Tuesday, July 19, 2016

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৩)

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ ()

একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজকের সাইবার-প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও রবি ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছে, কত অনায়াসে তাঁকে আপন করে নিচ্ছে, নিজের নিজের মতো করে তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চাইছে। এই সময়ের কোনো জনপ্রিয় নিউজ-চ্যানেলের সপ্রতিভ টিভি-সাংবাদিকের মুখোমুখি হলে বিশ্বকবিকে অবশ্যই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত – গুরুদেব আপনার এই সাফল্যের রহস্যটা কী? রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কী উত্তর দিতেন জানি না, তবে কিছুটা আঁচ কি আর করা যায় না? হয়ত যায়, হয়ত যায় না। মাননীয় পাঠক, আসুন আমরা নাহয় নিজেদের মতো করে সেই রহস্যটা খুঁজে দেখি। রবীন্দ্রনাথের পূর্বজদের মধ্যে দুজন বিশিষ্ট মানুষ রামমোহন ও বিদ্যাসাগর। তাঁরা আবার উনবিংশ শতকে বঙ্গভূমি তথা ভারতবর্ষ জুড়ে যে নতুন উদ্দীপনা জেগে উঠেছিল তারই অগ্রদূত। বাংলার ভাষা সাহিত্য ধর্ম সমাজ এসবের পুনর্নির্মাণে এই দুই মহাপুরুষের অবদানের কথা বহু-আলোচিত। আমাদের আজকের আলোচনা প্রসঙ্গে এঁদের দুজন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নটা দেখে নেওয়াটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। অনেকেই জানেন রামমোহন যিনি আবার ব্রাহ্মধর্মেরও প্রবর্তক, তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ের নানা লেখায় কত সপ্রশংস আলোচনা করেছেন। এই ভারতপথিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বার বার জানিয়েছেন তিনি নব্যবঙ্গের আদিপুরুষ, তিনি বর্তমান বঙ্গদেশের নির্মাণকর্তা, তিনি বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছেন, তিনি বাংলার নবযুগের প্রথম পথপ্রবর্তকসব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ন যেটা তা হল রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- রামমোহন রায়ের জন্ম এবং তাঁহার তপস্যা আধুনিক ভারতের সকল ঘটনার মধ্যে বড়ো ঘটনাপ্রসঙ্গত পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই একবার মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কবির গভীর সখ্যতা ছিল। কিন্তু একবার গান্ধীজি রামমোহনকে বামন বলে উল্লেখ করেছিলেন তাতে কবি ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন-আমি সেই রামমোহনকে আধুনিক যুগের মহত্তম লোক ব'লেই জানি। পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে অসাধারণ মনীষার অধিকারী রামমোহন রায় সম্পর্কে এসব কথা বলার কারণ শুধুই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন বা স্মরণ নয়, রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন রামমোহন সেই মানুষ “যিনি প্রাচীন কালের সঙ্গে ভাবী কালের, এক যুগের সঙ্গে অন্য যুগের সম্মিলনের সাধনা করেছিলেন” আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি এই কালের প্রসঙ্গই আরো স্পষ্ট হয়েছে কবিগুরুর করা বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত মূল্যায়নটিতে যেখানে তাঁর তীব্র উপলব্ধি - তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ সেই বড়ো যুগে তাঁর জন্ম, যার মধ্যে আধুনিক কালেরও স্থান আছে, যা ভাবী কালকে প্রত্যাখ্যান করে না। যে গঙ্গা মরে গেছে তার মধ্যে স্রোত নেই, কিন্তু ডোবা আছে; বহমান গঙ্গা তার থেকে সরে এসেছে, সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ। এই গঙ্গাকেই বলি আধুনিক। বহমান কালগঙ্গার সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের জীবনধারার মিলন ছিল, এইজন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক” এখানে আধুনিক মানে অবশ্যই আপডেটেড।রবীন্দ্রনাথের কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন আপডেটেড মানুষ। আবার আমরা যাকে আপডেটেড বলি কবিগুরুর কাছে তার মানে ছিল অগ্রগামী – “বর্তমান কাল ভবিষ্যৎ ও অতীত কালের সীমান্তে অবস্থান করে, এই নিত্যচলনশীল সীমারেখার উপর দাঁড়িয়ে কে কোন্‌ দিকে মুখ ফেরায় আসলে সেইটাই লক্ষ্য করবার জিনিস। যারা বর্তমান কালের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পিছন দিকেই ফিরে থাকে, তারা কখনো অগ্রগামী হতে পারে না, তাদের পক্ষে মানবজীবনের পুরোবর্তী হবার পথ মিথ্যা হয়ে গেছে। তারা অতীতকেই নিয়ত দেখে বলে তার মধ্যেই সম্পূর্ণ নিবিষ্ট হয়ে থাকাতেই তাদের একান্ত আস্থা। তারা পথে চলাকে মানে না। তারা বলে যে সত্য সুদূর অতীতের মধ্যেই তার সমস্ত ফসল ফলিয়ে শেষ করে ফেলেছে; তারা বলে যে তাদের ধর্ম-কর্ম বিষয়-ব্যাপারের যা-কিছু তত্ত্ব তা ঋষিচিত্ত থেকে পরিপূর্ণ আকারে উদ্ভূত হয়ে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে, তারা প্রাণের নিয়ম অনুসারে ক্রমশ বিকাশ লাভ করে নি, সুতরাং তাদের পক্ষে ভাবী বিকাশ নেই, অর্থাৎ ভবিষ্যৎকাল বলে জিনিসটাই তাদের নয়” সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম শেষের কবিতার জনক ভাবীকাল সম্পর্কে কতটা ভাবিত ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন - প্রত্যেক দেশের মহাপুরুষদের কাজই হচ্ছে এইভাবে বাধা অপসারিত করে ভাবী যুগে যাত্রা করবার পথকে মুক্ত করে দেওয়া”এই মুক্ত হবার মানসিকতা ছিল বলেই নিজের সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ আজকের প্রজন্মের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক।   

