Tuesday, May 31, 2016


কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (২) 
মুরারি সিংহ

স্পেনের আলতামিরা গুহা বা তার ছাদে আঁকা বাইসনের কথা আমরা সবাই জানি। বিশেষজ্ঞদের মতে ছবিটি আঁকা হয়েছিল খ্রীস্টপূর্ব ১৬৫০০ থেকে ১৪০০০ অব্দের মাঝামাঝি কোনো সময়ে। আশ্চর্যের বিষয় হল ১৮৮০ সালের দিকে আবিষ্কারটি যখন প্রথম জনগণের সামনে আনা হল তখন তার শিল্পসৌন্দর্যের উৎকর্ষতা দেখে তখন বিংশ শতকের শিক্ষিত মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি যে এই ধরনের বিমূর্ত শিল্পের জন্ম দেবার মতো যথেষ্ট জ্ঞান ও বুদ্ধি প্রাগৈতিহাসিক যুগের সেই গুহাবাসী নিয়নন্ডারথাল মানুষদের ছিল। অনেক গবেষণের পরে পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞরা অবশ্য তার সত্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। পাবলো পিকাসো বললেন আলতামিরার পর আর যা কিছু সবই অতিরিক্ত। কবিতার আপডেট প্রসঙ্গে আলতামিরার কথা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে অনেকে এখনো মনে করেন কবিতা লেখার জন্যও যথেষ্ট পড়াশোনা ও জ্ঞান-বুদ্ধি থাকা দরকার। এই ধারণা যে কতটা হাস্যকর তার উদাহরণ সম্প্রতি সোশাল-মিডিয়ায় হইচই ফেলে দেওয়া কোসলি ভাষার কবি হলধর নাগ, শিক্ষার দিক দিয়ে যিনি তৃতীয় শ্রেণির গণ্ডি না পেরোলেও কবিতা লেখার জন্য সম্প্রতি পদ্মশ্রী-সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। কেবল রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন বলেই নয়, উড়িষ্যার স্থানীয় জনসমাজে তিনি একজন জনপ্রিয় কবি এবং বিদ্যায়তনিক পাঠ্যসূচিতেও তাঁর কবিতা জায়গা করে নিয়েছে এবং সেখানে তাঁর কবিতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু হয়েছে। আমার মনে হয় প্রথাগত শিক্ষা নয় কবিতা লেখার জন্য যা যা দরকার হল তার মধ্যে সবার আগে দরকার একটি সৃষ্টিশীল মন। তার সঙ্গে নিজের চারপাশকে চর্মচক্ষে দেখার পরেও তার বাইরে বেরিয়ে মনশ্চক্ষে দেখার মতো চোখ এবং জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। আর যা দরকার তা হল ভাবকে ভাষায় প্রকাশ করার দক্ষতা যা লাগাতার অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। সমাজের উচ্চকোটির মানুষের বৈঠকখানার মধ্যে কবিতা-চর্চাকে কুক্ষিগত করে রাখার যে চল তা ছাপাখানা আবিষ্কার এবং মেকলে-মডেলে পাশ্চাত্যপ্রথায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হবার ফল। অবশ্য তার আগে রাজসভা সাহিত্য ছিল। তবুও তার বাইরে গ্রাম বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদে আমাদের যে লোকসংস্কৃতির ধারা তার উৎপত্তি ও প্রবাহও তো সেই অক্ষরপরিচয়হীন ও অমার্জিত প্রান্তিক মানুষজনের মুখে মুখেই। চর্যাপদ পদাবলি সাহিত্য মঙ্গলকাব্য সেভাবেই লেখা হয়েছে। এমনকি যে ঋকবেদ সংহিতাকে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম রচনা বলে মনে করা হয় তার স্তোস্ত্রগুলি যখন বিরচিত হয় তখন এদেশে উপনিবেশ বিস্তারকারী আর্যদের লিপিজ্ঞান ছিল না। অর্থাৎ সেই আধা-সভ্য বহিরাগতরা ছিল আক্ষরিক অর্থেই নিরক্ষর। স্তোত্রগুলি মুখে মুখে রচিত হত, মনে রাখা হত এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত হত। যে কারণে বেদের আরেক নাম শ্রুতি। আবার এই শুনে শুনে মুখস্ত করতে হত বলে রচনাগুলিকে ছন্দোবদ্ধ করতে হয়েছিল। ঋকবেদ সংহিতায় যদিও কবিতার উপাদান খুব কম। স্তোত্রগুলির ছত্রে ছত্রে শুধু তৎকালীন দখলদারদের কামনা বাসনাই ব্যক্ত হয়েছে। ইন্দ্র অগ্নি মিত্র বরুণ প্রভৃতি দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বেশির ভাগ রচনাতেই সেখানে কেবল একটা দাও দাও ভাব। প্রথমে দেবতাদের রূপম ও গুণের বর্ণনা এবং শৌর্য-বীর্যের প্রশংসা তারপর ধন দাও বল দাও মান প্রতিপত্তি দাও গাভি দাও নারী দাও আশ্রয় দাও ক্ষমতা দাও, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য দেবতাদের খুশি করার জন্য যজ্ঞাগ্নিতে নানবিধ হবি ও সোমরস নিবেদন করা হত।আমার তো মনে হয় সেই থেকেই ভারতবর্ষের সমাজে ক্ষমতাবানদের স্তাবকতা করা (স্তুতি থেকেই স্তাবকতা) এবং ঊর্ধ্বতন কর্তাদের উৎকোচ দেবার কুপ্রথাটি চালু হয়েছে। ফরমান জারি করে বলা হয়েছিল বেদের বাণী অলঙ্ঘনীয়, কিন্তু মজার কথা হল, পরবর্তী সময়ে উপনিষদের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সেইসব বেদবাক্যকেও আপডেটেড হতে হল।

