Saturday, August 20, 2016

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৫)



ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৫)  

এই বিশ্বায়নের যুগে এসেও একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ এখনো বাংলার সংস্কৃতি জগতের গৃহদেবতা। আধুনিক পর্বের অন্যতম কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘সূর্যাবর্ত' নামের লেখাটিতিতে বলেছিলেন – “রবীন্দ্রনাথ হাল বাংলার সিদ্ধিদাতা গণেশ। তিনি তো আমাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের সূত্রাধার বটেই, এমনকি তাঁর বাণী-ব্যতিরেকে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও লাভ নেই”। কথাগুলি লেখা হয়েছিল আজ থেকে আশি বছর আগে সেই ১৯৩৬ সালে। ইতিমধ্যে বদলে গেছে শতাব্দী বদল হয়েছে সহস্রাব্দেরও। এই সময়কালে বাংলা-কবিতাও এক বিন্দুতে থেমে থাকেনি। তার দেহে ও মনে, মেজাজে ও মর্জিতে ঘটে গেছে হাজারটা ওলট-পালট। নতুন নতুন উচ্চারণের চিহ্ন তার সারা গায়ে জ্বলজ্বল করছে। নিত্য-নতুন পরিবর্তনের ছোঁয়া তাকে কিছুতেই ব্যক-ডেটেড হতে দিচ্ছে না। নতুন নতুন দিশা খুঁজতে খুঁজতে বাংলা-কবিতা এখন প্রকৃত অর্থেই বহুমুখী। একবিংশ শতকের এই দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষাপটে নতুন প্রজন্মের কাছেও কবিগুরু এক আশ্চর্য প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই ভুবন-গ্রামে ক্রমশই বেড়ে চলা মৌলবাদ আতঙ্কবাদ ভোগবাদ পণ্যসংস্কৃতি এই সব কিছুর সাপেক্ষেই প্রয়োজন হয়ে পড়ছে রবীন্দ্র-সৃষ্টির দিকে বার বার ফিরে তাকানোর। তিনি তো শুধু কবি নন, তিনি যে আমাদের ফ্রেন্ড-ফিলোজফার এন্ড গাইড। যে কোনো সুখে দুখে বিপদে বিপর্যয়ে নিজেদের মুখ দেখার জন্য তিনি আমাদের আত্মার দর্পন। আর তাঁকে নিয়ে ব্যাবসা-বাণিজ্য তাও তো ক্রমবর্ধমান। কপিরাইট মুক্ত হবার পর তাঁর রচনাবলি হয়েছে সুলভ ও সহজলভ্য বিভিন্ন প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের সৌজন্যে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান কবিতা নাটক গল্প এখন আরো বেশি করে পৌঁছে যাচ্ছে আমবাঙালির ঘরে ঘরে এসবই রবীন্দ্র-অনুরাগীদের কাছে খুবই সুখবর তবে এই ইতিবাচক আবহের মধ্যে দুর্ভাগ্যের কথা একটাই নতুন পরিসরে রবি ঠাকুরের উপর নতুন আলাপ-আলোচনা সেভাবে দানা বাঁধছে না যা হচ্ছে তার বেশিরভাগটাই সেই গতানুগতিক