  

Monday, July 11, 2016

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (২)

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (২)  

“রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়. আমার পুরানো নাম। ফিরিবার পথ নাহি;. দূর হতে যদি দেখ চাহি. পারিবে না চিনিতে আমায়। হে বন্ধু, বিদায়”-সময়ের বদলের তালে পা মিলিয়ে নিজেকে বদলানো বা আপডেট করা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং কাজটিও খুব সহজ নয়। তার জন্য যেটা দরকার তা হল নতুনকে মেনে নেওয়া ও গ্রহণ করার মতো উদার মানসিকতা। আবার নতুনকে গ্রহণ করার অর্থ এই নয় যে পুরোনকে পুরোপুরি অস্বীকার করা বা বাতিল করা। তবে নতুনকে স্বাগত জানানো মানে যেমন নিজের কবিতায় কিছু উটকো এবং জীবন-বিমুখ উপাদানের ফুলঝুরি ফোটানো নয়, তেমনি পুরোনোকে আদর করার অর্থ যা নিজের কালকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে নিজের চিন্তাভাবনা ও লেখালিখিতে হয়ত তারও কিছু আবেশ চিহ্ন বজায় রেখেছে। আমারা জানি মানুষের মন আসলে বড়ো জটিল। একই সঙ্গে তার মধ্যে খাঁচার পাখি বাস বেঁধে থাকে আবার বনের পাখিও ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে চায়। কার প্রতি কতটা অনুরাগ দেখাবো এই টানাপোড়েনেই আমাদের বেলা কাটে। একটা সময় পরে দেখা যায় কারো চিন্তা-ভাবনা ও কলমের আঁচড়ে পুরোন ধাঁচারই পাল্লা ভারী হয়ে তাকে ক্রমশই রক্ষণশীল ও গোঁড়া করে তুলেছে, আবার কেউ কেউ সংস্কারমুক্ত মনে নতুনকে গ্রহণ করার ফলে নিজের কবিতাকে সময়োপযোগী চলিষ্ণু ও ফুরুফুরে রাখতে সক্ষম হয়ছে।   যারা লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত তাদের একটা বড়ো লড়াই নিজের সঙ্গেই। বিশেষ করে কবিতা লিখে যারা কিঞিত যশশ্বী হয়েছেন বা এখনকার মার্কেটিংযের ভাষায় যাদের কবিতার বাজারে একটা ব্র্যান্ডনেম তৈরি হয়েছে তাদের সমস্যা আরো বেশি কারণ এইসব কবিরা নিজের নিজের নির্মিত মূর্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। নিজের ভাবমূর্তির মধ্যেই তাদের সৃষ্টিশীলতা তিলে তিলে আত্মহত্যা করে। ফলে বিশ-ত্রিশ বছর পরেও তারা একই ধাঁচে ও একই উচ্চারণে কবিতা লিখে যান বা বলা ভালো নিজেদের পুরোন ইমেজের সঙ্গে সাযুয্য রেখে আগের লেখাগুলোকেই রিরাইট করতে থাকেন। ভাবমূর্তি ভেঙে বেরিয়ে এসে তারা নিজেদের আপডেট করতে পারেন না। সমস্ত ভাবনা-চিন্তার উৎসভূমি আদে যে মন তা নিজের নিয়মেই সদা চঞ্চল। কিন্তু প্রথম থেকেই তাকে নানা ভাবে বশীভূত করার চেষ্টা করা হয়। আসলে এই সংসারে ও সমাজে শিশুকাল থেকে যেভাবে আমরা বেড়ে উঠি তাতে নানান রীতি-নীতি বিধি-নিষেধ আচার-বিচার-সংস্কার দিয়ে ক্রমশই আমাদের একটা মানসিক গড়ন তৈরি হয়ে যায়। বেশিরভাগ সময় সেটাই আমাদের চালিত করে। অল্প বয়সে নানা হরমোন ও অনান্য পারিপার্শ্বিক প্রভাবে মনের মধ্যে একটা বিদ্রোহী ভাব বজায় থাকে বটে তবে বয়স যত বাড়ে সংসারের চাপ যত ভারী হয় ততই সেই আগুন নিস্তেজ হতে হতে আমাদের অজান্তেই কখন যেন তা একেবারে নিভে যায়। তখন একটা কমফোর্ট জোন তৈরি করে মানুষ তার মধ্যেই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চায়। অর্থৎ কিনা গতানুগতিকতাকে শিরোধার্য করে সে সংসারে এক ভারবাহী পশুতে পরিণত হয় এবং তার সমস্ত স্থবিরতা নিয়ে কালস্রোতের একপাশে বৃদ্ধ ব্যাঙের মতো ছিটকে পড়ে। এই কমফোর্ট জোন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু ভাবা ও করার মধ্যে আছে নিত্য-নতুন অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ আবার তার মধ্যেই থেকে যায় বিস্তর ঝুঁকি। সেই পথে পা বাড়ানোর সাহস খুব কম মানুষেরই থাকে। আশ্চর্য ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। তিনি শেষ বয়স পর্যন্ত নিজেকে আপডেট করে গেছেন। আমরা জানি কবি বরাবরই নতুনের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর কবিতায় আকছার দেখা যায় জীর্ণ-পুরাতনকে ভাসিয়ে দিয়ে সবুজ ও কাঁচাকে বরণ করার আহ্বান। তা শোনার মতো কান কি আমাদের আছে? যদি থাকে করে তাহলে ওই শুনুন বহু যুগের থেকে রবীন্দ্রনাথ “আত্মপরীক্ষা দেবার জন্যে যুবকদের মল্লযুদ্ধে আহ্বান” করছেন। অবশ্য এই মল্লযুদ্ধ মানে নতুনের “ছদ্মবেশধারী পুরাতন মিথ্যা”-কে পরাস্ত করতে 


Wednesday, July 6, 2016

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (১)