Monday, May 30, 2016



কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (১) 

মুরারি সিংহ

মাননীয় পাঠক, একবার ভেবে দেখুন এই সমাজ-সংসারে আমাদের বেঁচে থাকাট অনেকটাই অভ্যাস-নির্ভর। সারাদিন আমরা যা করি যা ভাবি যা স্বপ্ন দেখি তার বেশিরভাগটাই এক রকম অভ্যাসেরই দাসত্বগিরি। অভ্যাসের দাসত্বগিরি করি বলেই নতুন ভাবনার মধ্যে বেঁচে থাকার দায়িত্ব কমে। বাঁচার পথ মসৃণ থাকে। আমরা অধিকাংশ সময়ে যা চিন্তা করি তা হয় সুখে থাকার চিন্তা অথবা দুশ্চিন্তা। সেই ছকে বাঁধা পথ ছেড়ে নতুন কিছু ভাবা বা করার মধ্যে একটা ঝুঁকির ব্যাপার থেকে যায়।আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা এড়িয়ে চলতে চাই। নিতান্ত শখ করে কেউ অভ্যাস থেকে বেরোতে চায় না। যতদিন ছকবাঁধা জীবনে বসবাস করাটা মানুষকে মানসিক তৃপ্তি দেয় ততদিন সে নিশ্চিন্ত। আবার যখন কেউ মনে করে বাঁধা গতে চলতে গিয়ে তার সামনে এক বিশাল অস্তিত্বের সংকট এসে হাজির হয়েছে তখন সে কতকটা বাধ্য হয়েই নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা করে। নতুন কিছু করার সাহস দেখায়। মাঝে মাঝে এমন একটা সময় আসে যখন এই অস্তিত্বের সংকট একটা গোটা প্রজন্মকে গ্রাস করে তখন নতুন কিছু করা বা ভাবার একটা মিলিত প্রয়াস তৈরি হয়। একজন একরত্তি মানুষের লড়াই বড়োদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে তার সঙ্গে নিজের ছেলেমানুষি মিশিয়ে আপন অস্তিত্ব জাহির করা। আবার যখনই সে শৈশব থেকে কৈশোরে বা কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখে তখন তার লড়াইটা বদলে যায়। তার তখন একটা স্বকীয়তার দরকার হয়। সেটা অর্জনের জন্যেই সে আপ্রাণ চেষ্ঠা করে। বাচ্ছা বয়সের এইটাই একটা বিশেষ দোষ বা গুণ। এভাবেই একটু একটু করে তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয় এবং একসময় নিজের ক্রমশই পেকে-ওঠা চিন্তা-ভাবনা ও কাজকর্মের ভিতর দিয়ে নিজস্বতার ছাপ রাখে। এবার তার সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ফেলে আসা জীবনের পুরোন অভ্যাস যা তার বেড়ে ওঠার পথে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। তখন সে তার থেকে মুক্তি পেতে চায়। কবিতার আপডেট প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছি কারণ আমরা যারা কবিতা লেখার চেষ্টা করি তারাও কেউ ভুঁইফোড় নই। কারণ তাদের এই সমাজের মধ্যেই লালিত-পালিত হতে হয়, বেড়ে উঠতে হয়। প্রথাগত শিক্ষালাভ করতে হয়। সুতরাং কবিতা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণার বীজ এই সিস্টেমের মাধ্যমেই তাদের মধ্যে প্রোথিত হয়ে যায়। কবিতা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বা কবিতা লিখতে গিয়ে তারাও প্রথম প্রথম সেই অভ্যাস থেকে বেরোতে পারেন না বা বেরোতে চান না। কিন্তু যখনই তার মনে হয় এই অভ্যাসের দাসত্ব করা তার নিজস্বতা অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখনি সেই দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে তারও ভেতরটা হাঁস্ফাঁস করতে থাকে।এই ভাবেই যুগে যুগে বা দশকে দশকে একটু একটু করে কবিতাও বদলাতে থাকে। সুতরাং এই বদল এক নিরন্তর প্রবাহ। একদিন যারা তরুণ তুর্কি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আজ তারা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। আজ যারা বিদ্রোহ ও বিক্ষোভে সামিল হয়েছে একদিন তাদেরো বরণ করে নিতে হবে সাবেকি হবার তকমা। এবার প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় বলি – “কাব্যরস নামক অমৃতে যে আমাদের অরুচি জন্মেছে, তার জন্য দায়ী এ যুগের স্কুল এবং তার মাস্টার। কাব্য পড়বার ও বোঝবার জিনিস, কিন্তু স্কুল মাস্টারের কাজ হচ্ছে বই পড়ানো ও বোঝানো। লেখক ও পাঠকের মধ্যে এখন স্কুলমাস্টার দণ্ডায়মান। এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে থাক, চার চক্ষুর মিলও ঘটে না। স্কুলঘরে আমরা কাব্যের রূপ দেখতে পাই নে শুধু তার গুণ শুনি।” আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েরর পাঠ্যসূচি এবং পড়ানো ও বোঝানোর ব্যাপারগুলো সত্যি এত ব্যাকডেটেড ও গতানুগতিক যে তা কখনো আমাদের কবিতা-চর্চাকে যথাযথ পুষ্টি দিতে পারে না। বরং পিছিয়ে দেয়। সুতরাং যারা কবিতা লেখেন কবিতাকে আপডেট করাটা তাদের অবশ্য কর্তব্য।

