Friday, September 16, 2016

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৮) ০ মুরারি সিংহ



ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৮)  ০ মুরারি সিংহ

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবীকালের মধ্যে এখনো ভীষণ ভাবে বেঁচে আছেন। তাঁর সেই গণগণে বেঁচে থাকার আঁচ প্রতিদিন টের পাওয়া যায় আমাদের রোজকার নানান কাজকর্মের ফাঁক-ফোঁকরে – আমাদের আনন্দের, শোকের, ক্লান্তির, হতাশার নানান ঘনিষ্ট মুহূর্তে। ভাবীকালের সঙ্গে কবিগুরুর এই-যে নিকট-সম্পর্ক তা কেন এবং কীভাবে তৈরি হয়েছিল তা জানতে গেলে সমসময়ের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধের রসায়নটাও একটু বোঝা দরকার। ইউরোপীয় মডার্নিজিমকে রবীন্দ্রনাথ খুব কাছ থেকে দেখেছেন তার ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করেছেন কিন্তু কখনোই তাকে অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নিয়ে সেই হুজুগে গা ভাসিয়ে দেননি। এটা কি তাঁর নিজের কালের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে প্রাচীন হবার লক্ষণ? সেই যে নতুন সময়। যখন জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সংশয় সন্দেহ জিজ্ঞাসা যুক্ত-তর্ক বিক্ষোভ বিদ্রোহ আত্মবিরোধ অনিকেত মনোভাব চারপাশে কেমন যেন একটা অসুস্থ আবহাওয়া। নতুনের নামে তাকেও কি মেনে নিতে হবে! এনিয়ে তিনি নিজেও বিস্তর টানাপোড়েনে ছিলেন। কারণ মানুষের বার্ধক্য সম্পর্কে তিনি ভালোমতো ওয়াকিবহাল ছিলেন। “পঞ্চাশের পরে বানপ্রস্থের প্রস্তাব মনু করেছেনতার কারণ মনুর হিসাবমত পঞ্চাশের পরে মানুষ বর্তমানের থেকে পিছিয়ে পড়েতখন কোমর বেঁধে ধাবমান কালের সঙ্গে সমান ঝোঁকে পা ফেলে চলার বেগে যতটা ক্লান্তি ততটা সফলতা থাকে না, যতটা ক্ষয় ততটা পূরণ হয় নাঅতএব তখন থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে থাকে সেই সর্বকালের মোহানার দিকে যাত্রা করতে হবে যেখানে কাল স্তব্ধগতির সাধনা শেষ করে তখন স্থিতির সাধনা” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো বরাবর গতিরই সাধক। তাই বিদেশি লুঠেরাদের নেতিবাদী আধুনিকতা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব দেখালেও সেই সময়ের যে তরুণরা সেই আধুনিকতাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল তাদের কিন্তু তিনি অশ্রদ্ধা করেননি। অনাদর করেননি। কবি বললেন  – “আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখেছি যাঁরা