি আবার বেশ মজার। দেবতার নাম সপত্নীপীড়ন। রচয়িতা ইন্দ্রানী নামের এক মহিলা। সপত্নীপীড়ন দেবতার মানে যে দেবতার উপাসনা করলে সতীনকে বশে আনা যায়। আসলে সেটি এমন একটি শক্তিশালী লতা বা ওষধি যা প্রয়োগ করে একদিকে তীব্র যন্ত্রণা দেবার মধ্যে দিয়ে সতীনকে জব্দ করা যায় অন্যদিকে স্বামীকেও নিজের বশীভূত করা যায়। সেই লতাকেও এখানে দেবতা বানিয়ে দেওয়া হল। এই স্তোত্রতে থেকে যেমন বোঝা গেল সেকালেও বহু-বিবাহ প্রথা ছিল এবং সেই সব নারীদের মধ্যে বিশেষ সদ্ভাব ছিল না তেমনি নারী মনের আরেকটি প্রবণতা অর্থাৎ ওষধি দিয়ে অন্যান্য স্ত্রীদের নীচেরও নীচে নামিয়ে নিজেকে স্বামীর প্রিয়পাত্রী করে তোলার বাসনা ফুটে উঠেছে। নারী-রচিত স্তোত্রগুলি দিয়ে তাহলে ঋকবেদে প্রান্তিক-চেতনাই উঠে এসেছে।প্রকাশ পেয়েছে নারীমনের কথা। অর্থাৎ আর্য-সমাজে পুরুষ একাধিপত্যের ভিত আলগা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটাও তো সামজিক ভাবনার আপডেট

