ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৫)
এই বিশ্বায়নের যুগে এসেও একটা কথা
নিশ্চিত করে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ এখনো বাংলার সংস্কৃতি জগতের গৃহদেবতা। আধুনিক
পর্বের অন্যতম কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘সূর্যাবর্ত' নামের লেখাটিতিতে বলেছিলেন
– “রবীন্দ্রনাথ হাল বাংলার সিদ্ধিদাতা গণেশ। তিনি তো আমাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের
সূত্রাধার বটেই, এমনকি তাঁর বাণী-ব্যতিরেকে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও লাভ নেই”।
কথাগুলি লেখা হয়েছিল আজ থেকে আশি বছর আগে সেই ১৯৩৬ সালে। ইতিমধ্যে বদলে গেছে
শতাব্দী বদল হয়েছে সহস্রাব্দেরও। এই সময়কালে বাংলা-কবিতাও এক বিন্দুতে থেমে
থাকেনি। তার দেহে ও মনে, মেজাজে ও মর্জিতে ঘটে গেছে হাজারটা ওলট-পালট। নতুন নতুন
উচ্চারণের চিহ্ন তার সারা গায়ে জ্বলজ্বল করছে। নিত্য-নতুন পরিবর্তনের ছোঁয়া তাকে
কিছুতেই ব্যক-ডেটেড হতে দিচ্ছে না। নতুন নতুন দিশা খুঁজতে খুঁজতে বাংলা-কবিতা এখন
প্রকৃত অর্থেই বহুমুখী। একবিংশ শতকের এই দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষাপটে নতুন
প্রজন্মের কাছেও কবিগুরু এক আশ্চর্য প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই
ভুবন-গ্রামে ক্রমশই বেড়ে চলা মৌলবাদ আতঙ্কবাদ ভোগবাদ পণ্যসংস্কৃতি এই সব কিছুর
সাপেক্ষেই প্রয়োজন হয়ে পড়ছে রবীন্দ্র-সৃষ্টির দিকে বার বার ফিরে তাকানোর। তিনি তো
শুধু কবি নন, তিনি যে আমাদের ফ্রেন্ড-ফিলোজফার এন্ড গাইড। যে কোনো সুখে দুখে বিপদে
বিপর্যয়ে নিজেদের মুখ দেখার জন্য তিনি আমাদের আত্মার দর্পন। আর তাঁকে নিয়ে
ব্যাবসা-বাণিজ্য তাও তো ক্রমবর্ধমান। কপিরাইট মুক্ত হবার পর
তাঁর রচনাবলি হয়েছে সুলভ ও সহজলভ্য। বিভিন্ন
প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের সৌজন্যে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান কবিতা
নাটক গল্প এখন আরো বেশি করে পৌঁছে যাচ্ছে আমবাঙালির ঘরে ঘরে। এসবই রবীন্দ্র-অনুরাগীদের কাছে খুবই সুখবর।
তবে
এই ইতিবাচক আবহের মধ্যে দুর্ভাগ্যের কথা একটাই নতুন পরিসরে রবি ঠাকুরের উপর নতুন আলাপ-আলোচনা সেভাবে দানা বাঁধছে না। যা হচ্ছে তার বেশিরভাগটাই সেই
গতানুগতিক বিদ্যায়তনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকতার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ। এই অচলায়তন ভাঙার জন্য তরুণ প্রজন্মকেই
এগিয়ে আসতে হবে।আমরা জানি বাংলা কবিতায় আধুনিক-পর্বের শুরুটা হয়েছিল কট্টর রবীন্দ্র-বিরোধিতা দিয়ে্। অবশ্য তা করা ছাড়া সেই পর্বের
কবিদের অন্য উপায়ও ছিল না। কারণ
নতুন প্রজন্মের কবিদের আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে রবীন্দ্র ভাবচেতনা তখন এক বিরাট বাধা হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে । তাকে
অনুসরণ করতে গেলে সমূহ বিপর্যয়। তার
বিরুদ্ধে যেতে হলে যথেষ্ট সাহস দরকার। তরুণ
তুর্কিরা দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিলেন। আর
বিকল্পের খোঁজে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য যুবারা চোখ রাখলেন পশ্চিমের দিকে সাগরের ওপারে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা হল অম্ল-মধুর। এক দিকে বিবাদ অন্য দিকে
বন্ধুত্ব। তবে কল্লোলের কাল শেষ হলে ঝগড়াটা আর রইল না। ১৯২৮ সালেই প্রকাশিত হয়ে
গেছে শেষের কবিতা। সব বিদ্রোহের সেখানেই ইতি। তরুণের দল নতুন করে মেতে উঠলেন
রবীন্দ্র-বরণে। তাই বলে বুদ্ধদেব
বসু-সুধীনদত্ত-জীবনানন্দ-বিষ্ণুদে-অমিয়চক্রবর্তীরা তাঁদের পথ থেকে সরে এলেন না।
শুরু হল রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক কবিতার যুগ। সেটা কবির জীবনের শেষ দশক। তখনো কবি
নতুনের সন্ধানে অক্লান্ত। আবার বুদ্ধদেব বসু সেই সময়ের নতুন কবিদের কবিতা-সংকলন ‘আধুনিক
বাংলা কবিতা’ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রথমেই রাখলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ১৯৫৩ সালে
লেখা ভূমিকাটিতে কৈফিয়ৎ হিসেবে তিনি জানালেন- “কোনো পাঠক হয়ত মনে-মনে বলছেন –
রবীন্দ্রনাথের পরে প্রথম নতুন তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই, সেকথাও সত্য তাই এই সংকলন
আরম্ভ হয়েছে ‘লিপিকা’র রচনা দিয়ে, যে-বইতে, ‘মানসী’ থেকে ‘বলাকা’ পর্যন্ত এক জন্ম
শেষ করে, রবীন্দ্রনাথ নতুন করে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর শেষ পর্যায়ের রচনার ধারা
আমাদের সাম্প্রতিক কাব্যে নানাভাবে ফলপ্রসু হয়েছে, পরবর্তীর প্রতিবেশিতার জন্য সেই
সসম্বন্ধটি চিনতে পারা হয়তো সহজ হবে।” বুদ্ধদেব বসুর কথার সূত্র টেনে এখনো বলা যায়
মডার্নিজিমের পরে যে পোস্ট-মডার্নিজিমের শুরু সেখানেও প্রথম নতুন সেই রবীন্দ্রনাথ।
No comments:
Post a Comment