Sunday, May 29, 2016


বাজার অর্থনীতি ও একুশ শতকের বাংলা কবিতা (পঞ্চম পর্ব) ০ মুরারি সিংহ 

আটের দশকের শেষ-পর্ব বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে রইল পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির পতনের জন্য। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল চিনে। তিয়েন-আন-মেন-স্কয়ারে। ১৯৮৯ সালে। একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সাধারণ মানুষের দলবদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আন্দোলন। চিনে সেই প্রয়াস ব্যর্থ হলেও অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব-ইউরোপে। প্রথমে পোল্যান্ড, তারপর হাঙ্গেরি, পূর্ব-জার্মানি, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া হয়ে শেষে রোমানিয়া। সব জায়গাতেই লৌহ-দৃঢ় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হল। কোথাও অহিংস উপায়ে কোথাও বা আবার তা হিংসার পথ বেছে নিল। এরপর একইভাবে গর্বাচেভের পেরেস্ত্রৈকা ও গ্লাসনস্তের প্রভাবে ১৯৯০ থেকে ভাঙতে শুরু করে ১৯৯১ সালের শেষ দিকের মধ্যে সম্পূর্ণ পতন ঘটল সোভিয়েত রাশিয়ার। তারপর আলবানিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া মুক্ত হল কমিউনিস্ট শাসনের নাগপাশ থেকে। একইভাবে কাম্পুচিয়া, ইথিওপিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং দক্ষিণ ইয়েমেন থেকেও সমাজতন্ত্র বিদায় নিল। 

তার মানে নব্বইয়ের দশক শুরুই হল ভয়ংকর এক পতন দিয়ে, যা বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষাপটটাকেই একেবারে বদলে দিল। কারণ এতদিন ধরে চলে আসছিল দুই-মেরু বিশ্বের ধারণা যার একমেরুতে ছিল সোভিয়েতের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির এবং অন্য-মেরুতে আমেরিকার নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক শিবির। মাঝখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি। এখন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেখা দিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একাধিপত্যের সুযোগ। এই সূত্রে বাজার-অর্থনীতির রমরমা শুরু হল। বহুজাতিক পুঁজিপতিদের সামনে সারা বিশ্বে দখলদারি চালানো ও আধিপত্য বিস্তারের আর কোনো বাধা রইল না। আমরা আমাদের দুঃখ-কষ্ট নিবারণের জন্যে পেয়ে গেলাম বিশ্বায়ন নামক একটি নতুন ললিপপ। সেই সঙ্গে শিল্পায়ন, নগরায়ন এই রকম আরো কিছু শব্দ। একই সময়ে খুব নিঃশব্দে আরেকটি ওলট-পালট ঘটে গেল। সেটা উচ্চ-প্রযুক্তির বিপ্লব। বিজ্ঞান ও কাগরির অত্যাধুনিক প্রয়োগে কমপিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার খোল-নলচে বদললে গেল। সারা বিশ্ব চলে এল হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর নতুন নামকরণ হল ভুবন-গ্রাম। 

নতুন প্রযুক্তি মুষ্ঠিমেয় গোষ্ঠী বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না, তা পৌঁছে গেল দূর থেকে দূরান্তরে। প্রত্যন্ত প্রদেশে। সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের বাম-সরকারও বিশ্বায়নকে মেনে নিল।দেখা গেল এই সময়ে এই রাজ্যের মাটিতে তাদের শাসন ও অপশাসন আরো দৃঢ়মুল হয়েছে। এই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে নব্বইয়ের বাংলা কবিতা তুমুলভাবে স্পন্দিত হল। বিস্তর নতুন ও ঝকঝকে ও তাজা ছেলেমেয়ে কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করল। নতুন প্রজন্মের কবিদের ভাব-ভাবনা, আঙ্গিক-চর্চা ও নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তর ঔপনিবেশিক ও উত্তরাধুনিক চিহ্নগুলি স্পষ্ট হতে থাকল। প্রথাগত যুক্তিজালকে ছিঁড়ে ফেলে সবকিছুকে এলোমেলো করে দেওয়া, জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও মিথগুলিকে অস্বীকার করে চিন্তার এক বহুমুখী ভুবনকে আবিষ্কার করা, ছন্দ ও শব্দ-প্রয়োগের ক্ষেত্রকে আরো ব্যাপক মাত্রায় নিয়ে গিয়ে বোধ ও বুদ্ধির নতুন নতুন পরিসর তৈরি করা। চিহ্ন, প্রতীক, চিত্রকল্প, বাকরীতি, উপস্থাপনা সবকিছুতেই নিজস্ব স্বাক্ষর লাগিয়ে দেওয়া। এসবই উজ্জ্বল হয়ে রইল অপসৃয়মাণ শতাব্দীর শেষ দশকের কবিতায়। 

আশির দশকে বাংলা-কবিতার ভাষা-বদলের যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল কবিতার চেনা ছক থেকে বের করে আনার জন্যে সেখানে নানা জন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ফলে বাংলা কবিতাকে তথাকথিত মূলধারার বাইরে চালিত করার একটা বীজতলা তৈরি হচ্ছিল। সেই প্রচেষ্টায় তুমুল গতি পেল পরের দশকের কবিতায়। নব্বইয়ের কবিদের আত্মপ্রকাশের প্রধান পীঠস্থান হল প্রতি পক্ষে প্রকাশিত কবিতার কাগজ কবিতাপাক্ষিক। তাঁদের প্রধান মদতদাতা হলেন কবিতাপাক্ষিকের কর্নধার প্রভাত চৌধুরী যিনি ষাটের দশকের ধ্বংসকালীন আন্দোলনের অন্যতম মুখ হলেও মাঝখানে বহুদিন কবিতায় ছিলেন না। নব্বইয়ের দশকে তিনি নতুন ও তুমুল উদ্দীপনা ও প্রাণশক্তি নিয়ে শুরু করলেন কবিতাপাক্ষিক। এই কাগজটির আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে বাংলা কবিতার অভিমুখটাই বদলে গেল। সেখানে যেমন অগ্রজ কবিদের কবিতা জায়গা পেল তেমনি ভিড় বাড়ল নতুন ভাবনা নিয়ে লিখতে আসা কবিদের, যাদের মধ্যে আবার একটা বড়ো অংশই প্রান্ত-বাংলা থেকে উঠে আসা। কবিতা পাক্ষিকের এই উন্মাদনা অনেককেই অনুপ্রাণিত করল এবং নানা প্রান্ত থেকে অনেক সমমনস্ক পত্রিকার প্রকাশ এবং কবিতার বই ছাপাও শুরু হল। উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে তাদের ছাপাই-বাঁধাই-অঙ্গসৌষ্ঠভও হল চোখে পড়ার মতো। বোঝা গেল তারা শহর কলকাতার সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছে। বাংলা কবিতায় নয়ের দশককে অনায়াসে কবিতাপাক্ষিকের দশক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। 