আধুনিক ইংরেজি কাব্য কেবল যে বোঝেন তা নয়, সম্ভোগও করেন তাঁরা আমার চেয়ে আধুনিক কালের অধিকতর নিকটবর্তী বলেই য়ুরোপের আধুনিক সাহিত্য হয়তো তাঁদের কাছে দূরবর্তী নয় সেইজন্য তাঁদের সাক্ষ্যকে আমি মূল্যবান বলেই শ্রদ্ধা করি” অবশ্য সেই সঙ্গে কবি তার সংশয়কেও গোপন রাখলেন না। “কেবল একটা সংশয় মন থেকে যায় না। নূতন যখন পূর্ববর্তী পুরাতনকে উদ্ধতভাবে উপেক্ষা ও প্রতিবাদ করে তখন দুঃসাহসিক তরুণের মন তাকে যে বাহবা দেয় সকল সময়ে তার মধ্যে নিত্যসত্যের প্রামাণিকতা মেলে না। নূতনের বিদ্রোহ অনেক সময় একটা স্পর্ধামাত্র” চিরনতুনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বরাবরের পক্ষপাত আমাদের অজানা নয়অতীত গৌরবের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাও সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই নতুনকে মেনে নিতে না-পারার সপক্ষে নিজের প্রত্যয় ব্যক্ত করে সেদিনের যুবক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যাঁকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘আকাশপ্রদীপ’ উৎসর্গ করতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন- “বয়সে তোমাকে অনেক দূরে পেরিয়ে এসেছি তবু তোমাদের কালের সঙ্গে আমার যোগ লুপ্তপ্রায় হয়ে এসেছে, এমনতরো অস্বীকৃতির সংশয়বাক্য তোমার কাছ থেকে শুনি নি! তাই, আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো”, সেই আধুনিক কবিকেই একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন–“আমার মতে সেদিন ইংরেজি সাহিত্যে আমার মন যে অবাধ প্রবেশ লাভ করেছিল তার কারন ছিল সেযুগের সাহিত্যের অন্তরে। তার মধ্যে সার্বজনীন আমন্ত্রণ ছিল, আতিথ্য ছিল। যেখানে আতিথ্য নেই সেখানে ঐশ্বর্যের পরিচয় নেই। ভিতরে সেখানে ভৈরবীচক্র বসে, সে কিন্তু যজ্ঞ নয়, সেখানে বাইরের লোককে রুদ্ধদ্বারের বাইরে বসিয়ে রেখে দেয়”। আধুনিকতা বলতে রবীন্দ্রনাথের কাছে সময়ের চেয়ে মর্জিটাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল, আধুনিকতার  কাছে তিনি চেয়েছিলেন ব্যক্তিগত খুশির দৌড় কিন্তু ক্রমশই উপলব্ধি করলেন আধুনিকতার নাম করে কেমন করে নানাজনের যে আলাদা আলাদা বিচিত্র অভিরুচি তাদের একেবারে চাপা দিয়ে একটা মণ্ড তৈরি করে তারপর তাকে ছাঁচে ফেলে নিখুঁত কেতা-দুরস্ত পুতুল তৈরির চেষ্টা চলছে। তাই রবীন্দ্রনাথের আর আধুনিক হওয়া হল না, হয়ে গেলেন অন্যকিছু, এবং এমন কিছু যা তাকে আজকের প্রজন্মের মনেও বাঁচিয়ে রেখেছে।  