বিদ্যায়তনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকতার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ এই অচলায়তন ভাঙার জন্য তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবেআমরা জানি বাংলা কবিতায় আধুনিক-পর্বের শুরুটা হয়েছিল কট্টর রবীন্দ্র-বিরোধিতা দিয়ে্ অবশ্য তা করা ছাড়া সেই পর্বের কবিদের অন্য উপায়ও ছিল না কারণ নতুন প্রজন্মের কবিদের আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে রবীন্দ্র ভাবচেতনা তখন এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে অনুসরণ করতে গেলে সমূহ বিপর্যয় তার বিরুদ্ধে যেতে হলে যথেষ্ট সাহস দরকার তরুণ তুর্কিরা দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিলেন আর বিকল্পের খোঁজে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য যুবারা চোখ  রাখলেন পশ্চিমের দিকে সাগরের ওপারে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা হল অম্ল-মধুর। এক দিকে বিবাদ অন্য দিকে বন্ধুত্ব। তবে কল্লোলের কাল শেষ হলে ঝগড়াটা আর রইল না। ১৯২৮ সালেই প্রকাশিত হয়ে গেছে শেষের কবিতা। সব বিদ্রোহের সেখানেই ইতি। তরুণের দল নতুন করে মেতে উঠলেন রবীন্দ্র-বরণে। তাই বলে বুদ্ধদেব বসু-সুধীনদত্ত-জীবনানন্দ-বিষ্ণুদে-অমিয়চক্রবর্তীরা তাঁদের পথ থেকে সরে এলেন না। শুরু হল রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক কবিতার যুগ। সেটা কবির জীবনের শেষ দশক। তখনো কবি নতুনের সন্ধানে অক্লান্ত। আবার বুদ্ধদেব বসু সেই সময়ের নতুন কবিদের কবিতা-সংকলন ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রথমেই রাখলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ১৯৫৩ সালে লেখা ভূমিকাটিতে কৈফিয়ৎ হিসেবে তিনি জানালেন- “কোনো পাঠক হয়ত মনে-মনে বলছেন – রবীন্দ্রনাথের পরে প্রথম নতুন তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই, সেকথাও সত্য তাই এই সংকলন আরম্ভ হয়েছে ‘লিপিকা’র রচনা দিয়ে, যে-বইতে, ‘মানসী’ থেকে ‘বলাকা’ পর্যন্ত এক জন্ম শেষ করে, রবীন্দ্রনাথ নতুন করে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর শেষ পর্যায়ের রচনার ধারা আমাদের সাম্প্রতিক কাব্যে নানাভাবে ফলপ্রসু হয়েছে, পরবর্তীর প্রতিবেশিতার জন্য সেই সসম্বন্ধটি চিনতে পারা হয়তো সহজ হবে।” বুদ্ধদেব বসুর কথার সূত্র টেনে এখনো বলা যায় মডার্নিজিমের পরে যে পোস্ট-মডার্নিজিমের শুরু সেখানেও প্রথম নতুন সেই রবীন্দ্রনাথ।