কবিতার পাশাপাশি বাংলা গানের কথা ও সুরেও এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এল। এল জীবনমুখী গান ও বাংলা-ব্যান্ড। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সে-সব ভীষণ জনপ্রিয় হল। নতুনত্বের এই উন্মাদনার ঠেলায় পড়ে বাণিজ্যক ভাবে প্রকাশিত বহুল-প্রচারিত পত্রিকাও ভোল বদলে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ও আধিপত্য বজায় রাখতে এই সব নতুন কবিদের কবিতা ছাপতে বাধ্য হল। মজার কথা, সেই পত্রিকাগোষ্ঠীর থেকে প্রকাশিত মেয়েদের রূপচর্চার কাগজেও কবিতা বিভাগ খুলে সেখানে নতুন কবিদের জায়গা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের সমূহ চেষ্টা করা হল। আধিপত্য জারি রাখার খেলায় অবশেষে অর্ধশতাব্দী পরে আবার পুনরুজ্জীবিত করা হল কৃত্তিবাস-কেও। যদিও আর পাঁচটা পত্রিকার সঙ্গে আলাদা করার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে দেখা গেল না। আবার গঞ্জ ও মফসসল থেকে কবিতাপাক্ষিকের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার সহযোগী হিসেবেও বেশ কিছু নতুন পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করল। সব মিলিয়ে অবশ্য আখেরে লাভ হল নতুন প্রজন্মের কবিদের। তারা অনেক বেশি করে পরিবেশিত এবং প্রচারিত হবার সুযোগ পেল।

Sunday, May 22, 2016

বাজার অর্থনীতি ও একুশ শতকের বাংলা কবিতা (চতুর্থ পর্ব) ০ মুরারি সিংহ




                 

রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নানাবিধ ঘটনার কারণে ষাটের দশক আরো বেশি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে হাজির হল। ৫৯-এর শেষপর্বে সংগঠিত খাদ্য-আন্দোলনের যঙ্গে ৬০-এ এসে একে একে যুক্ত হল রেলধর্মঘট, ভিয়েতনাম-যুদ্ধ, চিন-ভারত ও চিন-পাকিস্তান যুদ্ধ। সাম্যবাদীদের মধ্যে প্রবল হল মতাদর্শের দ্বন্দ্ব। কমিউনিস্ট পার্টিও তখন দুভাগ অতঃপর শেষের দিকে কংগ্রেসি শাসনের অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পত্তন। তারও পরে অতিবামপন্থীদের হাত ধরে নকশাল আন্দোলনের সূচনা। রাজনৈতিক পালা বদলের মতো সমূহ বিপন্নতা ও ক্ষু-পীড়িত যন্ত্রনাবোধ থেকে এই দশক সাহিত্যিক পরিসরেও অনেক আন্দোলনের জন্ম দিল।হাংরি-শ্রুতি-শাস্ত্রবিরোধী-ধ্বংসকালীন-নিমসাহিত্যএদের মধ্যে হাংরি-জেনারেশনের গায়ে পুলিশী ছোঁয়া লাগার কারণে তা অবশ্য আলাদা মাত্রা পেয়ে গেছে। হাংরিদের কাছে ক্ষুধা মানে অবশ্যই ভুখা-মিছিলে পা মেলানো ছিল না, সে-ক্ষুধা আসলে সাহেবি সভ্যতার প্রভাবে জাত মধ্যবিত্ত যুবককুলের এক ধরণের তীব্র রিরংসার প্রকাশ। যাকে প্রতিষ্ঠানের হর্তা-কর্তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। আইন-আদালত হল। কবিকে দাঁড়াতে হল কাঠগড়ায়। ফলে তা বাংলা কবিতায় এক অন্য ইতিহাস তৈরি করল। 
৩০-৪০-৫০এর দশকে কবিরা ছিলন কুশলী শব্দশিল্পী। নাগরিক অভিজ্ঞতা ও অন্বেষণেই তাঁদের শিক্ষিত মনের প্রকাশ ঘটেছিল। কবিতা লিখতে গিয়ে তাঁরা কোনো তত্ত্বের ধার ধারেননি।কিন্তু আগের সময়ের সেই সব লেখালিখিকে নতুন প্রজন্মের পছন্দ হল না। তাঁদের মনে হল এইভাবে সাহিত্যিক পরিসরে একটা সম্পূর্ণ স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছে। তাঁদের মনে হল এর বিরুদ্ধে একটা সংগঠিত বিদ্রোহ দরকার। তরুণ তুর্কিরা সকলেই তখন পশ্চিমের ধাঁচে এক একটা দল বানিয়ে নিজস্ব তত্ত্ব বা তত্ত্বহীনতা তৈরি করে নিজের নিজের মতো চেষ্টা করলেন সেই অচলায়তনকে ভাঙার। চরিত্র এক না হলেও সব আন্দোলনই তাই প্রচলিত রীত-নীতির বিরুদ্ধে। নিয়ম ও শাসনের দুর্গে কামান দাগা। সুতরাং তাঁদের লেখালিখি ও কাজকর্মে প্রাতিষ্ঠানিরীতি-নীতির প্রতি একটা তীব্র হতাশা ও ব্যর্থতার জায়গা থেকে কবিতায় প্রচুর হইহল্লা নিয়ে বেপরোয়া ভাবে হাজির হল মাত্রাছাড়া ক্লেদ, পাপ, নৈরাজ্য, যৌনতার মতো যত ভয়ংকর ও অভিশপ্ত চিন্তা-ভাবনা। আদিযুগে চর্যাপদের ডোম্বীর প্রান্তিক-বাংলায় জন্ম নেওয়া গ্রাম্য যৌনতা যমুনাপারের কুঞ্জবনের খোলা হাওয়ায় পূর্ণ-বিকশিত দেহবিলাস হয়ে মধ্যযুগের প্রান্তে এসে সেঁদিয়ে গেছিল বিদ্যাসুন্দরের সুড়ঙ্গে, তারপর কবিগানের আসর থেকে কল্লোল-পর্বে বস্তি ও বেশ্যাপল্লী ছুঁয়ে তা আধুনিকতার এই চুড়ান্তপর্বে জায়গা করে নিল তীব্র নাগরিকের বিকৃত মানসিকতায়। তবু বিশেষজ্ঞদের মতে প্রচুর ভালো-মন্দ মিলিয়ে ষা্টের দশকে বাংলা কবিতায় ভিন্ন উচ্চারণের অনেক নতুনতর স্বর যুক্ত হল। তাত্ত্বিক সাংকেতিক আত্মজৈবনিক অশ্লীল বৈপ্লবিক প্রতিক্রিয়াশীল বিষণ্ণ স্ফূর্তিবাজ হাসি-ঠাট্টা রক্তক্ষরণ আত্মধ্বংসী এই রকম সব নানা স্বর ও সুরের সমাবেশে সামগ্রিকভাবে এই সময়ের কবিতা হয়ে উঠল বর্ণময়। 
তবে ষাটের দশক আরেকটি কারণে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে রইল। সেটা হল বাংলা কবিতার জগতে বৃহ-পুঁজির অনুপ্রবেশ। এর আগে পর্যন্ত যে সব পত্র-পত্রিকায় কবিতা ছাপা হত তারা ছিল সাহিত্যের প্রতি ষোলো আনা উসর্গীকৃত। সাহিত্যের কল্যাণের একটা বিশেষ দায়-দায়িত্বের জায়গা থেকে কিছু সাহিত্য-পাগল লোকজন সেই সব কাগজ বের করতেন। আর্থিক লাভ-লোকসানের হিসেব তাঁদের ছিল না। কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে কাব্য-জগতের উপর হঠা করে বেনিয়া-সমাজের নজর পড়ল। তারা তাদের মূলধন সমেত ঢুকে পড়লেন এই বঙ্গের সাহিত্যিক পরিসরে। এর পিছনে অবশ্যই ছিল স্বার্থবুদ্ধি। এই স্বার্থবুদ্ধিরও আবার বেশ কয়েকটি দিক ছিল। প্রথম্‌ত, অর্থনৈতিক মুনাফা। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের সমজদার ও পৃষ্ঠপোষকের মুখোস পরে তার বাজারটিকে পুরোপুরি নিজেদের দখলে এনে তার উপর একাধিপত্য কায়েম করা, খবরদারি ও নিয়ন্ত্রণ জারি করা। তৃতীয়ত, নিজেদের মতো করে পাঠকদের রুচি তৈরি করা। সব মিলিয়ে সাহিত্যের আন্দোলনমুখিনতাকে অবদমিত করা। এক কথায় কবি-লেখকদের মেধাকে নিজেদের একচেটিয়া কারবারের কাজে লাগানো। সব দিক দিয়ে দেখলে তাই সাহিত্যের সেবা করা নয় তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠল সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের প্রতিষ্ঠা। এই কাজ করতে গিয়ে তারা প্রথমেই লেখার ক্ষমতা আছে এমন কিছু মানুষকে মুদ্রার বিনিময়ে বশ করে নিল। তাদের সেরার শিরোপা দিল। নিজেদের বহুল প্রচারিত পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বিপুল প্রচারের সুযোগ করে দিল। কাউকে বানালো সাংবাদিক কাউকে দিয়ে লেখালো খেলাদুলো থেকে রূপচর্চার বিষয়ে নানান ফিচার ইত্যাদিতারপর প্রয়োজন মিটে গেলে কাউকে কাউকে ছিবড়ে করে আবর্জনার স্তুপে ছুঁড়ে ফেলে দি

সত্তরের দশক বাঙালির সমাজ জীবনের আর এক উত্তাল, অস্থিরসময়। নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের আকর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হাজার হাজার তরুণ অপরাজেয় রাষ্ট্রশক্তির বন্দুক-বেয়োনেটের সামনে।কাশীপুর, বরানগরের ট্রাকভর্তি লাশ উধাও হয়ে গেল গঙ্গা গর্ভে, বস্তাবন্দি লাশ বারাসাতের রাস্তায়, মৃতদেহ মাড়িয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ, কয়েদখানায় হত্যা আমাদের জীবনে তা আগুনের আলপনা এঁকে দিল। 

সত্তরের প্রথম পর্ব যদি হয় এক মৃত্যুর চালচিত্র তাহলে তার দ্বিতীয় পর্ব হাজির হল আরেক মেজাজ নিয়ে। জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলির অবসান ঘটল, ইন্দিরা গান্ধির পতন ঘটল। কেন্দ্রে প্রথম অ-কংগ্রেসি মন্ত্রীসভা গঠিত হল। আর সাধারণ মানুষের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গী করে রাজ্যে ক্ষমতাসীন হল বামফ্রন্ট।   