Thursday, September 15, 2016

যখন প্রথম ফুটেছে কলি 0 মুরারি সিংহ (৪)

যখন প্রথম ফুটেছে কলি 0 মুরারি সিংহ  (৪)

আজকের কিশোর-কিশোরীদের একদিকে ঘর অন্যদিকে বিশ্বএই দুইয়ের টানাপোড়েনে তাদের সংকটও যথেষ্ট বেড়ে গেছেসেই সব অতিক্রম করেই তাদের তৈরি করতে হচ্ছে জীবনের চলার পথসুতরাং আমাদের বোঝা দরকার, আমরা সন্তানদের জন্ম দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আমাদের সন্তানেরা কখনোই তাদের বাবমায়ের পুনর্মুদ্রণ নয়তারা অবিকল তাদের মতোতারা নতুন সময়ের নতুন ফসলতাদের বাঁচা মানে struggle for existence বা কোনো রকমে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা আর বাপ-ঠাকুর্দার বংশ-রক্ষা করা নয়তাদের গন্তব্য তার চেয়ে অনেক বেশিতাদের বাঁচা মানে মনুষ্যত্বের আরো বেশি উন্মেষআরো বাঁচার বেশি পরিসর নির্মাণজীবনের আরো অনেক দেশ-মহাদেশের আবিষ্কার।         
নানান ভাষণে বা রচনায় যে আপ্তবাক্যটি প্রায়ই ব্যবহার করা হয় থাকে যে আজকে যাদের বয়স অল্প তারাই দেশের ভবিষ্য নাগরিকআজকের শিশুরাই আগামী দিনের পিতাএকটি শিশুর মধ্যে থাকে বিকাশের অনন্ত সম্ভাবনাসুতরাং যথাযথ বেড়ে ওঠার জন্য, নিজেদের ঠিকঠাক গড়ে তোলার জন্য সেই শিশুকিশোরদের যথেষ্ট পরিসরের ব্যবস্থা করতে হবেঅথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সামজিক অনুশাসনে ছোটোদের যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা তাদের নিজেদের ভাবতে দেওয়া নয় বরং একটা নিদির্ষ্ট ফরম্যাটে তাদের জন্য আগে থেকেই ভেবে রাখা বা প্রোগ্রামিং করা বড়োদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাবড়োদের সামগ্রিক প্রচেষ্টার অভিমুখ ছোটোদের নিজের পথে চলতে দেওয়া নয়, বরং বড়োদের পথে তাদের চালানোএতে করে কচিকাঁচাদের না হচ্ছে উপকার, না হচ্ছে স্বপ্রকাশতাদের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে কর্তাভজা মানসিকতা।  
আশার কথা গত কয়েক দশকে এই মান্ধাতা-আমলের মানসিকতাতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছেকারণ এই উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ধ্যান-ধারনার মূলেও ব্যাপক নাড়া পড়েছেসুদূর অতীত থেকে ঔপনিবেশিক সময় পর্যন্ত চলে আসা কেন্দ্রীয় আধিপত্যবাদের কুফলটা মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেফলে সংসার নামের প্রতিষ্ঠানটিও আর আগের মতো নেইকারণ বিগত দিনগুলিতে সংসার ছিল একান্নবর্তী এবং পুরো-দস্তুর অভিভাবক-কেন্দ্রিকসেখানে বাড়ির ছোটদের অধিকার ছিল একেবারেই সংকুচিতবড়োদের কাছে তাদের মতামত বা দাবি-দাওয়ার কোনো মূল্যই ছিল নাকিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর দেশে এই ছবিটাই এখন অন্য রকমেরএখন যেমন সংসারের বহর কমেছে, সংসারের সদস্য বলতে মা-বাবা তাদের একটি-দুটি সন্তান, তেমনি সেখানে মনোযোগের কেন্দ্রটিও চলে গেছে ছোটোদের দখলেসঙ্গে সঙ্গে কচি-কাঁচাদের পছন্দ মতামতের গুরুত্বও অনেক গুণে বেড়ে গেছেবিশ্বব্যাপী যোগাযোগের ব্যবস্থাগুলি যত উন্নত হচ্ছে, বাবা-মায়েরা অনেকেই চাইছেন সন্তানদের সঙ্গে নিজেদের communication gap কমাতেআবার নিজেদের বাব-মা বা সংসারের বয়স্কদের প্রতি তাদের উপেক্ষা অবহেলা বাড়ছেতার থেকেও কচিকাঁচাদের কাছে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছেফলে সংসারে ভারসাম্যের একটা অভাব থেকেই যাচ্ছে।  
আমরা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের এই সংকটগুলি বুঝতে পারব, তাদের সমাধান করতে সচেষ্ট হব, সমাজ সংসারের পক্ষে ততই মঙ্গল।  