Monday, August 8, 2016

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৪)

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৪) 




ঔপনিবেশিক সময়ে গোরা-সাহেবদের হাত ধরে সাগরপার থেকে যে আধুনিকতাকে এই বঙ্গভূমিতে আমদানি করা হয়েছিল আমরা জানি জীবনের শেষপর্বে এসে রবীন্দ্রনাথকেও তার সঙ্গে বেশ কিছুকাল ঘরবাস করতে হয়েছিল। কবির কাছে সে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল তা নিয়ে আমাদের বিস্তর কৌতূহল। এনিয়ে চর্চা ও গবেষণাও কিছু কম হয়নি। কবির প্রয়াণের পঁচাত্তর বছর পরে এই নতুন শতকের নতুন সময়ে দাঁড়িয়ে আসুন পাঠক উত্তর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে আমাদের মতো করে কিছুটা আলাপ সেরে নিই। প্রথমে দেখে নেওয়া যাক রবীন্দ্র-মননে ইউরোপীয় আধুনিকতা কতটা ঢেউ তুলতে পেরেছিল বা কবি তাকে কতটা ছুঁতে পেরেছিলেন। আধুনিকতার কথা বলতে গেলে মহাযুদ্ধের কথা বলতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ব-মানবের কাছে কোনো সুখ সমৃদ্ধি বা সংহতির বার্তা নিয়ে আসেনি। মানব-সভ্যতার হাতে প্রগতির কোনো নতুন দিশাও তুলে দিতে পারেনি। বরং আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের মনে লালিত এতকালের সনাতন ন্যায়-নীতি ও মুল্যবোধকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছিল। সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছিল এক ব্যাপক ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ। তাও কল্পনাতীত ভাবে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত ও সভ্যসমাজের লোকজনের হাতে। মানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার এই বর্বর লোভকে কখনো মেনে নিতে পারেননি। নানা সময়ে নানা লেখায় তিনি তার মনের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন। এই বিপুল ধ্বংসের পটভূমিকায় লেখা হয়েছিল ওয়েস্টল্যান্ড যা দিয়ে ইউরোপীয় কবিতার নতুন পথচলা শুরু। ১৯২২ এ তাঁর সেই মাস্টারপিসে এলিয়ট সাহেব লিখেছিলেন - A heap of broken images আর তার দশ বছর পরে ১৯৩২এ প্রকাশিত বীথিকা-র দুর্ভাগিনী কবিতায় কবিগুরু লিখলেন - ভাঙা বিশ্বে পড়ে আছে ভেঙে-পড়া বিপুল বিশ্বাস। ইউরোপীয় আধুনিকতা এই ভাঙা-বিশ্বের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নতুন বিশ্ববীক্ষার আলোয় সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে এই বঙ্গভূমিতেও আস্তিক্য-বুদ্ধি, সত্যনিষ্ঠা, সৌন্দর্যবোধ, আনন্দ-মঙ্গল-কল্যাণ-প্রেম এইসব মিলিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের ভাবনালোক বিশ শতকের নতুন প্রজন্মের মনঃপুত হল না। রবি-কিরণের প্রকোপে হাঁসফাঁস করা অস্তিত্বের সংকটে-ভোগা কবি-যশঃপ্রার্থী তরুণ-তুর্কিরা খুঁজল অন্যপথ। ইংরেজি শিক্ষার সুবাদে ততদিনে তাঁদের জানা হয়ে গেছে ইউরোপীয় সাহিত্য এবং ফ্রয়েড ও মার্ক্সের দর্শন। তখন আদিগন্ত ছায়া-বিস্তারকারী রবীন্দ্রচেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনে হচ্ছে সর্বত্যাগী বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হবার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, অনাচারী ব্যাভিচারী লম্পট হবার মধ্যেও কিছু কম আনন্দ নেই। নিজেদের রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য সেই ভাবনা থেকেই কল্লোল-পত্রিকার সূত্রপাত। তাকে কেন্দ্র করে নতুন সাহিত্য-আন্দোলন। সেই আন্দোলনকারীদের কাছে মানুষের মানে দাঁড়াল রক্ত মাংস হাড় মেদ মজ্জা ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ কাম হিংসা সমেত গোটা মানুষ। সেটা অবশ্য জগদীশ গুপ্ত, মণীশ ঘটক(যুবনাশ্ব), বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এঁদের গল্প-উপন্যাস যতটা বেশি প্রকট হয়েছিল কবিতায় ততটা নয়। তবে নজরুল ইসলাম অচিন্ত্য সেনগুপ্ত বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনানন্দ দাশ এঁদের কবিতায় একটা দ্রোহ একটা ভিন্ন উচ্চারণের বীজ অবশ্যই বোনা হয়ে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক পর্বের ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ ও রবীন্দ্রকবিতার মার্জিত শুচিতায় গীতগোবিন্দ লালিত ও বিদ্যাসুন্দর পালিত যে শৃঙ্গার রস ও যৌনতার প্রকাশ কিছুকাল ঢাকা পড়েছিল। নতুন সময়ে পশ্চিমি হাওয়ার নতুন মেজাজ গায়ে মাখিয়ে কল্লোলের গল্প-উপন্যাস-কবিতা বাঙালির সেই স্মৃতিকে আবার উসকে দিল। সুতরাং শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। সেই সংঘাতে ইন্ধন জোগালেন শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। ২৩ ফাল্গুন ১৩৩৩ সালের একটি চিঠিতে তিনি কল্লোল-গোষ্ঠির লেখালিখি নিয়ে কবিগুরুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ১৩৩৪ সালের শ্রাবণ সংখ্যা বিচিত্রায় প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের ধর্ম’। তারপরের বিতর্ক তো ইতিহাস।