সাপ্তাহিক কবিতাপাক্ষিকের প্রথম সংখ্যার এডিটোরিয়াল নোটের শেষ লাইনটিতে বলা হয়েছে – “প্রাণের ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে শপথ করে কবিতাকে আপডেট করার সংকল্প গ্রহণ করুনআহ্বানটি অবশ্যই কবিতাপাক্ষিকের প্রাণ-পুরুষ প্রভাত চৌধুরীর। এটা আর বাংলা-কবিতার অনুরাগীদের জানতে বাকি নেই যে ষাটের দশকের কবি প্রভাত চৌধুরী যখন নব্বইয়ের দশকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে কবিতাপক্ষিক পত্রিকাটির সূচনা করলেন এবং দমবন্ধ বাংলা-কবিতাকে এক নতুন দিশার সন্ধান দিলেন সেই থেকেই তিনি নতুন কবিদের কবিতাকে আপডেট করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। অবশ্য একটু রহস্য করেই প্রভাতদা বলেন যিনি কবিতা লেখেন তিনিই কবি আর কবি যা লেখেন তাই কবিতা । কবিদের একমাত্র কাজ কবিতাকে আপডেট করা। প্রভাতদার এই প্রত্যয় নিয়ে অবশ্য আড়ালে-আপডালে বা খোলাখুলি অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করতেও ছাড়েন না। করতেই পারেন। কারণ মত-প্রকাশের স্বাধীনতা প্রত্যেকেরই আছে, আর কবিতায় বেদবাক্য বলে কিছু হয় না। বিরুদ্ধবাদীদের অনেকেই বলেন কবিতা তো কবিতাই যার আবেদন চিরকালীন সুতরাং সেখানে আপডেটেড বা ব্যাকডেটেট বলে কিছু হয় নাকি? ধন্দটা এইখানেই। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বিতর্ক করা অনর্থক তবে আলোচনা চলতেই পারে। যে কোনো সৃষ্টিকেই চিরকালীন হতে গেলে প্রথমে তো তাকে নিজের কালকে ছুঁতে হবে, অর্থাৎ সমকালীন হতে হবে। ভাষা-বিজ্ঞানীরা বলেন ভাষা আসলে নদীর মতো। সে শুধু বয়ে চলেছে। তার নানান বাঁক, নানান হয়ে ওঠা। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষাও নিজেকে আপডেট করে নেয়। তাহলে কবিতাও তো সেই ভাষাকে অবলম্বন করেই। তারও তো নানা বাঁক। পর্বে পর্বে তার নানান মেজাজ ও মর্জি অনেক মোচড় নানান ঝাঁকুনি। কাল থেকে কালান্তরে কবিতার সেই বদলগুলোকে কি কেউ ইচ্ছা থাকলেও অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করতে পারেন!  যে কোনো পরিবর্তনের মূলেই কিন্তু এই কালের কারসাজি। কী দ্রুত গড়িয়ে চলেছে সময় নামক এক অদৃশ্য রথের চাকা। সেই ধাবমান কাল দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে তার জাল ফেলে সবকিছুকে জড়িয়ে ধরে রথে তুলে নিচ্ছে। একটু একটু করে পালটে দিচ্ছে অনেক কিছু। মানুষের বেশভূষা খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে নানান সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রীতি-নীতি ধ্যান-ধারণা। এমনকি দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষাটাও অহরহ পোশাক পালটাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ব্যক্তিগত পরিসরে আমাদের ভাবনা-চিন্তগুলো কতখানি ওলট-পালট হল তা কি আমরা কখনো খেয়াল করে দেখি!বা সেই পরিবর্তনকে আমরা আমাদের লেখালিখিতে তুলে ধরি! তা যদি না করি তাহলে কেউ কেউ আমাদের কবিতাকে সেকেলে বলতেই পারেন। কবির অনুভব দিয়ে বলি- “মৃত পদার্থের মধ্যে চিত্তকে অবরুদ্ধ করে তার মধ্যে বিরাজ করা আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে সর্বত্র লক্ষ্যগোচর হয়, এমন-কি আমাদের দেশের যুবকদের মুখেও এর সমর্থন শোনা যায়। প্রত্যেক দেশের যুবকদের উপর ভার রয়েছে সংসারের সত্যকে নূতন করে যাচাই করে নেওয়া, সংসারকে নূতন পথে বহন করে নিয়ে যাওয়া, অসত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। প্রবীণ ও বিজ্ঞ যাঁরা তাঁরা সত্যের নিত্যনবীন বিকাশের অনুকূলতা করতে ভয় পান, কিন্তু যুবকদের প্রতি ভার আছে তারা সত্যকে পরখ করে নেবে” আমরা তো জানি জানি কবিতা কোনো যুক্তি ও বুদ্ধির মাধ্যমে অচল অটল জ্ঞান বিতরণের মতো জ্যাঠামশাই-সুলভ কাজকর্ম নয় বরং রাশভারী জ্ঞানের বাইরে বেরিয়ে এসে কবিতা মানুষের অফুরন্ত প্রাণ-স্পন্দিত অনুভবের স্ফূরণ। অথচ বয়স যত বাড়ে ততই নতুন নতুন উদ্দীপনা ও ইনফরমেশনের অভাবে অ্নুভূতির মালকোষগুলি ভোঁতা মেরে যেতে চায়। তাই প্রতিটি সংবেদনশীল কবিকে চারপাশে গড়ে ওঠা সাম্প্রতিক সংলাপগুলির সঙ্গে নিজস্ব অভিজ্ঞতা মিশিয়ে নিজেকে আপডেটেড রাখতে হয়। নিজের কবিতাবোধের সঙ্গে এই কাল-সচেতনাতাকে মেশানোই কবির অন্যতম প্রধান কাজ। এবার প্রাণের ঠাকুরের কথাতেই বলি - কালের গোয়ালঘরের দরজা খোলা, তার গোরুতে দুধ দেয় না, কিন্তু নটে গাছটি মুড়িয়ে যায়