সত্তর দশকের বাংলা কবিতায় অন্য আন্দোলন না থাকলেও রাজনৈতিক আন্দোলনের ছায়া তীব্র হয়ে রইল। একটা বড়ো অংশের কবিতার মধ্যে সমাজ-জীবনের এই  জমে ওঠা অসন্তোষের সাহসী প্রকাশ ঘটল। অনেকেই কলম ধরলেন সংগ্রামের লক্ষ্যে।সময় চেতনায় উজ্জ্বল নিরাবরণ অথচ তীক্ষ্ণ গদ্যে লেখা সরল খোলা ভাষায় লেখা সেই সব কবিতায় ধরা রইল সেই সময়ের রক্তছবি। আবার সেসবের মধ্যে না গিয়ে অনেকে সুশিল্পিত নাগরিক পরিমার্জিত উজ্জ্বল কাব্যলেখায়  ঝুঁকে পড়লেনতবে এই সময়ে সাহিত্য-জগতে আরেক একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেল। ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ ঘোষণাকারী অতি-বামপন্থী বিপ্লবীরা বলেছিলেন সশস্থ কৃষিবিপ্লবের কথা। ডাক দিয়ে ছিলেন গ্রাম দিয়ে শহর দখল করার কথা। রেডবুক আর রাইফেল হাতে নিয়ে এই স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে একটা গোটা প্রজন্মের কত যে তরুণ তাজা প্রাণ অকালে ঝড়ে গেল।  
রাজনৈতিক পরিসরে মাও-দে-জংয়ের ভাবশিষ্যদের রোম্যান্টিক বিপ্লব-বিলাস সফল হল না বটে, তবে সাহিত্যের আঙ্গিনায় কিন্তু প্রবলভাবে উঠে এল শহরতলি ও গ্রাম। এর আগে বাংলা কবিতায় যে সব বদল ঘটেছিল সবার ভিত্তি ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক নাগরিকতা।কিন্তু ষাটের দশকের শেষ দিক থেকেই সেই পরস্থিতি বদলাতে শুরু করল। বাণিজ্যিক পত্রিকার বিপরীতে কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে ছোটো পত্র-পত্রিকা প্রকাশের ঢেউ লাগল দূর দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জ-মফসসলে। ক্ষণজীবী-দীর্ঘজীবী সেইসব ছোটো-বড়ো লিটিল-ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে আত্ম-প্রকাশ ঘটল অনেক কবি-সাহিত্যিকের। বাণিজ্যক পত্রিকা যেখানে বাজারি লেখালেখিতে মগ্ন রইল সেখানে কলকাতার বাইরে কবিতা-চর্চায় যেন একটা জোয়ার এল। দেখা গেল লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতে চলছে আঙ্গিক ও বিশয়-আশয় নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যা বাংলা-সাহিত্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে এক নতুন প্রাণের সন্ধান দিল। গল্প-কবিতায় বেশি বেশি করে হাজির হল গ্রামীণ মানুষ, গ্রামীণ পরিবেশ গ্রামীণ শব্দ, গ্রাম্য মাটির সোঁদাগন্ধবাজারি পত্রিকার বাইরের কবি-সাহিত্যিকরাও প্রমাণ করলেন আঙ্গিকের উপর দখল, বাকভঙ্গির নিপুনতা, অনুভবের গভীরতা, ভাবের সংহতি, প্রকাশের বৈচিত্র এসব কিছুতে তাঁরাও কিছু কম যান না। বরং অনেক তথাকথিত খ্যাতিমানের চেয়ে তাঁদের অনেকে বেশ এগিয়ে আছেন। প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাহীন এইসব সাহিত্য-পত্রিকাগুলি থেকেই পরবর্তী সময়ের অনেক শক্তিশালী কবি;এলহকের জন্ম হল। পাশাপাশি সত্তরের দশকেই মহিলা কবির সংখ্যাবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে পেলতাঁরাও হাজির হলেন নারীদের নিজস্ব ভাবনা নিয়ে 
  
সত্তরের পরবর্তী আশির দশককে আমার মনে হয় যেন একটা শূন্যতা বোধের সময়কাল তেমন কোনো নতুন প্রত্যয়ের সন্ধান পাওয়া গেল না নতুন কোনো উপপাদ্য উঠে এল না এই সময়ের লেখালিখি একটা গতানুগতিকার মধ্যে আবর্তিত হল অবশ্য তার পিছনে সমকালীন রাজনৈতিক স্থবিরতারও একটা অবদান আছে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল মার্কসবাদীরা বিপ্লবের স্বপ্নে জলাঞ্জলি দিয়ে সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় এসে চেষ্টা করলেন পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ থেকে শুরু করে অপারেশন-বর্গা, খাস-জমি দখল ও পাট্টা-বিলি, মজুরি-বৃদ্ধি আন্দোলন এই সব করে খেটে-খাওয়া মানুষের পাশে থাকতে প্রথম প্রথম সাফল্যও এল জনগণ এই বামপন্থাকে সাদরে বরণ করে নিল ভূমি-সংস্কারের লক্ষ্যে এইসব পদক্ষেপ গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিল কিন্তু তারপর ছবিটা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল ক্ষমতার-বৃত্তে বিচরণ করার সুবাদে তার আনুষঙ্গিক দোষগুলি সর্বহারার নেতাদেরও রেহাই দিল না দেখা গেল ছোটো-বড়ো-মেজো কমরেডরাও আস্তে আস্তে দুর্নীতি-স্বজনপোষণ-বিরূপ সমালোচনার প্রতি খড়্গহস্ত-দম্ভ-অহংকার-স্বৈরাচারী মনোভাব ইত্যাদি যাবতীয় বদগুণগুলিতে রপ্ত হয়ে গেছেন  