তবে আমার কথাতেও এই যে এত উপদেশ বা পরামর্শ এসে যাচ্ছে তা কিন্তু এই আলোচনার একটা দিশা নির্দেশ করার লক্ষ্যেতা কোনো আপ্তবাক্য নয়কারো উপর চাপিয়ে দেবের জন্যও নয়প্রয়োজনীয় মনে হলে তাকে ভেবে দেখবেন, নাহলে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করবেন।     
শেষের কথা বলার আগে, অন্নদাশংকর রায় এই বয়স নিয়ে তাঁর সৃষ্টির দিশানামের এক লেখায় যে মূলাবান মতামতটি পেশ করেছেন প্রাসঙ্গিক মনে করে সেটি এখানে তুলে দিলাম -
‘‘যে মানুষ হয়, সে নিজেই নিজেকে গড়ে, সে সব প্রভাব অতিক্রম করেযাকে মানুষ করা হয়, গড়ে তোলা হয়, স্পষ্ট প্রভাবিত করা হয় সে একটি পোষা বাঘের মতো স্বভাবভ্রষ্ট, সে একটা breeding farm-এর ফসল, তাকে দিয়ে সমাজে শান্তিরক্ষা হয়, কিন্তু সৃষ্টিরক্ষা হয় না, সৃষ্টি যে কেবলি আঘাত খেয়ে কেবলি চেতনালাভ, কেবলি অপ্রত্যাশিতের সাক্ষাত, কেবলি প্রত্যাশিতের গাফিলিযারা বলে ভাবী বংশধরদের আমরা উন্নত করবো তাদের শুভাকাঙ্ক্ষার তারিফ করতে হয়, কিন্তু তাদের সত্যিকারের কর্তব্য নিজেদেরি উন্নত হয়ভাবী বংশধরেরা নিজেদের ভার নিজেরা নিতে পারবে এটুকু শ্রদ্ধা তাদের পরে থাকসত্যকে পথের শেষে পাবার নয় যে বয়সের যারা শেষ অবধি গেছে তারাই পেয়েছেপথের শেষ নেই, বয়সের শেষ নেই, সত্যকে পদে পদে পাবার, দিনে দিনে পাবারশিশুর কাছে শিশুর অভিজ্ঞতাই সত্য, যতদিন না সে বৃদ্ধ হয়েছে ততদিন তার পক্ষে বৃদ্ধের অভিজ্ঞতা হচ্ছে অকালবৃদ্ধতা’’    
উপসংহার পর্বে এসে বলি, শৈশব বলি, কৈশোর বলি, অথবা যৌবন বা বার্ধক্য, সবই আসলে প্রকৃতিকে মেনে, প্রাকৃতিক নিয়মেই আসে যায়কিন্তু মুশকিল হল বিঞ্জান প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রকৃতির থেকেই আমরা দূরে চলে যাচ্ছি এবং প্রকৃতিকে অস্বীকার করে নাগরিক কৃত্রিমতার স্রোতে গা ভাসাতে চাইছিফলে সমাজ সংসার ক্রমবর্ধমান জটিলতার শিকার হচ্ছেআজকের কম-বয়সীদের এসব নিয়ে আরো বেশি করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবেভেবে দেখতে হবে বিঞ্জান, প্রযুক্তি, শিক্ষা সভ্যতার চোখ-ধাঁধানো উন্নতির কথা এত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রচার করা সত্ত্বেও কেন আজো এত দারিদ্র্য, এত গরিবিকিছু মানুষের মধ্যে কেন আজো এত দখলদারির মানসিকতাকেন এত মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ অশান্তি
মনে রাখতে হবে, নয়া-উপনিবেশবাদীদের দ্বারা পোষিত বাজার-সংস্কৃতি কিন্তু নানা অছিলা তথা ভোগবিলাসের অজস্র প্রলোভন দেখিয়ে এসবই ভুলিয়ে গুলিয়ে দিতে চাইছেনতুন নতুন কায়দা-কানুন প্রয়োগ করে এই অদৃশ্য শক্তি চাইছে নতুন প্রজন্মকে বিপথে চালিত করতে, বিভ্রান্ত করতেনিজেদের ভবিষ্য কিছু চিন্তা বা কেরিয়ার গঠনের চেষ্টাকে কোনো রকম অবহেলা না করেও, আজকের ছেলেমেয়েদের এই সমস্ত ব্যাপার ভেবে দেখতে হবে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে গড়ে তুলতে হবে আরো সুন্দর করে। 
তাই নতুন যৌবনের উন্মাদনায় জীবনকে যতই গোলাপি ফুরফুরে মনে হোক, সদ্য যুবক-যুবতিদের সামনে চ্যালেঞ্জ কিন্তু বিস্তর শাহবাগ স্কোয়ার-এর আন্দোলন বা হোক কলরব-এর মিছিল আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে তারা সে চ্যালেঞ্জ নিতে পিছ-পা নয়। 

ঋণ-স্বীকার
রবীন্দ্রগান- কবিতাপাক্ষিক ২০০২।
তরুণের স্বপ্ন তরুণের স্বপ্ন সুভাষচন্দ্র বসুনবম সংস্করণ, ১৩৬২শ্রীগুরু লাইব্রেরি
সৃষ্টির দিশা তারুণ্য অন্নদাশংকর রায়দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৫৫ডি এম লাইব্রেরি।   
Child Psychiatry & You – Michail Buyanov (Eng. Trans. – Michail Burav), 1989, Mir Publishers