ভাবীকাল
ও রবীন্দ্রনাথ (৩)
একবিংশ
শতাব্দীতে এসে আজকের সাইবার-প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও রবি ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে
চাইছে, কত অনায়াসে তাঁকে আপন করে নিচ্ছে, নিজের নিজের মতো করে তাঁকে নতুন করে
আবিষ্কার করতে চাইছে। এই সময়ের কোনো জনপ্রিয় নিউজ-চ্যানেলের সপ্রতিভ
টিভি-সাংবাদিকের মুখোমুখি হলে বিশ্বকবিকে অবশ্যই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত –
গুরুদেব আপনার এই সাফল্যের রহস্যটা কী? রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কী উত্তর দিতেন
জানি না, তবে কিছুটা আঁচ কি আর করা যায় না? হয়ত যায়, হয়ত যায় না। মাননীয় পাঠক,
আসুন আমরা নাহয় নিজেদের মতো করে সেই রহস্যটা খুঁজে দেখি। রবীন্দ্রনাথের পূর্বজদের
মধ্যে দুজন বিশিষ্ট মানুষ রামমোহন ও বিদ্যাসাগর। তাঁরা আবার উনবিংশ শতকে বঙ্গভূমি
তথা ভারতবর্ষ জুড়ে যে নতুন উদ্দীপনা জেগে উঠেছিল তারই অগ্রদূত। বাংলার ভাষা
সাহিত্য ধর্ম সমাজ এসবের পুনর্নির্মাণে এই দুই মহাপুরুষের অবদানের কথা বহু-আলোচিত।
আমাদের আজকের আলোচনা প্রসঙ্গে এঁদের দুজন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নটা দেখে
নেওয়াটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। অনেকেই জানেন রামমোহন যিনি আবার ব্রাহ্মধর্মেরও
প্রবর্তক, তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ের নানা লেখায় কত সপ্রশংস আলোচনা
করেছেন। এই ভারতপথিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বার বার জানিয়েছেন তিনি নব্যবঙ্গের আদিপুরুষ, তিনি বর্তমান
বঙ্গদেশের নির্মাণকর্তা, তিনি বর্তমান
বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছেন, তিনি বাংলার
নবযুগের প্রথম পথপ্রবর্তক। সব
চেয়ে তাৎপর্যপূর্ন যেটা তা হল রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- রামমোহন রায়ের জন্ম এবং তাঁহার
তপস্যা আধুনিক ভারতের সকল ঘটনার মধ্যে বড়ো ঘটনা। প্রসঙ্গত পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই একবার মহাত্মা গান্ধীর
সঙ্গে কবির গভীর সখ্যতা ছিল। কিন্তু একবার গান্ধীজি রামমোহনকে বামন বলে উল্লেখ
করেছিলেন তাতে কবি ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন-আমি সেই রামমোহনকে
আধুনিক যুগের মহত্তম লোক ব'লেই
জানি। পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে অসাধারণ মনীষার অধিকারী রামমোহন রায় সম্পর্কে এসব
কথা বলার কারণ শুধুই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন বা স্মরণ নয়, রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন রামমোহন
সেই মানুষ “যিনি
প্রাচীন কালের সঙ্গে ভাবী কালের,
এক যুগের সঙ্গে অন্য যুগের সম্মিলনের সাধনা করেছিলেন”। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি এই কালের
প্রসঙ্গই আরো স্পষ্ট হয়েছে কবিগুরুর করা বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত মূল্যায়নটিতে যেখানে
তাঁর তীব্র উপলব্ধি - তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন বিদ্যাসাগর সেই যুগকে
ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ সেই বড়ো যুগে তাঁর জন্ম, যার মধ্যে আধুনিক
কালেরও স্থান আছে, যা ভাবী কালকে প্রত্যাখ্যান করে না। যে
গঙ্গা মরে গেছে তার মধ্যে স্রোত নেই, কিন্তু ডোবা আছে;
বহমান গঙ্গা তার থেকে সরে এসেছে, সমুদ্রের
সঙ্গে তার যোগ। এই গঙ্গাকেই বলি আধুনিক। বহমান কালগঙ্গার সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের
জীবনধারার মিলন ছিল, এইজন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক”। এখানে আধুনিক মানে অবশ্যই
আপডেটেড।রবীন্দ্রনাথের কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন আপডেটেড মানুষ। আবার আমরা যাকে
আপডেটেড বলি কবিগুরুর কাছে তার মানে ছিল অগ্রগামী – “বর্তমান কাল ভবিষ্যৎ ও অতীত কালের সীমান্তে
অবস্থান করে, এই নিত্যচলনশীল সীমারেখার উপর দাঁড়িয়ে কে কোন্ দিকে মুখ ফেরায়
আসলে সেইটাই লক্ষ্য করবার জিনিস। যারা
বর্তমান কালের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পিছন দিকেই ফিরে থাকে, তারা
কখনো অগ্রগামী হতে পারে না, তাদের পক্ষে মানবজীবনের পুরোবর্তী হবার
পথ মিথ্যা
হয়ে গেছে। তারা অতীতকেই নিয়ত দেখে বলে
তার মধ্যেই সম্পূর্ণ নিবিষ্ট হয়ে থাকাতেই
তাদের একান্ত আস্থা। তারা পথে চলাকে মানে না। তারা বলে যে সত্য সুদূর অতীতের মধ্যেই তার সমস্ত ফসল
ফলিয়ে শেষ করে ফেলেছে;
তারা বলে যে তাদের ধর্ম-কর্ম বিষয়-ব্যাপারের যা-কিছু
তত্ত্ব তা ঋষিচিত্ত থেকে পরিপূর্ণ আকারে
উদ্ভূত হয়ে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে, তারা
প্রাণের নিয়ম
অনুসারে ক্রমশ বিকাশ লাভ করে নি, সুতরাং তাদের পক্ষে ভাবী বিকাশ নেই, অর্থাৎ ভবিষ্যৎকাল বলে জিনিসটাই তাদের
নয়”। সুতরাং আমরা বুঝতে
পারলাম শেষের কবিতার জনক ভাবীকাল সম্পর্কে কতটা ভাবিত ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন - প্রত্যেক
দেশের মহাপুরুষদের কাজই হচ্ছে এইভাবে বাধা অপসারিত করে ভাবী যুগে যাত্রা করবার
পথকে মুক্ত করে দেওয়া”। এই
মুক্ত হবার মানসিকতা ছিল বলেই নিজের সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ আজকের প্রজন্মের কাছে
সমান প্রাসঙ্গিক।