Monday, August 8, 2016

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৪)

ভাবীকাল ও রবীন্দ্রনাথ (৪) 




ঔপনিবেশিক সময়ে গোরা-সাহেবদের হাত ধরে সাগরপার থেকে যে আধুনিকতাকে এই বঙ্গভূমিতে আমদানি করা হয়েছিল আমরা জানি জীবনের শেষপর্বে এসে রবীন্দ্রনাথকেও তার সঙ্গে বেশ কিছুকাল ঘরবাস করতে হয়েছিল। কবির কাছে সে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল তা নিয়ে আমাদের বিস্তর কৌতূহল। এনিয়ে চর্চা ও গবেষণাও কিছু কম হয়নি। কবির প্রয়াণের পঁচাত্তর বছর পরে এই নতুন শতকের নতুন সময়ে দাঁড়িয়ে আসুন পাঠক উত্তর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে আমাদের মতো করে কিছুটা আলাপ সেরে নিই। প্রথমে দেখে নেওয়া যাক রবীন্দ্র-মননে ইউরোপীয় আধুনিকতা কতটা ঢেউ তুলতে পেরেছিল বা কবি তাকে কতটা ছুঁতে পেরেছিলেন। আধুনিকতার কথা বলতে গেলে মহাযুদ্ধের কথা বলতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ব-মানবের কাছে কোনো সুখ সমৃদ্ধি বা সংহতির বার্তা নিয়ে আসেনি। মানব-সভ্যতার হাতে প্রগতির কোনো নতুন দিশাও তুলে দিতে পারেনি। বরং আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের মনে লালিত এতকালের সনাতন ন্যায়-নীতি ও মুল্যবোধকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছিল। সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছিল এক ব্যাপক ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ। তাও কল্পনাতীত ভাবে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত ও সভ্যসমাজের লোকজনের হাতে। মানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার এই বর্বর লোভকে কখনো মেনে নিতে পারেননি। নানা সময়ে নানা লেখায় তিনি তার মনের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন। এই বিপুল ধ্বংসের পটভূমিকায় লেখা হয়েছিল ওয়েস্টল্যান্ড যা দিয়ে ইউরোপীয় কবিতার নতুন পথচলা শুরু। ১৯২২ এ তাঁর সেই মাস্টারপিসে এলিয়ট সাহেব লিখেছিলেন - A heap of broken images আর তার দশ বছর পরে ১৯৩২এ প্রকাশিত বীথিকা-র দুর্ভাগিনী কবিতায় কবিগুরু লিখলেন - ভাঙা বিশ্বে পড়ে আছে ভেঙে-পড়া বিপুল বিশ্বাস। ইউরোপীয় আধুনিকতা এই ভাঙা-বিশ্বের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নতুন বিশ্ববীক্ষার আলোয় সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে এই বঙ্গভূমিতেও আস্তিক্য-বুদ্ধি, সত্যনিষ্ঠা, সৌন্দর্যবোধ, আনন্দ-মঙ্গল-কল্যাণ-প্রেম এইসব মিলিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের ভাবনালোক বিশ শতকের নতুন প্রজন্মের মনঃপুত হল না। রবি-কিরণের প্রকোপে হাঁসফাঁস করা অস্তিত্বের সংকটে-ভোগা কবি-যশঃপ্রার্থী তরুণ-তুর্কিরা খুঁজল অন্যপথ। ইংরেজি শিক্ষার সুবাদে ততদিনে তাঁদের জানা হয়ে গেছে ইউরোপীয় সাহিত্য এবং ফ্রয়েড ও মার্ক্সের দর্শন। তখন আদিগন্ত ছায়া-বিস্তারকারী রবীন্দ্রচেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনে হচ্ছে সর্বত্যাগী বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হবার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, অনাচারী ব্যাভিচারী লম্পট হবার মধ্যেও কিছু কম আনন্দ নেই। নিজেদের রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য সেই ভাবনা থেকেই কল্লোল-পত্রিকার সূত্রপাত। তাকে কেন্দ্র করে নতুন সাহিত্য-আন্দোলন। সেই আন্দোলনকারীদের কাছে মানুষের মানে দাঁড়াল রক্ত মাংস হাড় মেদ মজ্জা ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ কাম হিংসা সমেত গোটা মানুষ। সেটা অবশ্য জগদীশ গুপ্ত, মণীশ ঘটক(যুবনাশ্ব), বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এঁদের গল্প-উপন্যাস যতটা বেশি প্রকট হয়েছিল কবিতায় ততটা নয়। তবে নজরুল ইসলাম অচিন্ত্য সেনগুপ্ত বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনানন্দ দাশ এঁদের কবিতায় একটা দ্রোহ একটা ভিন্ন উচ্চারণের বীজ অবশ্যই বোনা হয়ে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক পর্বের ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ ও রবীন্দ্রকবিতার মার্জিত শুচিতায় গীতগোবিন্দ লালিত ও বিদ্যাসুন্দর পালিত যে শৃঙ্গার রস ও যৌনতার প্রকাশ কিছুকাল ঢাকা পড়েছিল। নতুন সময়ে পশ্চিমি হাওয়ার নতুন মেজাজ গায়ে মাখিয়ে কল্লোলের গল্প-উপন্যাস-কবিতা বাঙালির সেই স্মৃতিকে আবার উসকে দিল। সুতরাং শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। সেই সংঘাতে ইন্ধন জোগালেন শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। ২৩ ফাল্গুন ১৩৩৩ সালের একটি চিঠিতে তিনি কল্লোল-গোষ্ঠির লেখালিখি নিয়ে কবিগুরুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ১৩৩৪ সালের শ্রাবণ সংখ্যা বিচিত্রায় প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের ধর্ম’। তারপরের বিতর্ক তো ইতিহাস।

No comments:

Post a Comment