Friday, July 1, 2016

কবিতার আপডেট – আপডেটেড কবিতা (৭)



কবিতার আপডেট আপডেটেড কবিতা (৭) 

বৈদিক স্তোত্র যারা রচনা করেছিল অনেকেই তাদের ঋষি-কবি বলে থাকেনকিন্তু বেদকে কেউ কাব্য বলেন না। বলা হয় ধর্মগ্রন্থ। যদিও সুললিত ছন্দ উপমা-অনুপ্রাস-রূপক প্রভৃতি অলংকারের প্রয়োগ অন্ত্যমিল ধ্বনিমিল শ্বাস ও স্বরের ওঠানামা সবই সেখানে পুরোমাত্রায় হাজির কিন্তু তবুও স্তোত্রগুলিকে কবিতা বলা হয়নি। সংহিতার অধিকাংশ স্তোত্রে যা কিছু আছে সেগুলি মূলত নানান দেবতার স্তুতি এবং সেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিতা বহুবিধ কামনা-বাসনা। অনুমান করা অসম্ভব নয় এই সব দেবতাদের বেশিরভাগই আবার আর্যদের নানান গোষ্ঠীর পূর্ব-পূরুষ যারা এককালে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিল এবং প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে এদেশের অনার্য ভূমিপুত্রদের পরাজিত করে তাদের নগরগুলি ধ্বংস করে নিজেদের দখল বিস্তার করেছিল। স্তোত্রগুলিতে সেইসব আর্যপুরুষদের আকৃতি সাজপোশাক অলৌকিক কাজকর্ম এবং তাদের অসীম বীরত্ব এইসব কিছুকেই ফেনিয়ে ফেনিয়ে তুলে ধরা হয়েছে যজ্ঞের কাজে ঋক বা মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্যেপ্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার সময়টা ছিল আজ থেকে ৩৫০০ বছর আগে। সভ্যতার সেই ঊষা-লগ্নে কবিতা তো দূরের কথা সাহিত্যের কোনো রকম ধারণাই তৈরি হয়নি। তবে আর্যরা আধা-সভ্য যাযাবর সম্প্রদায় হলেও তাদের ছিল একটি সুগঠিত এবং সুসংবদ্ধ ভাষা। যদিও কোনো লিপি ছিল না। আর্য-ঋষিরা ছিল নিরক্ষর। বেদ ছিল শ্রুতি। শুনে শুনে মুখস্ত করতে হত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এদেশে দখল বিস্তারের পিছনে যেমন ছিল আর্যদের উন্নত সামরিক-শক্তি তেমনি সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের পিছনে তাদের ভাষাশক্তির জোরও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। অনার্যদের সঙ্গে যুদ্ধের বিবরণ সেই হিসেবে বেদকে আদিম যুদ্ধগীতিও বলা হয়। স্তোত্রগুলির মধ্যে তাই কোনো মহত্ত্ব বা উদারতা নয় বরং সেখানে একটা যুদ্ধপ্রিয় জাতির যথেষ্ট নৃশংসতাই প্রকাশ পেয়েছে। শক্তির গুণগান ও উপাসনার মধ্যেই  ঘুরপাক খেয়েছে অতুলনীয় দক্ষতার অধিকারী সেইসব ঋষিকবিদের যাবতীয় বুদ্ধি আবেগ আত্মিক-উন্নতি আলোকপ্রাপ্তি ও সৌন্দর্যচেতনা।