গ্রামীণ সমাজের এই পরিবর্তন কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষদের নতুন কোনো দিশা দেখাতে পারল না তাদের জীবনযাপন হল বৈচিত্র্যহীন এই সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের অনেককেই দেখা গেল লিটিল-ম্যাগাজিনগুলিকে আঁতুড়-ঘর হিসেবে ব্যবহার করে বাজারি-পত্রিকায় জায়গা পেতে চাইছেন, অনেকেই আবার ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে নানা রকম সরকারি পুরস্কার ও বদান্যতা পাবার আশায় নেতা-মন্ত্রীদের মোসাহেবি শুরু করেছেন। আবার যে-সব ছোট-পত্রিকা ততদিনে বেশ নাম-ডাক তৈরি করতে পেরেছে তাদের সম্পাদক ও কর্তাব্যক্তিদের মধ্যেও বেশ একটা উন্নাসিক ও আঁতলেমির ভাব গড়ে উঠেছে। আরেক দিক দিয়ে প্রযুক্তির কল্যাণে সাউন্ড-রেকর্ডিং-এর দুনিয়াতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার কারণে প্রথমে লং-প্লেয়িং রেকর্ড তারপর ক্যাসেট এর মাধ্যমে কবিতা-আবৃত্তি শিল্পের একটা রমরমা ব্যবসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাচিক-শিল্পীরা আবাব্র সেইসব কবিতাই বেশি পছন্দ করছেন যেগুলিতে বেশ আবেগ আছে, গল্প আছে, মাইক্রোফোনের সামনে নাটকীয় উপস্থাপনার মাধ্যমে যা পাবলিককে বেশ খাওয়ানো যায় এমন সব রসদ আছেবাইরের নিস্তরঙ্গ জীবনে ক্লান্ত এই সময়ের কেউ কেউ অবশ্য মন দিলেন কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তনে। তাঁদের মতো করে তাঁরা কবিতার ভাষা-বদলের কিছু চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেসবের মধ্যে কোনো উত্তরণ দেখা দিল না। আশির দশককে অনেকেই কল্পনা করেছিলেন মুক্তির দশক হিসেবে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কবিদের কাছে তার কোনো সুসংহত ভাব নেই, নতুন কোনো প্রেরণা নেই, স্ফূর্তির মেজাজ নেই, কেমন নীরস ও জোলো।

Thursday, May 19, 2016

বাজার অর্থনীতি ও একুশ শতকের বাংলা কবিতা (তৃতীয় পর্ব) ০মুরারি সিংহ




 
কিন্তু এসবের মধ্য থেকেও নতুনের সন্ধানীরা কাঙ্ক্ষিত উদ্দীপনা পেলেন না। পেলেন না মননের সমৃদ্ধি। কারণ সেখানে যন্ত্র ও যন্ত্রণা-নিনাদিত বৈশ্য যুগের অবিশ্বাস ও অবক্ষয়ের সঠিক প্রতিফলন ছিল না। ততদিনে ইংরেজি শিক্ষার সুবাদে তাঁদের জানা হয়ে গেছে ইউরোপীয় সাহিত্য, ফ্রয়েডের নবমনস্তত্ত্বজ্ঞান ও মার্ক্সের সর্বহারার মতবাদ। জেনেছেন ওমর খৈয়ামের আবেদন।তখন আদিগন্ত ছায়া-বিস্তারকারী রবীন্দ্রচেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনে হচ্ছে সর্বত্যাগী বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হবার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, অনাচারী ব্যাভিচারী লম্পট হবার মধ্যেও কিছু কম আনন্দ নেই নিজেদের রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য সেই ভাবনা থেকেই কল্লোল-পত্রিকার সূত্রপাততাকে কেন্দ্র করে নতুন সাহিত্য-আন্দোলন। সেই আন্দোলনকারীদের কাছে মানুষের মানে দাঁড়াল রক্তমাংস হাড় মেদমজ্জা ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ কাম হিংসা সমেত গোটা মানুষসেটা অবশ্য জগদীশগুপ্ত, মণীশঘটক(যুবনাশ্ব), বুদ্ধদেববসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এঁদের গল্প-উপন্যাস যতটা বেশি প্রকট হয়েছিল কবিতায় ততটা নয়। তবে নজরুল ইসলাম অচিন্ত্যসেনগুপ্ত বুদ্ধদেববসু প্রেমেন্দ্রমিত্র জীবনানন্দদাশ এঁদের কবিতায় একটা দ্রোহ একটা ভিন্ন উচ্চারণের বীজ অবশ্যই বোনা হয়ে গিয়েছিলঔপনিবেশিক পর্বের ভিক্টোরীয় মূল্যবোধও রবীন্দ্রকবিতার মার্জিত শুচিতায় গীতগোবিন্দ লালিত ও বিদ্যাসুন্দর পালিত যে শৃঙ্গার রস ও যৌনতার প্রকাশ কিছুকাল ঢাকা পড়েছিলনতুন সময়ে পশ্চিমি হাওয়ার নতুন মেজাজ গায়ে মাখিয়ে কল্লোলের গল্প-উপন্যাস-কবিতা বাঙালির সেই স্মৃতিকে আবার উসকে দিল।