Friday, June 3, 2016



কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (৩) 
মুরারি সিংহ


কবিতার আপডেট প্রসঙ্গে বেদের কথা বলতে গেলে প্রথমে সংক্ষেপে সেই সময়ের কিছু সংবাদ পরিবেশন করা যেতে পারে। বেদের সূক্তগুলি রচিত হয়েছিল কয়েক শতাব্দী জুড়ে সংকলিত হয়েছিল আরো কয়েক শতক পরে। এই সুদীর্ঘ সময় সেগুলি সংরক্ষিত হয়েছিল বংশ ও শিষ্য-পরম্পরায় মুখে মুখে। খুব স্বাভাবিক কারণেই স্তোস্ত্রগুলির অনেক কিছুতেই পরিবর্তন পরিবর্জন সংযোজন ঘটানো হয়েছিল। আবার এই সময়কালে আর্য-সমাজও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল না।সমাজ পরিবর্তনের নিয়মেই তার শরীরেও প্রচুর ভাঙা-গড়া চলেছিল। আর্যরা ছিল বহিরাগত আধা-সভ্য পশুপালক সম্প্রদায় সুদূর মধ্য এশিয়া থেকে গরু-ভেড়া চরাতে চরাতে নতুন চারণভূমির খোঁজে ইউরাল-পর্বত পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল ভারতীয় উপমাদেশে। এদেশে দখল বিস্তারে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ভূমিপুত্ররা যাদের নাম দেওয়া হয়েছিল অনার্য। কিন্তু সুসভ্য ও উন্নত নাগরিক সভ্যতার অধিকারী সেই ভূমিপুত্রদের ধন-সম্পদ এবং উন্নতি দেখে আর্যদের চোখ কপালে উঠেছিল সম্পদলোভী এবং যুদ্ধবাজ আর্য-সম্প্রদায়গুলি তখন তাদের ঘোড়া ঘোড়ায়-তানা এবং লৌহার তৈরি অস্ত্র দিয়ে অবাধে একের পর এক নগরকে ধ্বংস করেছিল তাদের অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে ধন-সম্পদ লুঠ করেছিল। আরেকটি জিনিসের উপর আর্যদের নজর পড়েছিল। তা হল এদেশের নারী। আর্য-গোষ্ঠীগুলি ছিল পুরুষ-শাসিত এবং পুরুষ-প্রধান।পথশ্রমের কষ্ট-জনিত কারণে গোষ্ঠীগুলিতে নারীর সংখ্যা কম রাখা হত। তাই অনার্যদের সঙ্গে সংঘাতে তাদের পুরুষদের হত্যা বা বন্দি করে দাস বানালেও আর্যযোদ্ধারা সুন্দরী পুরবাসিনীদের জায়গা দিয়েছিল নিজেদের অন্দরমহলে। এবং সেখানেই এক ভবিষ্যত সমাজ-বিপ্লবের বীজ রোপিত হয়েছিল। আর্য-অনার্য সংকরায়নে যে নতুন প্রজন্মগুলি আসতে শুরু করল সন্তানদের উপর মাতৃপ্রভাবে বৈদিক সমাজে প্রচুর অনার্য উপকরণ হু হু করে ঢুকে পড়ল। পরবর্তী সময়ে রচিত বেদের ঋকগুলিতে তার বিস্তর নমুনা সহজেই খুঁজে নেওয়া যায়।ঋকবেদ-সংহিতায় মোট সূক্তের সংখ্যা ১০১৭, ঋক ১০৪৭২, তাদের সংকলিত করা হয়েছে দশটি মণ্ডলে। মাননীয় পাঠক, তাদের মধ্যে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি দশম মণ্ডলের এমন কিছু সূক্তের দিকে যাদের সুর একেবারেই আলাদা এবং যেগুলি দ্বারা প্রমাণিত হয় অন্তিম মণ্ডলে এসে ঋকবেদ-সংহিতা কীভাবে আপডেটেড হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে অবশই বলতে হয় ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ৯০ সূক্তের কথা। এটি পণ্ডিত মহলে পুরুষ-সূক্ত নামে পরিচিত।এতদিনের সাকার দেব-দেবী উপাসনা থেকে সরে এসে সেখানে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এমন এক পুরুষের কল্পনা করা হল যার শরীরকে আর পৃথিবীর গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা গেল না। সহস্র মাথা, সহস্র চোখ, সহস্র পা লাগিয়ে পৃথিবী ছাপিয়ে তার শরীরকে আরো দশ আঙুল বাড়িয়ে দেওয়া হল।কল্পনা করা হল তারই দেহের অংশ থেকে বিভিন্ন প্রাণির জন্ম হয়েছে। জানিয়ে দেওয়া হল –সেই পুরুষের মুখ হল ব্রাহ্মণ, দু-হাত হল ক্ষত্রিয়, ঊরু হল বৈশ্য এবং দু-পা হল শূদ্র। এমনকি আকাশ-বাতাস-চন্দ্র-সূর্য-অগ্নি-স্বর্গ-মাটি-দিক-ভুবন সবকিছুই সৃষ্ট হল সেই পুরুষের থেকে। এই একটি শ্লোক থেকে অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানা গেল, প্রথমত বহু-দেবতার ভাবনায় ভাঙন। দ্বিতীয়ত, সমাজে জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব যেখানে পরাজিত ও বন্দি অনার্যদের শূদ্র নামে অভিহিত করে আর্য-সমাজের নীচের তলায় জায়গা দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত সব কিছুর সৃস্টি এক পুরুষের থেকে অর্থাৎ সমাজে পুরুষরাই প্রধান। মজার কথা তার পাল্টা হিসেবে এর পরেই এল ১২৫ সূক্তটি, যার প্রচলিত নাম দেবীসূক্ত, দেখা গেল সেখানে বাক নামের এক নারী পরমাত্মার জবানিতে নিজেকে ভুবন-নির্মাতা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি একবার বললেন আমিই রাজ্যের অধিশ্বরী, পরে বললেন আমিই পিতা। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার লিঙ্গভেদ ঘুচিয়ে দিলেন। বোঝা গেল কালের কারসাজি কত জমে উঠেছে।