কবিত্বের বাকিটুকু ঢাকা পড়েছে যজ্ঞের ধোঁয়ায়অবশ্য গোষ্ঠীপতিদের পাশাপাশি কিছু কিছু প্রাকৃতিক শক্তিকেও দেবতার আসনে বসানো হয়েছিল। সেই রাত্রি ঊষা নদী প্রভৃতি কিছু সূক্তের বর্ণনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে কবিসুলভ বিস্ময়বোধ, মুগ্ধতা, কৌতূহল, জানার আগ্রহ ইত্যাদি। সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের তেজ দেখে তাকে বলা হচ্ছে স্থাবর ও জঙ্গম সব কিছুর আত্মা স্বরূপ (১.১১৫)। ঊষার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে ঊষা যেন স্বর্গের দুহিতা, গৃহিণী যেমন সকলকে জাগিয়ে দেন ঊষাও তেমনি জগতের সবাইকে জাগরিত করেন। নারী যেমন পুরুষের কাছে আসে কিংবা স্ত্রী যেমন সুন্দর পোশাক পরে স্বামীর কাছে হেসে ফেলে ঊষাও তেমন(১.১২৪)অন্য জায়গায় ঊষাকে সদ্য স্নান করে উঠে আসা নারীর সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে(৫.৮০) ভোরবেলা প্রসঙ্গে বলা হলা যেন কালো রঙের গাভিগুলি লালরঙের গাভিগুলির সঙ্গে মিশে গেল(১০।৬১)সপ্তম মণ্ডলে(৭.১০৩)একটি মজার সূক্ত আছে যার দেবতার নাম মণ্ডুকবর্ষাকালে বৃষ্টির জল গায়ে পড়লে ব্যাঙেদের মধ্যে যে উল্লাস দেখা যায় এই সূক্তটি তারই বর্ণনা। স্বভাবতই তা অন্যগুলির চেয়ে আলাদা এবং সেখানে যথেষ্ট কবিতার মজা আছে। এছাড়া অক্ষ-সূক্ত(১০.৩৪)অন্ত্যেষ্টি-সূক্ত(১০.১৮)বিবাহ-সূক্ত(১০.৮৫)এগুলিতেও প্রচুর কাব্যিক উপাদান আছে। অবশেষে বলব অরণ্যানী সূক্তর কথা(১০.১৪৬)যেখানে বনের গাছপালা পশুপাখির ডাক কাঠ-কাটা বা ফল-মূলের কথা এসব থেকে এক অন্য বার্তা উঠে আসে, যার সঙ্গে আর যাই হোক যাগ-যজ্ঞের কোনো সম্পর্ক নেই। এই হল ঋকবেদ সংহিতার কবিতা-সংক্রান্ত আপডেট সেখানে কোনো বিমূর্ত-ভাবনা নেই ঠিকই তবে কবি-কল্পনার ক্রম-জাগরণ আছে।