নতুন প্রজন্মের কবিদের কাছে কল্লোলের কোলাহল রবীন্দ্র-উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার যে পথ-নির্মাণ করে দিল বুদ্ধদেব বসু ছাড়াও পরবর্তী সময়ে সেই পথে সামিল হলেন অজিত দত্ত-সুধীনদত্ত-বিষ্ণুদে-জীবনানন্দদাশ-অমিয়চক্রবর্তী-সমরসেন এঁদের মতো কবিরা। বাংলা কবিতায় শুরুহল রবীন্দ্রোত্তর পর্বতাঁদের পুষ্টি জোগান দিল পশ্চিমের প্রতীক আন্দোলন এবং ফরাসি সাহিত্যের বোদলেয়র থেকে শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যের এলিয়টের কবিতা তাঁরা যে ধারার কাব্যচর্চা করলেন তার নাম আধুনিকতাবাদ বিশেষজ্ঞদের চোখে চিহ্ন-প্রকরণ বিচার করে বাংলা-কবিতায় আধুনিকতা বলতে আমরা যা বুঝি তা কিন্তু ইউরোপীয় আধুনিকতা যা এদেশে এসেছিল ঔপনিবেশিক শাসনকালে, পরাধীনতার সময়ে তাই এখানে আধুনিকতা বলতে সম-সাময়িকতা বা সমকালিনতা অর্থাকোনো নির্দিষ্ট সময়কালকে বোঝায় না যে অর্থে ভারতচন্দ্রের চেয়ে ঈশ্বরগুপ্ত আধুনিক, বা ঈশ্বরগুপ্তর চেয়ে মাইকেল, মাইকেলের চেয়ে বিহারিলাল বা বিহারিলালের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক, সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে জীবনানন্দদাশরা আধুনিক নয় আধুনিকতা বলতে একটা নতুন অ্যাটিটিউডকে, একটা বিশেষ মর্জি বা ঝোঁককে বোঝায় বাংলা কবিতার আরো অনেক বাঁক-বদলের মতো এটাও একটা নতুন বাঁক-বদল সাগরপার থেকে এদেশে আমদানি করা এই মর্জির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল নগরকেন্দ্রিক ক্লান্তি ও নৈরাশ্যবোধ, আশ্রয়হীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রচলিত মূল্যবোধ বা সত্য-সুন্দর-মঙ্গল এসবকিছু নিয়েই ভয়ংকর সন্দেহ ও সংশয়, জৈব-প্রবৃত্তির প্রতি উদ্দাম বশ্যতা, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রুপ ও বিদ্রোহ এইসব 

সুতরাং সুধীন্দ্রনাথদত্ত, বুদ্ধদেববসু, অমিয়চক্রবর্তী, জীবনানন্দদাশ, বিষ্ণুদে, সমরসেন প্রমুখ রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিকরা কল্লোলের কবিদের কাছে যা পেয়েছিলেন তা প্রধানত রবীন্দ্র-বিমুখতাবাকিটা তাঁদের নিজস্বতাঁরা আবার অনেকেই ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। তাদের হাত ধরে বাংলা-কবিতকে ভর্তি হতে হল ইংরেজি মিডিয়াম ইসকুলে। ব্যাপারটা বিসদৃশ মনে হলেও ফলাফল খারাপ হল না। বহুকালের লালিত সংস্কার ত্যাগ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা কবিতা পাশ্চাত্য সাহিত্যের ঠাট-বাটকে আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল। শুধু প্রতিমা নির্মাণ নয় তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠাও করতে পেরেছিল। বিশের দশকের কবিদের যেমন ছিন কল্লোল-কালিকম-উত্তরা, ত্রিশের দশকের আধুনিকদের পূর্ণ প্রকাশ ও বিকাশ কিন্তু পরিচয়-পূর্বাশা-বিচিত্রা-কবিতা-চতুরঙ্গ এইসব সাময়িক পত্রকে কেন্দ্র করে

রবীন্দ্রমোহ তথা রবীন্দ্রউপনিবেশ থেকে মুক্তিকামী তিরিশের দশকের কবিদের মধ্যে যে সব চিহ্নপ্রকরণ দেখা গেল তাতে বোখা যায় তাঁরা বাংলার নয় কলকাতারই কবি হতে চেয়েছিলেন ব্যতিক্রম একমাত্র জীবনানন্দপ্রাত্যহিক নগরজীবনের খাঁচায় বন্দি থাকতে থাকতে তাঁদের কবিতায় ফুটে উঠল সেই জীবনের অত্যন্তরীণ সংকটকে অনুভব করার ভাবভাবনা। যদিও সেই জীবনাভূতির প্রকাশটা হল লিরিক্যাল। সংসারের বস্তুচৌতন্যে ভরপুর সেই কবিতার মধ্যে যেমন থাকল একদিকে ভোগসুখ আত্মপ্রসাদ তৃপ্তি ও শৌখিন স্বপ্নবিলাস অন্যদিকে নিঃসঙ্গতা সংশয় হাহুতাশ ভাব ও নানান যন্ত্রণাবাচক শব্দ। রইল ট্রাম পিচের পথ আসফল্ট কংক্রিট জুতোর চাপা ফাঁপা কড়া শব্দ গূঢ় এষণা এবং ইংরেজি কবিতার প্রতিধ্বনি ও নানান দুর্বোধ্য শব্দ যার জন্য পাঠককে বারবার অভিধান দেখতে হয়। কেউ অনুসরণ করলেন ক্লাসিক্যাল রীতি কেউ আবার মৌখিক ভাষারীতি। কবিতার সংগীতনির্ভরতা ত্যাগ করে নতুন কবিরা চেষ্টা করলেন ব্যক্তিরসে পূর্ণ চিত্রকল্প ও উপমার ব্যাবহারে একটা গদ্য-গন্ধী কাঠিন্য আনতে। সেখানে লক্ষ করা গেল এক অসাধারণ বাকসংযম ভাবসংযম ভাবগাম্ভীর্য স্বংসম্পূর্ণতা ও ঋজুতা। যদিও কবিতা হল আলংকারিক এবং ছন্দ ও মিলের ঘনত্বে অভিব্যক্তির ভঙ্গিমায় এক অসাধারণ পেলবতা এল।